শওকত আলী রতন
প্রতি বছর শীত মওসুমের প্রারম্ভেই অতিথি পাখিদের মিলনমেলায় পরিণত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জলাশয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যেসব অতিথি পাখি আমাদের দেশে আসে, এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস অন্যতম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস পাখিদের অভয়ারণ্য হওয়ায় ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির আগমন ঘটে এখানে।
এই সময়ে পাখিদের জলকেলিতে মেতে ওঠা, উন্মুক্ত শিকার ধরা ও অবাধ বিচরণ দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকা। আর এসব পাখির কলকাকলী দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২২টি জলাশয়ের মধ্যে প্রশাসনিক ভবনের সামনের লেক, জাহানারা ইমাম ও প্রীতিলতা হল সংলগ্ন লেক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের দু’টি জলাশয়ে অতিথি পাখির পদচারণা চোখে পড়ার মতো। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব পাখি আসে তার মধ্যে বেশির ভাগই হাঁসজাতীয় ও পানিতে বসবাস করে। এর মধ্যে সরালি, ফাইফেচার, গার্গেনি, ছোট জিরিয়া, মুরগ্যাধি, কোম্বডাক ও পাতারি অন্যতম।
এ ছাড়া অন্য প্রজাতির পাখির মধ্যে আছে মানিকজোড়, কলাই, ছোট নগ, জলপিপি, নাকতা, খঞ্জনা, চিতাটুপি, লাল গুড়গুটি প্রভৃতি।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হাওরগুলোতে শীত মওসুমে অতিথি পাখি শিকারিদের হাতে বিভিন্নভাবে শিকার হয়ে থাকলেও বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের জলাশয়ে আসা পাখি পুরোপুরি শত্রুমুক্ত। ক্যাম্পাসের লোকালয়ে পাখিদের অবাধ বিচরণই তার প্রমাণ করে। অনেক সময় পাখিগুলো জলাশয় থেকে ওপরে উঠে বিশ্রাম নিতে দেখা যায়।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লেকের জলে নির্ভয়ে এখান থেকে ওখানে উড়ে বেড়ায়। আর রাতের বেলা এসব অতিথি পাখি জলাশয় থেকে গাছের মগডালে বসে আশ্রয় নেয়। পাখি আসা উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারো সংশ্লিষ্ট স্থানগুলোতে যানবাহনের ভেঁপু, বাঁশি, পটকা, মাইক ব্যবহার, মিছিল ও বিরক্তিকর আড্ডা নিষিদ্ধ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
শীতকালে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এসব অতিথি পাখি আসে। তবে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না, কোন কোন দেশ থেকে এসব পাখি আমাদের দেশে আসে। শীতের শেষে এসব অতিথি পাখি ফিরে যায় আপন ঠিকানায়। পাখি গবেষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতি বছর শীতপ্রধান দেশের পাখিরা তীব্র শীত থেকে বাঁচতে পাড়ি জমায় বিভিন্ন নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে। এ সময় হাজার হাজার অতিথি পাখি দণি এশিয়ার নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশে আসে। হাওর এলাকাগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশের যেসব এলাকায় এসব পাখি আসে, তার মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম।
পাখিবিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ জানান, এখন যেসব পাখি এসেছে, এগুলো দেশীয় হাঁসপ্রজাতির সরালি, সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে পাখি আসেনি। পুরোপুরি শীত পড়লে চলতি ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ সাইবেরিয়ার পরিজায়ী পাখি আসতে পারে।
তিনি আরো বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ প্রতি বছর পাখিদের আগমনের ওপর জরিপ ও পাখিমেলার আয়োজন করে থাকে। এ বছর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে পাখি জরিপ করা হবে বলে জানান তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক জরিপে জানা যায়, এই ক্যাম্পাসে ১৯৯০ সালে বিভিন্ন প্রজাতির রেকর্ডসংখ্যক প্রায় সাড়ে ১০ হাজার অতিথি পাখির আগমন ঘটেছিল। গত বছরের জরিপে ক্যাম্পাসে ২০-২২ প্রজাতির দেশী-বিদেশী অতিথি পাখি শনাক্ত করা হয়েছিল। আগামী জানুয়ারির শেষের দিকে পাখিমেলা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান তিনি।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম বলেন, অতিথি পাখির অনুকূল বিচরণক্ষেত্র তৈরির জন্য প্রতি বছর জলাশয়গুলো পরিষ্কার করে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এক মাস আগে অতিথি পাখির আগমন উপলে ও তাদের বিচরণের স্থানগুলো উপযোগী করে তোলার জন্য বেশ কিছু কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অতিথি পাখি দেখতে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ভিড় করেন পাখিপ্রেমী মানুষ। সাধারণ দর্শনার্থীদের পাশাপাশি ছুটির দিনগুলোতে দেশী-বিদেশী অনেক দর্শনার্থী ভিড় করেন ক্যাম্পাসে। আপনিও ঘুরে আসতে পারেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অতিথি পাখির রাজ্যে। সৌজন্যে : নয়া দিগন্ত