Skip to content

অপার সম্ভাবনার রাঙ্গামাটি

আবুল খায়ের ও এ কে এম মকছুদ আহমেদ
পাহাড়-নদী-ঝরনার অনন্য মিশেলে গড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য রাঙ্গামাটি। কাপ্তাই লেকের বুকে ভেসে আছে রাঙ্গামাটির ছোট্ট জেলা শহর। শহরের আশপাশে তো বটেই, গোটা জেলার পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছটা। এখানকার জায়গাগুলো বছরের বিভিন্ন সময়ে সাজে ভিন্ন ভিন্ন রূপে। এই সৌন্দর্যকে পুঁজি করেই রাঙ্গামাটি হয়ে উঠতে পারে অর্থনৈতিকভাবে অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র। কেবল পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে রাঙ্গামাটি থেকে বছরে আয় হতে পারে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি বা ২০ কোটি ডলার। কেবল সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যটনের বিকাশ ঘটাতে এখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। রাঙ্গামাটির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর বিষয়টি সরকারের পর্যটন বিভাগের উপর নির্ভর করছে।

Rangamati

১৯৬০ সালে জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের লক্ষ্যে কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিলে সৃষ্টি হয় ৭০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ। এই হ্রদ ঘিরেই রয়েছে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ফলে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা হাতছাড়া হচ্ছে বছরের পর বছর।

রাঙ্গামাটিতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের জন্য বিনোদনেরও ঘাটতি রয়েছে। শুধু নতুন ও পুরাতন একটা করে কটেজ ও হানিমুন কটেজ আর মান্ধাতার আমলের বোট দিয়ে চলছে পর্যটন শিল্প।

পর্যটক আকর্ষণ করার যে স্পটগুলো রয়েছে সেগুলোতে লাগেনি কোন উন্নয়নের ছোঁয়া। একমাত্র ভরসা পর্যটনের ঝুলন্ত ব্রিজ। এটিও আবার নভেম্বরের দিকে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের কারণে কাপ্তাই হ্রদের পানি বৃদ্ধি পেলে তলিয়ে যায়। আর নিরাপত্তার অভাবে পর্যটকদের চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পর্যটন কর্তৃপক্ষ। শহরে বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠেনি বিনোদন স্থান।

কাপ্তাই হ্রদে মাছ চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। এই হ্রদে প্রাকৃতিকভাবে মাছের প্রজনন হয়। প্রজননের সময় তিন মাস নিষিদ্ধ থাকে মাছ শিকার। এই সময়ে মাছ শিকার যাতে সত্যিই কেউ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা গেলে মাছের বংশ বিস্তার বেড়ে যাবে এবং সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় হবে।

এছাড়া কৃষকদের উত্পাদিত আনারস, কাঁঠাল, আম লেবু, পেয়ারা প্রয়োজনীয় হিমাগারের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। অথচ সেখান থেকে প্রচুর টাকা আয় করা যায়। অন্যদিকে রাঙ্গামাটি জেলায় উত্পাদিত ফুলের ঝাড়ু পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।

রাঙ্গামাটিতে রয়েছে উপজাতীয় জাদুঘর। পুরো জেলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি আর ইতিহাস সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা মিলবে এই জাদুঘরে। এটি খোলা থাকে সোম থেকে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। জাদুঘরে বড়দের প্রবেশ মূল্য পাঁচ টাকা ও ছোটদের দুই টাকা।

উপজাতীয় জাদুঘর থেকে কাছেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থ স্থান রাজবন বিহার। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নানান আচার অনুষ্ঠান দেখতে পাওয়া যায় এখানে। রাজবন বিহারের পাশেই কাপ্তাই লেকের ছোট্ট একটি দ্বীপ জুড়ে রয়েছে চাকমা রাজার বাড়ি। নৌকায় লেক পাড়ি দিয়ে সেখানে যাওয়া যায়। রাজবাড়ির আঙিনায় পর্যটকদের যেতে বাধা নেই।

শীত মৌসুম জুড়ে যেন উত্সব লেগে থাকে এই ছোট্ট পাহাড়ি শহরটিতে। ১০টি ভাষাভাষীর ১১টি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টির স্বাদ নিতে হলে শীত মৌসুমেই রাঙ্গামাটি সফর করা ভাল।

