Skip to content

আত্মসমর্পণের সাক্ষী যে টেবিল

দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হয় এই টেবিলে। জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে টেবিলটি l

দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হয় এই টেবিলে। জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে টেবিলটি

হাসান ইমাম
তিন হাত বাই দেড় হাত একটা টেবিল৷ ওপরের কাঠে চারদিকে ঢেউখেলানো নকশা। পায়ার নকশা বলতে লম্বা দুটি খাঁজ। পায়রাগুলো ক্রমশ ওপর থেকে নিচের দিকে সরু হয়ে গেছে৷ বিশেষ কোনো কারুকাজ নেই।

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রাখা এই সাদামাটা টেবিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্তের সাক্ষী। এটির ওপরই দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াই সেদিন চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছিল।
রেসকোর্স ময়দানে তড়িঘড়িই আয়োজন করা হয় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। দুই বাহিনীর শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা তৈরি। সামরিক আয়োজনও প্রস্তুত। কিন্তু একটা দলিলে সই করতে গেলে তো একখানা টেবিল লাগে। তড়িঘড়ি সেটা জোগাড়ও করে ফেলা হলো। আশপাশে অফিস-আদালত বলতে তো কিছু নেই। তাহলে এই টেবিল এল কোথা থেকে?

আত্মসমর্পণের মতো এক বিরাট ঐতিহাসিক ঘটনার উত্তেজনায় কেউই সেটা ভালো করে লক্ষ করেননি। টেবিলের উৎস সম্পর্কে খুব নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায় না। অনেকে বলে থাকেন, ঢাকা ক্লাব থেকে এটি এসে থাকতে পারে।

জাতীয় জাদুঘরের সাবেক কর্মকর্তা ফিরোজ মাহমুদ বলেন, ‘ধারে-কাছে ঢাকা ক্লাব ছাড়া তেমন কোনো ভবন ছিল না। তাই ঢাকা ক্লাব থেকে টেবিল-চেয়ার আসাটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া ঢাকা ক্লাবও একসময় টেবিলটা তাদের বলে শনাক্ত করেছিল।’ ফিরোজ মাহমুদ ১৯৭০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৩ সালের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত জাদুঘরের প্রধান নির্বাহী ছিলেন।

পরাজয়ের দলিলে সই করার পর একদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিনিধিরা দ্রুত বেরিয়ে যান। অন্যদিকে বাঙালিরা মেতে ওঠেন জয়োল্লাসে। রেসকোর্স ময়দান থেকে উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে সারা শহর ও গ্রামেগঞ্জে। টেবিলটা রাতভর পড়ে ছিল মাঠেই। ১৭ ডিসেম্বর ভোরের আলো ফুটতেই সেটা মাঠ থেকে হারিয়ে যায়। পরে তা কী করে এল জাতীয় জাদুঘরে?

সে আরেক ইতিহাস। জাদুঘরের সাবেক কর্মকর্তা ফিরোজ মাহমুদ বলেন, ‘১৭ ডিসেম্বর দুপুরের কিছুটা আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে টেবিলটা খুঁজতে যাই আমি। কিন্তু গিয়ে দেখি সেখানে কিছুই নেই। এরপর আমি পাকিস্তানি হামলায় গুঁড়িয়ে যাওয়া শহীদ মিনারের বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করে জাদুঘরে আনি। তারপর যাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে। সেখানেও নানা ধরনের জিনিস ছিল। কিন্তু কোনোভাবেই পাচ্ছিলাম না মাঠ থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই টেবিলের খোঁজ।’

একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রমজান আলী সর্দারের কাছ থেকে শোনা গেল, টেবিলটা আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারীর কাছে। ফিরোজ মাহমুদ দ্রুত সেখানে যান। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের পাশে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীদের সমবায় সমিতির অফিস। এই সমিতির একটি দোকানের বিক্রয় সহকারী ছিলেন মো. ইসমাত। তাঁর ছোট ঘরে ঢুকেই ফিরোজ মাহমুদ দেখতে পান টেবিলটা। প্রশ্ন করে তিনি জানতে পারেন টেবিলটা ১৭ ডিসেম্বর খুব সকালে মাঠ থেকে কুড়িয়ে এনেছেন ইসমাত। তাঁকে সাহায্য করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বেয়ারা আবদুল বারেক। পরবর্তী সময়ে সেটা ইসমাতের ঘরে পড়ার টেবিল হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।

টেবিল কিছুতেই হাতছাড়া করতে রাজি নন ইসমাত। ফিরোজ মাহমুদ গিয়ে ধরলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপক ফজলুল করিমকে। তাঁর হস্তক্ষেপে টেবিল দিতে সম্মত হন ইসমাত।

১৯৭৩ সালের ১২ মে থেকে টেবিলটা জাদুঘরে। এই টেবিলের একটি রেপ্লিকা এখন প্রদর্শন করা হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাটির নিচের জাদুঘরে। তবে অনেক খুঁজেও চেয়ার দুটোর সন্ধান মেলেনি। সৌজন্যে : প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *