চন্দ্রাণী মজুমদার
একযাত্রায় ইতিহাস, শিল্প আর অরণ্যছোঁয়া ভ্রমণকথা
অরণ্য আর ইতিহাস একযাত্রায় ছোঁব বলে চললাম অজন্তা-ইলোরা আর পেঞ্চ।
রাত ৯টা ৫৫-এর আজাদ হিন্দ এক্সপ্রেসে উঠলাম। পরদিন আবার এ সময়েই জলগাঁও পৌঁছনোর কথা। কিন্তু ট্রেন একটু লেট করায় আমরা জলগাঁওয়ের আগের স্টেশনে নেমে পড়লাম। সেখানে স্টেশনও সৌভাগ্যক্রমে বাসস্ট্যান্ডের একদম কাছে। আর্য হোটেলে রাতের মতো একটা আশ্রয় ও আহার মিলে গেল। পরদিন সকালেই ৮টা নাগাদ একটি ফাঁকা বাসে আরাম করে বসে পৌনে দুই ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম ফর্দাপুরের অজন্তা হলিডে রিসোর্টের দোরগোড়ায়।
তাড়াতাড়ি গোছল-খাওয়া সেরে অটোয় চলে এলাম অজন্তা টি জংশনে। গুহা আরো একটু দূরে, পাহাড়ের ওপর। সেখানে যাওয়ার জন্য বিশেষ ব্যাটারিচালিত বাসের ব্যবস্থা আছে। গাছপালাঘেরা সুন্দর পিচের রাস্তা ধরে ১০ মিনিটের মধ্যে অজন্তা গুহার সিংহদরজায়। টিকিট কেটে সামনে এগোই। পাথরের সিঁড়ি দিয়ে কখনো উঠে, কখনো নেমে পাহাড়ের ওপর ৩০টা গুহা দেখতে হবে। এই ওঠানামায় যদি অসুবিধা থাকে তবে তার বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে রয়েছে ‘ডুলি’। আমরা আমাদের পায়ের ভরসাতেই ওপরে উঠতে লাগলাম। সমতলে পৌঁছে বাঁ দিকে চোখ ঘুরিয়ে সব ক’টা গুহাকে একসাথে অর্ধচন্দ্রাকারে দেখা গেল। নিচে জলশূন্য বাঘোরা নদীর রেখে যাওয়া পদরেখা এঁকেবেঁকে পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে বিলীন হয়েছে।
অজন্তায় মোট ৩০টি গুহা আছে। খ্রিষ্টের জন্মের ২০০ বছর আগে প্রায় ২০০ জন বৌদ্ধ ভিক্ষু, ভাস্কর ও শিল্পী তাদের শিল্পসৃষ্টির অসীম বাসনা, দারুণ দক্ষতা ও অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে এই অদ্বিতীয় স্থাপত্য সৃষ্টি করেছিলেন সহ্যাদ্রি পাহাড়ের ঢালে অগ্নেয় পাহাড় কেটে। এরপর গুহাগুলোর ভেতরের দেয়ালে অলঙ্কারের মতো স্থান পেয়েছে শিল্পীদের হাতে আঁকা ছবি ও পাথরের খোদাই করা মূর্তি। গুহাচিত্রগুলোতে বিভিন্ন জাতক-কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। গুহামন্দিরগুলোর নির্মাণকাজ খ্রিষ্টজন্মের ২০০ বছর আগে থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় খ্রিষ্টজন্মের ৬৫০ বছর পর। এরপর এগুলো লোকচক্ষুর অন্তরালে পাহাড়ের ওপরে বনজঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। ১৮ শতকে একদল ব্রিটিশ শিকারি ভারতের শিল্পস্থাপত্যের এই অমূল্য নিদর্শন আবিষ্কার করেন। এর প্রায় ২৪ বছর পর ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষ রবার্ট গিল অজন্তা গুহাচিত্রের অনুলিপি তৈরি করলেন। ২০ বছর ধরে একা তিনি ৩০টি ছবির অনুলিপি তৈরি করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সিডেনহ্যাম প্রাসাদের এক প্রদর্শনীতে ২৫টি ছবি পড়ে যায়। বাঁচে মাত্র পাঁচটি ছবি। সেগুলো আজ কেনসিংটন প্রাসাদে পরম যত্নে রয়েছে। এরপর বহু বিদেশি গুণী ও বোদ্ধা অজন্তায় এসেছেন অত্যাশ্চর্য এই শিল্পসুধা পান করতে। আবার লুটেরাদের দ্বারা আক্রান্তও হয়েছে অজন্তার শিল্পকলা। ১৯২০ সালে ভূমিকম্পেও প্রচুর ক্ষতি হয়েছে গুহাগুলোর। প্রকৃতি ও মানুষের হাতে অজন্তার অস্তিত্ব বারবার বিপন্ন হয়েছে। আর আজ তো কালের আঘাতে জরাজীর্ণ হয়ে ধ্বংসের প্রহর গুনছে। গুহাগুলোর কোনো কোনোটা বিহার অর্থাৎ সন্ন্যাসীদের বাসের জন্য। কোনোটা চৈত্য বা চ্যাপেল অর্থাৎ সাধনমন্দির। গুহাগুলোর মধ্যে ৮, ৯, ১০, ১২, ১৩ নম্বর গুহাগুলো তৈরি করেছেন হীনযান আর বাকিগুলো মাহযান শ্রেণীর সাধকেরা। হীনযান-সৃষ্ট গুহামন্দিরগুলোতে কোনো মূর্তি বা চিত্রের অস্তিত্ব নেই। কেবল তাদের বিশ্বাসের প্রতীক বিরাজমান। গুহাগুলোর কোনো কোনোটার নির্মাণকাজ আবার সম্পূর্ণ হয়নি।
গুহাগুলোর ভেতরকার চিত্র ও স্থাপত্যের গুণাগুণ বিচার করা বাতুলতা হবে। এই মান সৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে শুধুই মাথা নত হয়ে যায় সম্ভ্রমে। তবে অজন্তার চিত্রকলার বর্তমান অবস্থা দেখে চোখ সজল হয়ে উঠল। নিজেকে এত অসহায়, এত ক্ষুদ্র লাগল এই ভেবে যে দেশের এত মূল্যবান শিল্প-নিদর্শন কেমন করে এক ক্ষীণ গতিতে বিলীন হতে চলেছে, তা বুঝেও সেগুলোকে রক্ষা করতে আমরা অক্ষম। কতগুলো শিল্পপ্রাণ মানুষ তাদের শিল্পীসত্তা ও অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে কঠিন পাহাড় কেটে এক আশ্চর্য চোখ ধাঁধানো শিল্পকীর্তির অভিপ্রায়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন। তাদের হয়তো সৃষ্টিতেই আনন্দ ছিল, ধ্বংসের পরিণতি নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না। কিন্তু আমরা যে কত মূল্যবান সম্পদ হারাচ্ছি তা ভাবলেই মন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। তবে যতটা সম্ভব এই অমূল্য অদ্বিতীয় স্থাপত্যকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা হচ্ছে। যেমন- গুহাগুলোর নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত পেট্রলচালিত গাড়ি বাতিল করে ব্যাটারিচালিত গাড়ি ব্যবহার করা হচ্ছে, এ ছাড়া গুহাগুলোর মধ্যে খুব জোরাল আলোর পরিবর্তে ছবিগুলোর নিচে খুব ছোট নিয়ন আলো লাগানো হয়েছে। দর্শকেরা যাতে ছবি স্পর্শ করতে না পারেন তার জন্য নির্দিষ্ট দূরত্বে রেলিং দেয়া হয়েছে। কিন্তু সামান্য মানুষের আর কতটা ক্ষমতা। কালের সাথে বুঝে ওঠা কি মুখের কথা!
পরদিন আমাদের গন্তব্য ইলোরা। মাঝে দেখে নেবো আওরঙ্গাবাদের বিবি-কা-মকবরা।
বিবি-কা-মকবরা বানিয়েছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেব-পুত্র আজম শাহ তার মা অর্থাৎ, আওরঙ্গজেবের প্রথম পত্নীরর স্মৃতিতে। বিবি-কা-মকবরাকে দাক্ষিণাত্যের তাজমহল বা ‘গরিব কি তাজ’ও বলা হয়। আগ্রার তাজমহলের আদলে বানানো হলেও আকারে এটি অনেক ছোট। চাকচিক্য, ঠাটবাটে দু’টির মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। আগ্রার তাজমহলের একপাশে নামাজ পড়ার মসজিদ ও আরেক পাশে অতিথিশালা আছে। কিন্তু বিবি-কা-মকবরায় শুধুই মসজিদটি রয়েছে। সমাধিসৌধের মেঝে ও মেঝে থেকে হাতদুয়েক ওপর পর্যন্ত দেয়াল মার্বেলের হলেও ওপরের বাকি অংশ প্লাস্টার অব প্যারিসে তৈরি। তবে জাফরির সূক্ষ্ম কারুকাজ মুগ্ধ করে। সৌধের ভেতরে যেখানে সম্রাট-পত্নী চিরনিদ্রায় শায়িতা। তাজমহলের সমাধি থেকে তা কোনো অংশে কম নয়। এখানেও মৃত্যুর নিস্তব্ধতা ও পবিত্রতা বিদ্যমান। চার দিক রেলিংয়ে পরিবেষ্টিত। ওপর থেকে দেখলাম নিচে মখমলের চাদরে আবৃত মুঘল বংশের বেগমের সমাধি।
ওখান থেকে চলে এলাম সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধিতে। নিজ ব্যয়ে নিজ ইচ্ছায় তৈরি হয়েছে সম্রাটের অতি সাধারণ সমাধি। চার দিকে সাদা পাথরের জালিতে ঘেরা হিন্দুস্তানের শেষ উল্লেখযোগ্য মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সমাধির কোথাও বংশের গরিমা কিংবা মুঘল সম্রাটের উপযুক্ত দম্ভের লেশমাত্র নেই। আছে শুধু নীরবতা আর শান্তি। অদূরে সম্রাটপুত্র আজম শাহ ও তার পত্নীর সমাধিতেও শ্রদ্ধা জানালাম। পাশে তাদের গুরু পীর মহম্মদের সমাধিও রয়েছে।
এবার চললাম সোজা ইলোরার পথে। আগে থেকেই বুকিং করা ছিল ইলোরার একমাত্র হোটেল কৈলাসগিরি। হোটেলে ঢুকে স্নান-খাওয়া সেরে অভিনব ভাস্কর্যের প্রতীক ইলোরা গুহা দর্শনে বেরুলাম। কৈলাসগিরি হোটেল থেকে ১০ মিনিটের হাঁটাপথে গুহা পৌঁছে গেলাম। টিকিট কেটে একজন পদপ্রদর্শক সাথে নিয়ে প্রথমেই ঢুকলাম ইলোরার সর্বশ্রেষ্ঠ গুহা কৈলাসে। প্রসঙ্গত, ইলোরায় মোট ৩১টি গুহা আছে। তার কয়েকটি হিন্দুধর্মের, কয়েকটি বৌদ্ধ ও কয়েকটি আবার জৈন ধর্মের। কৈলাস গুহাটি হিন্দু ধর্মের। ক্রম অনুযায়ী ১৬ নম্বর গুহা।
এখানে প্রধানত বিশাল বিশাল পাথরের মূর্তির মাধ্যমে শিব-পার্বতীর বিভিন্ন রূপ সৃষ্টি করা হয়েছে। একটা পাহাড়কে ওপর থেকে তিন দিক কেটে যে অংশটা মাঝখানে বেরিয়েছে, সেটিতে ছেনি ও হাতুড়ির সাহায্যে সুনিপুণ হাতে ও অসামান্য ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতা প্রয়োগ করে একটি রথের অনুকরণে মন্দির নির্মাণ করেন সে যুগের শিল্পীরা, চালুক্য ও রাষ্ট্রকুট রাজবংশের আনুকূল্যে। কৈলাস গুহায় প্রবেশ করলেই সম্মুখে রথাকৃতি মন্দির আর তার সামনেই বিরাজ করছেন মহালক্ষ্মী দেবী। মন্দিরের দক্ষিণ ও উত্তর দুই দিকে রামায়ন ও মহাভারতের কাহিনী ছোট ছোট মূর্তির মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। রথ টেনে নিয়ে যাচ্ছে যে, হাতির দল, তাদের বেশির ভাগই শুঁড়হীন অবস্থায় রয়েছে। গাইড ভাই ক্ষোভ মিশ্রিত গলায় বললেন এগুলো সম্রাট আওরঙ্গজেবের হিংসার শিকার হয়েছে। সিঁড়ি ভেঙে মন্দিরের ওপরে উঠে গর্ভগৃহে প্রবেশ করে শিবলিঙ্গ দেখলাম। রথাকৃতি মন্দিরকে মাঝখানে রেখে চারপাশের পাথরের দেয়ালে শিব-পার্বতীর বিভিন্ন লীলা প্রকাশ পেয়েছে। মূর্তিগুলোর কারুকাজ দেখে চোখ ফেরানো যায় না। কৈলাস থেকে বেরিয়ে আমরা অল্প দূরত্বে ১ থেকে ১২ নম্বর বৌদ্ধ গুহাগুলোর মধ্যে কয়েকটি দেখলাম। ইলোরার ১ থেকে ৩৪ নম্বর গুহা অর্থাৎ বৌদ্ধ, হিন্দু, জৈন গুহাগুলো অর্ধচন্দ্রাকারে অবস্থান করছে। প্রত্যেকটি গুহার প্রবেশপথ পরস্পরের থেকে খানিক দূরে অবস্থিত। কৈলাস গুহা থেকে বৌদ্ধ গুহাগুলো হাঁটা দূরত্বে হলেও কোনো কোনো হিন্দু ও জৈনগুহা দর্শন করতে অটোর সাহায্য নিতে হয়। তা ছাড়া সমগ্র গুহাদর্শন বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই আমরা বাছাই করে কয়েকটি গুহা দেখেছি। ১২ নম্বর গুহাটি অবিকল একটি বিদ্যালয় আবাসনের মতো। এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল। গর্ভগৃহে বুদ্ধের মূর্তি। পাথরের খাঁড়াই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এলাম। সেখানেও দারুণ কারুকার্য করা বিরাট বিরাট পাথরের মূর্তি রয়েছে। আরো কিছু বৌদ্ধ গুহা দেখলাম যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১০ নম্বর গুহা। এর অপর নাম বিশ্বকর্মা গুহা। ইলোরার এই একমাত্র চৈত্য গুহাটিতে প্রায় সাড়ে ৪ মিটার উঁচু এক বুদ্ধমূর্তি আছে। কৈলাস গুহা থেকে খানিকটা দূরত্বে হওয়ার কারণে পর্যটকের ভিড় এখানে কম। অদ্ভুত এক প্রশান্তি বিরাজ করছে এই আলোআঁধারি গুহায়।
বৌদ্ধ গুহাদর্শন শেষ করে আবার কৈলাসের সামনে ফিরে এলাম। ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে নতুন উদ্যমে বেরিয়ে পড়লাম অন্যান্য হিন্দু ও জৈন গুহা দেখতে। অটো আমাদের প্রথম নিয়ে এলো ২৯ নম্বর গুহাতে। এই গুহার অপর নাম ‘দুখারলেনা’ অথবা ‘শীতনাহানি’। গুহাটির মূল আকর্ষণ বিভিন্ন দেবদেবীর সুউচ্চ মূর্তি, যাদের অনেকের ক্ষুদ্রমূর্তি আমরা কৈলাসে দেখে এসেছি। বিশালত্বের পাশাপাশি মূর্তিগুলোর নিখুঁত সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করল।
এরপর ৩২ নম্বর গুহা। এটি জৈন গুহা। নাম ইন্দ্রসভা। ইলোরায় অবস্থিত পাঁচটি জৈন গুহার মধ্যে এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ। মন্দির-চত্বরে ঢুকলেই ডানহাতে একটা প্রমাণ মাপের পাথরের হাতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মূল মন্দির একতলায় হলেও বেশি আকর্ষণীয় দোতলাটা। চার দিক মনোমুগ্ধকর ভাস্কর্যে ভরা। মনে হলো অন্ধকারে খাঁড়াই সিঁড়ি বেয়ে ওঠে আসাটা সার্থক। যেসব পর্যটক দিনের শেষে পরিশ্রমের ভয়ে ওপরে উঠলেন না, তারা জানলেন না কোনো অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হলেন।
ইন্দ্রসভার পাশেই জগন্নাথসভা বা গুহা ৩৪। ছোট এই জৈন গুহাটি বহু মূর্তিতে ভর্তি। ফেরার পথে ২১ নম্বর গুহাটি দেখে নিলাম। এটি একটি হিন্দু গুহা। এই গুহাটির খোলা চত্বরে একটি নন্দী-মূর্তি রয়েছে। এতগুলো মনোমুগ্ধকর গুহা দেখে যখন হোটেলে ফিরলাম তখন শরীর বিধ্বস্ত অথচ ভারতীয় ভাস্কর্যকলার এক পরম গৌরবময় ঐতিহ্যের সাক্ষী হতে পেরে প্রাণ উচ্ছ্বসিত।
সকালে ওঠে মালপত্র গুছিয়ে গোসল-খাওয়া সেরে আমরা চলে এলাম আওরঙ্গাবাদ স্টেশনে। এখান থেকে ট্রেনে যাবো নাগপুর। নাগপুর থেকে আমরা যাবো মধ্যপ্রদেশ-মহারাষ্ট্রের সীমান্তে পেঞ্চ অভয়ারণ্যে। নাগপুর থেকে একটা গাড়ি রিজার্ভ করে মোটামুটি ঘণ্টাতেই পৌঁছে গেলাম পেঞ্চের দোরগোড়ায়। মেইন গেট থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরত্বে জঙ্গলের মধ্যে মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের বাংলো। আগে থেকেই ঘর বুক ছিল। তবে একটু জলদি এসে পড়ায় রিসেপশনে আধ ঘণ্টার মতো অপেক্ষা করতে হলো। ঘরে ঢুকে স্নান সেরে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলাম নরম বিছানায়। আজকে আর কোনো তাড়া নেই, আজ শুধুই বিশ্রাম। কারণ বুধবার বিকেলে পেঞ্চে সাফারি বদ্ধ। আজ তো বুধবারই।
পরদিন সকাল ৬টার মধ্যে মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের জিপসি চড়ে হাজির হলাম পেঞ্চ ফরেস্টের চেকপোস্টে। সেখানে পরিচয়পত্র দেখিয়ে অনুমতি নিয়ে একজন গাইড-সমেত প্রবেশ করলাম অরণ্যের অভ্যন্তরে। নীলকণ্ঠ পাখির সাদর আহ্বানে অভিভূত হলাম। তার নীল পাখনার সৌন্দর্য মুগ্ধ করল। গভীর অরণ্যের নিস্তব্ধতা মাঝে মধ্যে ময়ূর কিংবা হরিণের মিলন-বাসনার আকুতিময় ডাকে ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে। আমরা তো চমকে আশান্বিত হচ্ছি, কী জানি বাঘ নাকি! কিন্তু গাইড-ভাই ভুল ভেঙে দিলো- ‘ইয়ে আলার্মকল নেহি, ইয়ে মেটিংকল’।
আমরা যখন বাঘ খুঁজতে চিরুনি-তল্লাশি চালাচ্ছি, তখন সামনে হঠাৎ মামার ভাগ্নে অর্থাৎ শিয়াল দেখতে পেলাম। তাই সই, মামার বদলে ভাগ্নে! তিন-চারখানা ক্যামেরার ফ্রেমে ফটাফট শিয়াল বাবাজি বন্দি হলো। সবুজ বনানীর বুক চিরে আমাদের জিপসি এগিয়ে চলেছে। পথের মাঝে কতগুলো হরিণ খেলে বেড়াচ্ছিল। জিপসি দেখে তড়িৎ গতিতে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেল।
বাঘের যদি একান্তই দেখা না মেলে তবে হাতির পিঠে চড়ে টাইগার সাফারির ব্যবস্থা আছে। যে বাঘ জঙ্গলের যে এলাকায় বাস করে তাকে বনকর্মীরা সেই এলাকায় গিয়ে খুঁজে বের করে। জিপসিগুলো জঙ্গলে সেন্ট্রাল পয়েন্টে হাজির হয়ে জেনে নেয় বাঘের সন্ধান মিলেছে কি না। মিললে ইচ্ছুক দর্শনার্থীরা মাথাপিছু ২০০ টাকার বিনিময়ে হাতির পিঠে গভীর জঙ্গলে ঢুকে সেই বাঘের দেখা পেতে পারে। আমরাও ইচ্ছে প্রকাশ করতেই গাইড আমাদের হাতির পিঠে ওঠার সিরিয়াল নম্বর নিয়ে এলো। নির্দিষ্ট সময়ে মই বেয়ে হস্তিপৃষ্ঠে আরোহণ করে ব্যাঘ্র দর্শনে চললাম। বাঘ তখন পাহাড়ের খাদের গুহায় নাক ডেকে দিবানিদ্রায় ব্যস্ত। আমরা সদ্যজাত ঘুমন্ত শিশুকে হাসপাতালের বেডে প্রথম দেখার মতো পরম উৎসাহে দেখতে লাগলাম। কিন্তু দুই মিনিটের মধ্যে আবার হাতি ফিরে চলল। এইটুকু দেখে মন ভরল না। ইতোমধ্যে জঙ্গল থেকে বেরুবার সময়ও হয়ে গিয়েছে। তাই এখনকার মতো বাঘ দেখার আশা ছেড়ে ফেরার পথ ধরলাম।
বিকেলে আবার হাজির হয়ে গেলাম পেঞ্চ ন্যাশনাল ফরেস্টের দরজায়। নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের জিপসির জন্য নির্দিষ্ট পথ ধরে এগিয়ে চলমান জঙ্গলের গভীরে। যদিও শীতের সদ্য বিদায়ের পর বসন্তের নতুন কচিপাতা ডালে ডালে সবুজের আভা ছড়াচ্ছে কিন্তু তারা সংখ্যায় খুব কম হওয়ায় সবুজের ঘনত্ব খুব কম বরং শীতের শুকনো ডালই বেশি। মাঝে মধ্যে একটা-দুটো সাদা অদ্ভুত দর্শন বৃক্ষ চোখে পড়ছে। একেবারে শ্বেতপাথরের তৈরি মনে হয়। গাইড বললেন, এগুলো ‘ঘোস্ট ট্রি’। এরা নাকি ঋতু অনুযায়ী নিজেদের রঙ পরিবর্তন করে। যেমন- শীতকালে হালকা গোলাপি, বর্ষাকালে সবুজ ও গ্রীষ্মকালে সাদা। একটি কালো পাথরের ভেতর থেকে একটি ভূতগাছ এত সুন্দরভাবে উঠে দাঁড়িয়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে শুভ্র প্রস্তরের তৈরি কোনো বৃক্ষমূর্তি। এসব দেখতে দেখতে হঠাৎ গাইড কান খাড়া করে কিছু শুনে ফিসফিস করে বলল, মনে হচ্ছে বাঘ আছে। শুনেই আমরা সতর্ক হয়ে বসলাম। মিনিটের মধ্যে আরো অনেক জিপসি আমাদের সামনে পেছনে দাঁড়িয়ে গেল। অরণ্যের মধ্যে সেই মুহূর্তে পিন পড়লে শব্দ হবে। সবার চোখই তখন দূরের এক জলাশয়ের দিকে। যদি ওখানে বাঘ পানি খেতে আসে। জলাশয়ে তখন হরিণের দল জল খাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষার পরও কোনো হরিণেরই গতিবিধির পরিবর্তন হলো না। তাদের স্বাভাবিক চলার মধ্যে বাঘ দেখার ভীতি বা চঞ্চলতা কিছুই চোখে পড়ল না। বুঝলাম এবারো তার সাথে দেখা