রাঙামাটি শহরের বাইরে রয়েছে আরণ্যক পিকনিক স্পট, বালুখালী কৃষি ফার্ম, পেদাতিংতিং ও টুকটুক ইকো ভিলেজ। অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতির মধ্যে গড়ে ওঠা এক আবাস রাইন্যা টুগুন ইকো রিসোর্ট। এটি শুধু রিসোর্ট নয়। এখানে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, স্থানীয় সংস্কৃতি, লোকজ পরিবেশের পাশাপাশি আধুনিক সুবিধায় মুগ্ধ করে পর্যটকদের।

সকালের সূর্য যখন উঁকি দেয় তখন সোনালি আলোকছটায় লেকের পানির বর্ণিল রূপ ফুটে ওঠে। পাহাড় আর হ্রদের সাথে যেন এখানে সূর্যের দারুণ মিতালী। পড়ন্ত বিকেলের আলোকরশ্মি লেকের পানিতে আরো মোহনীয় হয়ে ওঠে। পাল্টে যায় লেকের পরিবেশ।

পর্বতপ্রেমী পর্যটকরা যেতে পারেন সুভলং অভিমুখে। বর্ষায় এখানকার ঝরনা হয়ে ওঠে চঞ্চল, ছন্দময়। কিন্তু শীত মৌসুমে ঝরনা যেন মৃতপ্রায়। এছাড়াও রাঙ্গামাটিতে ঘুরে দেখার মতো রয়েছে ডিসি বাংলো, পলওয়েল পর্যটন, বনবিথী, বেতার কেন্দ্র, টেলিভিশন উপকেন্দ্র, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র (অনুমতি সাপেক্ষে)।

পর্যটন থেকে আয় হতে পারে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি

২০১৮ সালের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে ১০ লাখ পর্যটক আনার পরিকল্পনা নিয়ে ২০১৬ সালকে পর্যটন বছর ঘোষণা করেছে সরকার। এ সময় এ খাতে ৮ লাখ লোকের কর্মসংস্থান ও ২০ কোটি মার্কিন ডলার (দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি) আয় করা সম্ভব বলে মনে করছে সরকার।

জানা যায়, বাংলাদেশের পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে তিন বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হচ্ছে—দেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক নিয়ে আসা, বৈদেশিক মুদ্রা আয়, কর্মসংস্থান ও এ খাতের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিনিয়োগ। আর এগুলো বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করার পরামর্শ।

প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, গত ৩ বছরে গড়ে ৫ লাখ পর্যটক বাংলাদেশে এসেছে। প্রতিবছরই পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। সে হিসেবে প্রথম বছর ২০১৬ সালে বিদেশি পর্যটক আনা হবে ৬ লাখ ৭৭ হাজার। এ সময়ে বৈদেশিক আয় ধরা হয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার এবং কর্মসংস্থান হবে ১ লাখ ৩০ হাজার জনের।

দ্বিতীয় বছর ২০১৭ সালে পর্যটক আসবে ৭ লাখ ৭৯ হাজার। ওই বছর বৈদেশিক আয় ধরা হয়েছে ১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং কর্মসংস্থান হবে ৩ লাখ ২০ হাজার জনের এবং ২০১৮ সালে পর্যটক আনার টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ লাখ ৩৫ হাজার। ওই বছর আয় ধরা হয়েছে ১৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার এবং কর্মসংস্থান হবে ৩ লাখ ৫০ হাজার জনের। এজন্য এ খাতের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে ইতোমধ্যে কাজও শুরু হয়েছে।

রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক মো. সামসুল আরেফিন বলেন, এই পার্বত্য জেলা পর্যটন শিল্পের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এখানে যারা আসবেন পর্যটনের স্বার্থে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। এ ব্যাপারে কিছু দিন আগে রাঙ্গামাটি পর্যটন বিকাশ ও সম্ভাবনা এবং কিভাবে প্রকল্প প্রণয়ন করা যায় এ নিয়ে পেশাজীবীসহ বিভিন্ন স্তরের লোকজনের জন্য ভিডিও কনফারেন্স করা হয়েছে। এ সময় বিভাগীয় কমিশনার, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব, প্রধানমন্ত্রীর এটুআই প্রকল্পের কনসালটেন্ট ও জেলার বিভিন্ন পেশার মানুষসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সবার মতামতের ভিত্তিতে একটি প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

এ ব্যাপারে রাঙ্গামাটি অঞ্চলের বন সংরক্ষক শামসুল আজম বলেন, এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ধরে রাখার জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্পৃক্ত করে সামাজিকভাবে বনায়ন করার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। সূত্র : ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *