সাজেদুল ইসলাম শুভ্র
বেশ কিছুদিনের ভারত সফর ছিল সেবার, অনেকগুলো রাজ্য। এই বিশাল দেশটা সম্পর্কে আমার জ্ঞান ছিল শুন্যের কোটায়। সবাই কী সুন্দর জায়গাগুলো দেখেই হিন্দি ছবির সাথে মিলিয়ে নিচ্ছিল, সে সময় আমি হয়তো সামনে দাঁড়ানো পানিপুরীওয়ালার কাছে হিন্দিতে কীভাবে জিনিসটা চাইবো সেই প্ল্যান করছি! নীলক্ষেত থেকে একটা সাত দিনে হিন্দি শিখুন টাইপ বই কেন আনিনি, সেটার জন্যও দুঃখ হচ্ছে! ছয় সাতটা শব্দকে সম্বল করে একটা দেশে একমাস ছিলাম! ইত্তেফাকেই লিখেছিলাম জয়সালমীরে সোনার কেল্লা দেখার গল্প, আজকে শিমলা মানালির সেই দু-তিনদিনের স্মৃতিচারণ করতে বসেছি।
দিল্লি থেকে সফর শুরু। স্টেশনে এসেই শুনলাম আট ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়ের জন্য হোটেলে উঠলে মাঝরাতেই আবার ফিরে আসতে হবে। অগত্যা স্টেশনেই খবরের কাগজ পেতে সব বসে পড়েছে। গোল করে একটার সাথে আরেকটা লাগেজে শেকল লাগিয়ে রাখা, আর দশ-বারোজন ছেলেমেয়ে এরমধ্যে বসে দিব্যি উনো খেলে যাচ্ছে। প্লাটফর্মের লোকজনের রাজ্যের আগ্রহ সেখানেই। ভারতের স্টেশনগুলোতে আমি একটু ঘোরাঘুরি করেই পার করে দিয়েছিলাম, এবার আট ঘণ্টা তো আর যে সে কথা নয়! পদস্থ কর্তাদের জন্য সুন্দর অপেক্ষাগার, আমাদের সেখানে ঢুকতে দেবে না। দেশে হলে পরিচয় দিয়ে কত না সুবিধে পাওয়ার চেষ্টা হতো। এরমাঝেই কানে আসছে মুখস্থ বানী ‘কৃপায়া ধ্যান দিজিয়ে’ অনর্গল ধ্যান চাইছেন এক নারীকণ্ঠ, হয়তো কারও ট্রেন আসছে।
আট ঘণ্টা পরে এলো সেই কালকা মেইল। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম নাম যেহেতু ‘কালকা’ সেহেতু সে আজকে আসবে কেন? বাক্স-পেটরা নিয়ে উঠে বসেছি। সতের জনের সিট পড়ে সতের জায়গায়। বন্ধু মুনতাসির আর জিসানের দায়িত্ব থাকে হিন্দিতে কথা বলে খাতির করে অন্যদের সরিয়ে সিটগুলো এক করার। মনে আছে, শেষের দিকে একবার সতের জনের ছিট পড়লো প্রায় একইসাথে। সিট সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা বন্ধু দু’জন তখন অন্যদের সিট মিলিয়ে দেওয়া শুরু করলো।
ভোরের দিকে পৌঁছালাম কালকা স্টেশনে। এখান থেকেই টয় ট্রেনে শিমলা। আসলেই টয় ট্রেন! আমার ধারণা ক’জন মিলে টানাটানি করেই বগিগুলোকে ওঠানামা করানো যাবে, এটাতেই পাঁচ ঘণ্টা চড়তে হবে জানার পর কিছুটা ভয়ও কাজ করছে! পরে অবশ্য জেনেছি, এটা ভারত নয় শুধু, পুরো বিশ্বেরই আলোচিত এবং উপভোগ্য রেলপথগুলোর একটা। ট্রেন কখনও সাই সাই করে নিচে নামছে, আবার উঠছে। এ জানালায় দেখছি পাহাড়ি কোনো নদী, ও জানালায় সুন্দর কোনো ব্রীজ দেখে ডাক দিলে হুড়মুড় করে যাচ্ছি সেদিকে। হুট করেই ঢুকে যাচ্ছে টানেলে, পুরোই শিশুপার্ক! ট্রেন চলছে হয়তো পাহাড়ের ওপরে করা ১০০ ফুট উচু ব্রীজের ওপর দিয়ে হয়তো, নিচে তাকাতেই হা করে থাকি! গাড়ি স্টেশনে এসে থামে মাঝে-মধ্যে, আক্ষরিকভাবে ছবির মতো বললে যা বোঝায়, এগুলো ঠিক তাই! আবার বাচ্চা ট্রেনটা গাল ফুলিয়ে চলতে থাকে, আওয়াজ ছাড়ে জোরে। রাতে যখন শিমলাতে পৌঁছাই তখন পুরো পাহাড়টা যেন চিকচিক করছে। গাইড কাজলদা বলেন, ‘এই যে জ্বলতে থাকা আলোগুলো, এক হয়ে যেন নেকলেসের মতো দেখায়।’ সেদিন রাতে অবশ্য জোর করে এক দোকান খুলে কোনোরকমে পেটপূজো দিয়ে ঘুমোতে হয়েছিল অন্যরকম এক সকালের জন্য।
শিমলার সকালটা বোধহয় আমাদের জন্যই ছিল! ঘুম ভাঙে বন্ধুদের হৈ হুল্লোরে, একে হৈ হুল্লোর না বলে চিত্কার বলা যায় অনায়াসেই! কী আশ্চর্য! দরজা খুলে চোখ মেলে যা দেখলাম…পাহাড়ের ধারে অজস্র ঘরবাড়ি সব তুষারে ঢাকা, রাস্তায় বরফের পুরু আস্তর পরিষ্কারের চেষ্টা চলছে, বরফ ঠেলেঠুলে কোনোরকমে গাড়ি চলছে এবং আমাদের মুগ্ধ করে তখনও তুষার পড়ছে। জানা গেল, এখানে এ রকম তুষারপাত প্রায় ৭-৮ বছর পর। প্রকৃতি আমাদের এভাবে স্বাগত জানালো, ভাবতেই তো ভালো লাগছে। যতগুলো জ্যাকেট-জামা-জুতো ছিল সবই প্রায় গায়ে চেপে বেরিয়েছি সকালের খাবার খেতে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হয়, তাও বরফে ছেয়ে আছে, পিছলে পড়ে কারও কারও সবকিছু একাকার। তীব্র শীতে বরফ পড়া দেখতে দেখতে ধোয়া ওঠা আলু-পরোটা! এরপর যে রাস্তায় আমরা ঘুরলাম, এখানেই নাকি অনেক হিন্দি ছবির শুটিং হয়েছে, এর মাঝেও কয়েকটা ক্যামেরায় ছবি তোলা হয়েছে শত শত, নাকি হাজার হাজার?
গাড়ি চলে এসেছে, যাওয়া হবে কুফরি। সেখানে নাকি অনেক বরফ! আমি ভেবেই পাচ্ছি না, এর চেয়ে বেশি বরফ কীভাবে সম্ভব? পুরো রাস্তায় ধবধবে বরফে ঢাকা, মেঘের দেখাও মেলে কোথাও কোথাও। বারবার মনে পড়ছে নির্মলেন্দু গুণের জীবনের প্রথম বরফ কবিতাটা ‘খুলে দাও বরফের আল্পনা আঁকা হোটেলের সমস্ত জানালা… আমাকে আবৃত করে আজ শুধু বরফ ঝরুক। সারাদিন……….সারাদিন; আজ শুধু বরফের সাথে খেলা।’ বরফ বলতেই ফ্রিজের লোহার মতো বরফ মাথায় আসে আমার। কিন্তু কী মজার বিষয়, এই তুষার বরফগুলো একদমই নরম, যেমন ইচ্ছে তেমন গড়ন দেওয়া যাচ্ছে, বন্ধুরা গাড়ি থেকে নেমে কেউ কেউ বরফ দিয়েই মূর্তি গড়ছে, কেউ শুয়ে আছে বরফের মধ্যে। যাদের গলায় ক্যামেরা ঝুলছিল কেবল তারাই বিপদে, ক্লিকের অনুরোধ সবদিকে। একের পর এক ছবি উঠতে থাকলো, অনেকখানি জায়গার বরফ আমরা খেলাধূলা করে শেষ করে ফেলেছি! তা-ও কেন জানি শেষ হয় না, এ রকম জায়গাতে বারবার আসতে ইচ্ছে হয়।
আরও একবার রাতের শিমলা আমাদের সামনে। এবারে মল রোড, তবে আজ যেহেতু প্রচুর বরফ ঝরেছে তাই রাস্তাটা পিচ্ছিল। সমানে মানুষ রাস্তায় পিচ্ছলে পড়ে যাচ্ছে আর তা দেখার জন্য আমরা পাশেই জটলা হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি, ছেলেমানুষি এক আনন্দ পাচ্ছি সবাই, দূর থেকে সে সবের ছবি তোলাও চলছে। সেখানে একটা চার্চও আছে, ঘুরে এসেছে সেখান থেকে কেউ কেউ। রাতের খাওয়াটাও সেদিন একটু বড় আয়োজনেই ছিল, শিমলার এই বরফবরণ আমাদেরকেও তো যাপন করতে হবে!
পরের দিন মানালির পথে যাত্রা। অবশ্য ইতিমধ্যেই তথ্য পেয়েছি, গন্তব্যর চেয়ে এই যাত্রাপথটাও কম দর্শনীয় নয়। কিছুদূর যাওয়ার পরেই অবশ্য আমারও তাই মনে হয়েছে। আট ঘণ্টার পথ কিছু সময়ের জন্যই একঘেঁয়ে লাগেনি, সব জায়গাতেই থামতে ইচ্ছে করে। এতো পাহাড়, এতো নদী, এতো ঝরনা এর কী পরিসংখ্যান আছে কোথাও? আমাদের মাধবকুণ্ডের মতো ঝরনা যে কতগুলো রাস্তার পাশেই, তার ইয়ত্তা নেই। রাস্তার পাশের ধাবাগুলো দেখলেই আলু-মটর আর রুটি খেতে ইচ্ছে হয় অথবা মসলা দেওয়া এককাপ চা! আমাদের আগ্রহ বুঝে ড্রাইভাররাও দু’তিনবার থামিয়েছেন, দেখার চেয়ে বেশি ছবি তুলে আমরা আবার উঠে বসেছি। এ রকম একদম রুটিন করে আসলে সব হয় না, কিংবা কে জানে? ক্ষণিকের জন্য দেখবো জেনেই হয়তো মুগ্ধতার মাত্রাটা একটু বেশিই?।
মানালিতে পৌঁছাতেও বেশ বেলা গড়িয়ে গেছে। পরদিন শোলাং ভ্যালি যাওয়া হবে। কাছাকাছি একটু ঘুরে এসেই সেদিন ঘুম দিয়েছিল সবাই। সকালটা সুন্দর, অবশ্য নিমিষেই নিরামিশ হয়ে গেল। জানা গেল, ধর্মঘট চলছে, শোলাং ভ্যালি যাওয়া যাবে না। মন খারাপ করে সবাই বসে আছি। ড্রাইভার জানালো, ‘কাছেই একটা পাহাড় চূড়ায় গরম পানি আসে, সবাই সেখানে গোসল করে, বসে না থেকে চলেন যাই।’ আমরাও আগ্রহ নিয়ে কীভাবে পাহাড় থেকে গরম পানি আসে দেখতে গেলাম। গাড়ি থেকে আগেই নেমে গিয়ে অনেকটা উচুতে হেঁটে উঠলাম, তীব্র কৌতুহল মনের মধ্যে! এবং যারপরনাই হতাশ! স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এখানে সাপ্লাই গরম পানি দেয়, আর অনেকগুলো খোলা ওয়াশরুম করা, তাতে লাইন দিয়ে সবাই গোসল করছে! এই দৃশ্য কেউ দেখতে আসে এটা ওই গোসল করা লোকগুলো জেনেও খুব অবাক হলো! এই দুর্লভ দৃশ্য দেখানোর জন্য আমরা ড্রাইভারকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
সেদিনই আমরা পাশে আরেক মন্দিরে গেলাম, চলচ্চিত্রতে এর ঢের ব্যবহার। মেয়েরা সব স্থানীয় পোশাক-আশাকে সেজে-গুজে বসে আছে। জায়গাটা বেশ সুন্দর, কেন জানি সেই সময়টাতে লোকজন অনেক কম। আমরাই এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি। এরপর গেলাম মানালি ক্লাবে। ক্লাব যে এতো বোরিং হয়, সেটা দেখার জন্য যে কেউ অনায়াসে এখানে আসতে পারে। কেউ নিশ্চয়ই শোলাং ভ্যালি রেখে এখানে এসে ইনডোরে টেবিল টেনিস খেলতে চাইবে না। ভাগ্যিস পাশেই এক পাথুরে নদী ছিল, সেখানেই পাথরগুলো টপকে টপকে ঘুরে বেড়ানো বেশ অন্যরকম অভিজ্ঞতা। মানালি পার্কটাও হটাত্ করেই ঘুরতে ঘুরতে বের করে ফেলেছি আমরা। শুকনো পাতার শব্দ, এক কথায় প্রকাশ মর্মর! বরফ নিয়ে যেমন খেলা হয়েছে ঢের, এখানে পাতাও কম গেল না। শ’খানেক ছবি প্রতি ক্যামেরায় শুধুই পাতার।
রাতের মানালি সেদিন দেখেছি আমরা অনেকক্ষণ খোলা আকাশের নিচে, আগুন জ্বেলে অপেক্ষা। রুমালি রুটি আর শাহজাহানী মুরগির মাংস কখন আসবে? এবং সত্যিই সেদিনের খাবারটাও অন্যরকম ছিল ক্যাম্পফায়ারের সাথে। শোলাং ভ্যালি জায়গাটাতে না যেতে পেরে খানিকটা মন খারাপও ছিল অবশ্য। আবার আসলে ওটাই হয়তো তালিকায় প্রথমে থাকবে। মানালি থেকে ফিরতেও বেগ পেতে হয়েছে অনেক। অমৃতসরে আসবো আমরা। রাস্তায় রাস্তায় বেগ পেতে হয়েছে ধর্মঘটকারীদের জন্য। মানালি শিমলা ঘুরে আসাটা হয়েছে অনেকদিন হলো, এতোদিন পরেও অনেককিছু মনে পড়ে একেবারে স্পষ্টভাবে। ফিরে আসার সময় মনে হয়েছে অবশ্যই এখানে আবার আসা হবে! সৌজন্যে : ইত্তেফাক