হলো না। সব জিপসির মতো আমরাও এগিয়ে চললাম সামনের পথে অন্য কিছু দেখার আশায়। পরে শুনলাম একটি বাচ্চা বাঘ জলাশয়ের দিকের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে আমাদের সব গাড়ির পেছন দিয়ে রাস্তা পার হয়ে অপর দিকের জঙ্গলে ঢুকে গেছে। একেবারে পেছনের জিপসির পর্যটকরা তাকে দেখতে পেরেছেন। কিন্তু আমাদের ভাগ্যে সে সুযোগ জোটেনি। তবে মজার ব্যাপার হলো সেই বাঘ এতই খুদে ছিল যে হরিণ বা অন্যান্য নিরীহ প্রাণী তাকে দেখে একটুও ভয় পায়নি। তাই বোধ হয় কোনো সাবধানি-ডাকও দেয়নি। আর তার ফলে আমরাও ব্যাঘ্রশাবকের আগমনবার্তা পাইনি।
পরদিন এবং তারও পরদিন আরো তিনবার অরণ্যের চেকপোস্টে হাজিরা দিয়ে আমরা গভীরে ঢুকি। প্রতিবারই আমাদের চোখ খুঁজেছে হলদে-কালো ডোরাকাটা। তার দেখা না পেলেও ময়ূর, কাঠঠোকরা, নীলকণ্ঠ, হুপো এইসব রংবাহারি পাখির সৌন্দর্য আপ্লুত করল।
বাঘ দেখতে না পেলেও অন্যান্য যেসব প্রাণীর দেখা মিলল তারাও কম আনন্দ দিলো না। একটা বিশাল বড় ফাঁকা মাঠের মতো জায়গায় দু’টি মা-হাতিকে, তাদের সদ্য জন্ম দেয়া দু’টি বাচ্চাকে নিয়ে বেড়াতে দেখা গেল।
গাইড বলল, এরা জংলি হাতি নয়, এরা কুনকি হাতি। নতুন মা হয়েছে তাই ‘মেটারনিটি লিভ’-এ রয়েছে। কিছুদূর এগিয়ে দেখলাম গাউরের একটি ছোট গোষ্ঠী পরমানন্দে ঘাস খাচ্ছে। চারটে পা দেখে মনে হয় প্রত্যেকটি পায়ে সাদা মোজা পরে আছে। এক সময় আমাদের জিপসি এসে পৌঁছল হনুমানদের সংসারে। মায়ের বুকে তার ছোট্ট বাচ্চা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, মা সতর্ক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সদ্য যারা মায়ের কোল ছেড়েছে সেসব শিশু হনুমানরাও পরম আনন্দে খেলে বেড়াচ্ছে। এক জায়গায় এসে মনে হলো যেন হনুমানদের ক্রেশে উপস্থিত হয়েছি। সেখানে একদল একই বয়সের বাচ্চা হনুমান খেলছে, একে অপরের সাথে লড়ছে। সে এক দেখবার মতো ব্যাপার। এরপর হনুমানের সংসার ছেড়ে এক সময় এসে পৌঁছলাম এক শিয়াল দম্পতির সংসারে। শিয়ালের গর্ত থেকে একটি বাচ্চা মাঝে মধ্যে মুখ বাড়িয়ে দেখছে। আর মা-শিয়াল সতর্ক হয়ে তাকে পাহারা দিচ্ছে। বাচ্চাদের বাবাও মাঝে মধ্যে আমাদের দিকে রক্তচক্ষে তাকিয়ে নিঃশব্দে শাসাচ্ছে। আমরা মনে মনে তাদের পরিবারের কুশল প্রার্থনা করে, সেবারের মতো বাঘ দেখার বাসনা পুরোপুরি ত্যাগ করে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলাম। শেষে এই কথাটা না লিখলেই নয়, বাঘ দেখতে পাইনি বলে আমাদের কোনো আপেক্ষ নেই। বাঘ ছাড়াও অরণ্যে যেসব বন্যপ্রাণী আমরা দেখেছি এবং মুক্ত বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছি, তাতেই আমাদের হৃদয় ভরে গিয়েছে কানায় কানায়।