Skip to content

অপরূপ লোভাছড়া

লোভাছড়া নদী দূরে মেঘালয়ের পাহাড়

লোভাছড়া নদী দূরে মেঘালয়ের পাহাড়

ফারুখ আহমেদ
একটু আগেও খটখটে রোদ ছিল। এখন অঝোরধারায় বৃষ্টি। সে বৃষ্টির ছাট আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে। বেত আর পলিথিনের ছাওয়া চালের ফুটো বেয়ে টপটপ করে পড়ছে পানি। আমরা পাঁচজন গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে তাকিয়ে দূর আকাশের পানে। যেখানে রোদেরা খেলা করছে পাহাড়ের গায়ে। অথচ আমাদের কাছে দৃষ্টিসীমা ঝাপসা করে দিয়ে বৃষ্টি ঝরছে, সে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমাদের ছোট নৌকা এগিয়ে চলেছে ভারত সীমান্তবর্তী মেঘালয় পাদদেশের ঝুলন্ত িব্রজের দিকে।
সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার একেবারে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে বালুভরা বেশ কিছু স্বচ্ছ পানির নদী। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লোভাছড়া নদী। লোভাছড়া নাম শুনে তো প্রেমে পড়ার অবস্থা। এবার বর্ষার শুরুতে সুযোগ পেয়ে লোভায় বেড়ানোর জন্য সিলেট রওনা হলাম। পরদিন সিলেট শহর থেকে সকাল সকাল লোভার উদ্দেশে যাত্রা। সঙ্গী বিনয় ভদ্র, রাজীব রাসেল, পিয়াল আর সেতু। জকিগঞ্জের সে পথে আগে কখনো যাইনি। পথে কত না গ্রাম, জনপদ আর মাঠ পেরিয়ে ভুল রাস্তা হয়ে অপরিচিত এক গ্রামে পৌঁছি দুপুর ১২টায়। সেখানে আমরা ছোট্ট একটা বাজার পেয়ে খেয়ে নিলাম। এরপর স্থানীয় এক বয়স্ক মানুষের সঙ্গে কথা। এবার আমাদের রাস্তা চেনা হয়ে যায়। আমরা সেই চেনা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলি। কিন্তু পিচঢালা পথ ছেড়ে মেঠোপথে চলতেই চালক বিরতি টানেন। অতিরিক্ত কাদামাখা পথ বিধায় চালক আর সামনে এগোতে সাহস পেলেন না, কী আর করা। আমরা সিএনজিচালিত অটো রিকশা ছেড়ে পায়ে চলা সরু মেঠোপথে পা বাড়াই। কাদাময় সে পথে চলতে কিন্তু মন্দ লাগছিল না। কিছুটা হেঁটে আমরা বাঁশসুন্দরীর পথ ধরি। পথের দুধারে ঘন বাঁশের জঙ্গল। সেসব বাঁশগাছের সারি যেন কুর্নিশ করে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছিল। কিছুটা পথ হেঁটে আমরা পেয়ে যাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত লোভার মুখ। আমাদের সামনে এখন সুরমা নদী। লোভার মুখে দাঁড়িয়ে দেখি দূরের মেঘালয়ের পাহাড় আর লোভাছড়া নদী। এখান থেকে আমাদের বাহন হবে নৌকা।
চলেছি পরিচ্ছন্ন সুরমা নদী দিয়ে। লোভার মুখ হচ্ছে সুরমা ও লোভাছড়া নদীর সঙ্গমস্থল। সুরমা নদী দিয়ে আমাদের ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছুটে চলে লোভাছড়া নদী অভিমুখে। নদীর বুকে ভিড় করা নৌকা নেই। এক-দুটো ইঞ্জিনচালিত নৌকা হঠাৎ হঠাৎ ঢেউ খেলিয়ে চলে যাচ্ছে। দূরে পাহাড়ের বুকে সূর্যরশ্মি। এসব মিলিয়ে যেন আমাদের এক অচীন দেশ ভ্রমণ। সুরমা পেরিয়ে আমাদের যাত্রা লোভাছড়ায় শুরু হতেই শুরু হলো এক চঞ্চলতা। সামনে মনোরম সৌন্দর্য দেখলে চঞ্চলতা তো আসেই। সঙ্গে বেশ জোর হাওয়া। নদীর পানি ছিটে ছিটে উঠছে নৌকায়, আছড়ে পড়ছে আমাদের চোখে-মুখে। আমাদের সঙ্গে কোনো লাইফ জ্যাকেট নেই। তবু মনে কোনো ভয়ডর নেই। চারপাশের সৌন্দর্য মনে একটা কথারই জানান দিয়ে চলল, এ কোথায় এলাম! চোখের সামনে লোভার উথালপাথাল ঢেউ আর অঝোরধারায় বৃষ্টি। আবার দূরে আঁকাবাঁকা পাহাড়ের গায়ে সূর্যের উঁকিঝুঁকি আর সবুজের ঝিলিক। এসব দেখতে দেখতে আমাদের নৌকা এগিয়ে চলল। কিন্তু বিকেল ঘনিয়ে আসায় ভারত সীমান্তবর্তী ঝুলন্ত সেতুর পথ ছেড়ে আমরা লোভাছড়া চা-বাগানের দিকে নৌকা ঘুরাই। এবার নৌকা চলছে লোভাছড়া চা-বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে চলা খাল দিয়ে। এভাবেই আঁকাবাঁকা জলপথ ধরে যখন আমরা ১৯২৫ সালে নির্মিত লোভাছড়া চা-বাগানের ঝুলন্ত সেতুর কাছে পৌঁছে যাই, তখন গোধূলি বেলা। সেই গোধূলিতে আমাদের উচ্ছ্বাস-আনন্দ চোখে দেখার মতো। সত্যি বলতে কী এমন গোধূলিবেলার কথা আজীবন মনে থাকবে!
দরকারি তথ্য
লোভা নদী আর লোভাছড়া চা-বাগান যেতে হলে সিলেট শহর থেকে যাত্রা শুরু করতে হবে। সে ক্ষেত্রে গন্তব্য হবে কানাইঘাট। আমরা গিয়েছিলাম ঘুরপথে। সহজ পথ হচ্ছে দরবস্ত-চতুল হয়ে কানাইঘাট সদর। এ ছাড়া গাজী বোরহানউদ্দিন সড়ক ধরে গাছবাড়ি হয়েও কানাইঘাট সদর পৌঁছানো যায়। যেভাবেই যান লোভা নদীতে তো বেড়াবেনই, দেখবেন লোভাছড়া চা-বাগানও। সারা বছরই এখানে বেড়ানো যায়। তবু বর্ষায় লোভা নদীর মজাই আলাদা। আর বৃষ্টির দিন হলে তো কথাই নেই। সে জন্য অক্টোবর পর্যন্ত লোভা নদী ভ্রমণ অসাধারণ। লোভা নদী আর লোভাছড়া চা-বাগান বেড়াতে হলে এক দিনই যথেষ্ট। সে জন্য সিলেট শহর থেকে আপনাকে সাতসকালে রওনা হতে হবে। এখানে সবুজ পাহাড় আর লোভা নদীর অসাধারণ স্বচ্ছ পানি একবার দেখলে বারবার যেতে ইচ্ছে করবে। সঙ্গে বাড়তি পাওনা লোভাছড়া চা-বাগানের বহু পুরোনো ঝুলন্ত সেতুর সঙ্গে এখানকার খাসিয়া গ্রাম। বাস, মাইক্রোবাস বা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যেতে পারেন কানাইঘাট। তারপর নৌকায় ঘুরে বেড়াবেন মনোরম লোভায়। তারপর চা-বাগান হয়ে ফিরতি পথ ধরা! কানাইঘাট বাজার ছাড়া খাবারের ভালো ব্যবস্থা নেই। তাই সঙ্গে পর্যাপ্ত খাবার রাখা ভালো।
সূত্র : প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *