হামিম উল কবির
অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি নিঝুমদ্বীপ। প্রকৃতির সকল সৌন্দর্য ঢেলে দেয়া হয়েছে এখানে। মেঘনা নদীর মোহনায় পলী জমে সৃষ্ট এ দ্বীপের চার দিক ঘিরে রয়েছে পানি। এ দ্বীপের দক্ষিণে রয়েছে সাগর উপকূল। নোয়াখালীর মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হাতিয়া উপজেলার আরেকটি দ্বীপ এটি। মূল দ্বীপ ছাড়াও নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নে রয়েছে আরো কয়েকটি ছোট ছোট দ্বীপ। পুরো ইউনিয়নটিই ম্যানগ্রোভ বৃক্ষে আচ্ছাদিত। মাঝে মাঝে রয়েছে কিছু বসতি ও ধানক্ষেত।
নিঝুম দ্বীপের চার দিকে ছড়িয়ে আছে শ্বাসমূলীয় হাজারো গাছ। শিকড়ের মতো শ্বাসমূলগুলো আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে যেন তাকিয়ে আছে। ২০০১ সালে এ দ্বীপটিকে নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৯ সালের আগে দ্বীপটি চর ওসমান নামে পরিচিত ছিল স্থানীয়দের কাছে। হাতিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মো: মাহবুব মোর্শেদের মতে, ‘এটি একটি ভার্জিন আইল্যান্ড। এখনো আদি প্রকৃতি এখানে খুঁজে পাওয়া যায় যা প্রতিটি পর্যটককে মুগ্ধ করবে।’
ম্যানগ্রোভ অরণ্য ছাড়াও দ্বীপটিতে রয়েছে অসংখ্য নাম জানা-অজানা পাখি। শীতকালে আসে হরেক রকমের অভিবাসী পাখি। ম্যানগ্রোভ অরণ্যের প্রধান বৃক্ষ কেওড়া। এ ছাড়া রয়েছে গেওয়া, বাইন, বাবলা, করমজা ও পশুর বৃক্ষ। এককথায় বলা চলে নিঝুমদ্বীপ যেন সুন্দরবনের কার্বন কপি। এ বৃক্ষের ফাঁকে ফাঁকে বাস করে চিত্রা হরিণ। কোনো শুমারি না থাকলেও নিঝুমবাসী ও বনভূমির লোকজন মনে করেন, ‘নিঝুমদ্বীপে ২০ হাজারের বেশি চিত্রা হরিণ রয়েছে।’ কেড়ড়া গাছের পাতা হরিণের প্রিয় খাবার। এই গাছের ডাল অনেক উঁচু হওয়ায় লাফিয়ে পাতা খেতে পারে না হরিণ। হরিণদের এ সমস্যার সমাধান করে দেয় বানর দল। গাছে গাছে লাফিয়ে বেড়ানো বানর দল কিচিরমিচির শব্দে নিজে খেয়ে হরিণ দলের জন্য ফেলে যাচ্ছে অসংখ্য কেওড়া পাতা। এগুলো খেয়েই পেট ভরে নেয় হরিণরা। নিঝুমদ্বীপের এ সৌন্দর্য কেবল বিকেলে দেখা যায়। সন্ধ্যা নামার আগে আগে পুরো দৃশ্যটাই অবলোকন করতে পারেন সৌন্দর্যপিপাসুরা।
সুন্দরবনের মতো হরিণের প্রধান শত্রু বাঘ না থাকলেও নিঝুম জাতীয় উদ্যানে হরিণের প্রধান শত্রু বন্য কুকুর। কুকুর পাল হরিণ খেয়ে সাবার করে দিচ্ছে।
নিঝুমদ্বীপের নিসর্গ মনোমুগ্ধকর হলেও যোগাযোগব্যবস্থা এখনো পুরণোকালের। হাতিয়া উপজেলা থেকে মোটরসাইকেলে অথবা জিপগাড়িতে (কোথাও কোথাও এটা চান্দের গাড়ি নামে পরিচিত) করে নিঝুমের কাছাকাছি আসতে হয়। পরে ইঞ্জিনের নৌকা পাড়ি দিয়ে নিঝুমে পা ফেলতেই নরম কাদামাটির ছোঁয়া। কাদা মাখিয়ে ওপরের দিকে আসলে চোখে অন্ধকার দেখতে হয়। হাতেগোনা পাঁচ-ছয়টি রিকশা আর মোটরসাইকেল ছাড়া কিছুই নেই যাতায়াতের। মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার জন্য মনস্থির করে ভাড়া কত শুনতে গেলেই দ্বীপে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে উড়ে যায়। দুই অথবা তিল কিলোমিটারের জন্য ভাড়া হাঁকানো হয় দুই থেকে তিন শ’ টাকা। এখান থেকে একটি মাত্র কংক্রিটের রাস্তা নামারবাজার অতিক্রম করে সমুদ্রতীরে পৌঁছানো যায়। এ রাস্তার দু’পাশে রয়েছে অনেক ছোট ছোট খাল, যেগুলো মিশে গেছে সমুদ্রের সাথে। বর্ষাকালে ভরা কটাল ও মরা কটালে জোয়ারের সময় কংক্রিটের এ রাস্তাটিও তলিয়ে যায় পানিতে। তখন চলাচল বেশ কঠিন ও কষ্টকর। তবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এ পানি সরে যায়। শেষ পানিটুকু সরে যায় ছোট ছোট খালগুলোর মাধ্যমে।
এফ কে বুখারী কমিউনিটি কিনিকের পাশের বাসিন্দা ফজলুল করিম বুখারী জানিয়েছেন, নামারবাজার থেকে সমুদ্র সৈকতে প্রায় ২০ কিলোমিটার হেঁটে বেড়ানো যায়। কক্সবাজার ও কুয়াকাটার মতো সুন্দর ও প্রশস্ত সমুদ্র সৈকত থাকা সত্ত্বেও নিঝুমদ্বীপের এ সৈকতে স্থানীয় জেলে ও এলাকাবাসী ছাড়া বাইরের পর্যটকের পা পড়েনি। নামারবাজারে একটি মাত্র ছোট হোটেল ছাড়া আর কোনো কিছু গড়ে উঠেনি। সৈকতে গেলে দেখা যাবে জেলেরা মাছ ধরছে পানিতে নেমে, নৌকায় চড়ে। ছোট ছোট ছেলে ও মেয়েরা চিংড়ি, কাঁকড়া ও অন্যান্য মাছের পোনা শিকারে ব্যস্ত।
সমুদ্রে পাওয়া যায় ওটার, উদবিড়াল (ফিশিং ক্যাট), বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ, সাপ ও ডলফিন। বল্লার চর, কামলার চর, চর ওসমান ও চর মুড়ি দ্বীপ নিয়ে গঠিত নিঝুপদ্বীপ ইউনিয়ন। এ দ্বীপের শুধু ভূমির আয়তন নয় হাজার ৫৫০ বর্গকিলোমিটার (তিন হাজার ৬৯০ বর্গমাইল)। এ ছাড়া ৩০ হাজার ৮৪০ বর্গকিলোমিটার (১১ হাজার ৯১০ বর্গমাইল) এলাকা বিস্তৃত এ দ্বীপের পানি। দ্বীপে ১০ হাজারের কিছু বেশি জনসংখ্যা বাস করে। বেশির ভাগই মাছ ধরে জীবনযাপন করে। স্বাস্থ্যসুবিধা নেই বললেই চলে। প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধগুলো ভ্রমণকারীদের সাথে নিয়ে যাওয়া ভালো। তবে এ দ্বীপের মূল রাস্তার পাশে বেশ বড় আকারের একটি ফার্মেসি রয়েছে।
নিঝুম ভার্জিন আইল্যান্ড নামে খ্যাতি পেলেও ঢেউ ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে এর মহামূল্যবান মাটি। ভাঙন ঠেকাতে কিছু পদক্ষেপ থাকলেও আরো পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানান এলাকার বাসিন্দা ফজলুল করিম বুখারী।
পর্যটন করপোরেশনের একটি মোটেল আছে এখানে, আছে ফরেস্টের একটি রেস্ট হাউজ এবং জেলা পরিষদের একটি ডাক বাংলো। পুরো হাতিয়ায় সারাক্ষণ বিদ্যুতের কোনো ব্যবস্থা নেই। নিঝুপদ্বীপের ধনী মানুষ জেনারেটরের সাহায্যে আলো জ্বালায় অথবা টেলিভিশন দেখে। এটা ছাড়া কিছুটা সচ্ছল পরিবারে রয়েছে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা। সৌরবিদ্যুতে টেলিভিশনও দেখেন তারা।
সূত্র : নয়া দিগন্ত