Skip to content

আনন্দময় পথচলা

মো. জাভেদ-বিন-এ-হাকিম
পায়ে হেঁটে রুমা থেকে বগালেক যাব। সবাই সকাল সকাল প্রস্তুত। প্রায় ১৭ কি. মি. হাঁটতে হবে। আর্মি ক্যাম্পে নাম, ঠিকানা এন্ট্রি অতঃপর লাইনপি পাহাড় ট্র্যাকিং করে দুর্গম ঝিরিপথে হাইকিং শুরু। চার পাশে পাহাড় আর ঘন অরণ্য, তার মাঝ দিয়ে দে-ছুট দল মনের আনন্দে হেঁটে চলেছে। দেহ মনে কোনো ক্লান্তি আসেনি, আসেনি কোনো ভাবনা। ঢাকায় মাত্র কয়েক গজ হাঁটলেই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা! আর এখানে ভর দুপুরেও মাইলের পর মাইল হাইকিং। নৈঃশব্দের অরণ্যে হেঁটে চলা কতটা যে রোমাঞ্চকর, তা শুধু অনুভবই করা যায়, বর্ণনা করা যায় না। প্রায় চার ঘণ্টা হাঁটার পর প্রকৃতির এক অদ্ভুত সৃষ্টি আবিষ্কার করি। রুমা খালের পাশে উঁচু টিলা এমন সুন্দরভাবে সেজেগুজে আছে, যার তুলনা হয় না। অথচ আমরা প্রকৃতির এ দানকে রেখেছি অবহেলায়। এখানে বেশ কিছুক্ষণ নাচানাচি ও শীতল জলে লাফালাফি করে আবারও হাঁটা শুরু হলো। এবারের পথটা যেন আরও রোমাঞ্চকর আরও বেশি হূদয়ে গেঁথে থাকার মতো সুন্দর। দু’পাশের পাহাড় উঁচু হয়ে যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে, বিশাল আকৃতির গাছগুলো যেন তার সাথে পাল্লা দিচ্ছে। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা পাথরের মধ্যে বেশ কিছু পাথরের আকৃতি অদ্ভুত। দেখলে মনে হবে মানুষরূপী হায়েনাদের কবল থেকে বাঁচার জন্য বড় পাথরের মাঝে ছোট্ট পাথরটি লুকাতে চাইছে।

Bogalake

পায়ের নিচে বড় বড় পাথর আর মাথার উপর সূর্যের তাপ কিন্তু কেন যেন শীতের সকালের সোনা মাখা রোদের মতোই লাগছে। একটা সময় পথের মায়ায় মনে চেয়েছিল সেলফোন ছুড়ে ফেলে হারিয়ে যাই অজানায়! কিন্তু পেটের তাড়নায় তা আর হলো না। পাহাড়ের কুল ঘেষা উম্বং পাড়া ম. ইউ কারবারির ঘরে নুডুলস খেয়ে আপাতত পেট বাবাজিকে থামালাম। উপস্থিত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজনের সাথে কিঞ্চিত ভাব জমিয়ে কিছু তথ্য জেনে নিই। বিদায় নিয়ে আবারও বন্ধুর পথে ছুটে চলা। প্রায় সাড়ে আট ঘণ্টা হাঁটার পর পড়ন্ত বিকেলে নারিশ্বা ঝরনা মুখে বিরতি দিই। কী অদ্ভুত! কত সুন্দর তার রূপ। রিমঝিম শব্দ তুলছে পানির অবিরাম ধারা। ঝরনা মুখে প্রাকৃতিকভাবেই বেসিন তৈরি হয়েছে।

আসরের নামাজ পরেই হাইকিং অতঃপর ট্র্যাকিং। ঘন জঙ্গলের কারণে এবার দিনের আলোতেই অন্ধকার। টর্চের আলোতে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠছি। একসময় অমাবস্যার অন্ধকারেই পাহাড় চূড়ায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ি। চিড়া-মুড়ি-মিঠাই-খেজুর-পানি পান করে আবারও হাঁটা। সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে এসে পৌঁছাই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৭৪১ ফিট উপরে প্রকৃতির আপন খেয়ালে সৃষ্টি অনিন্দ্য সুন্দর বগা লেকের প্রান্তরে।

মি. কিম আমাদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। আজ রাতে তার কটেজেই থাকব। লেকের জলে সাফ-সতুর হয়ে বার-বি-কিউ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, আর মোস্তাক ‘পানি পানি’ হিন্দি গানের সাথে তাল মিলিয়ে নাচতে শুরু করে, পেজে লাইক না দিয়ে লাইকে পেজ দেওয়ার জন্য উপস্থিত অন্যান্য ভ্রমণপিপাসুদের মাঝে প্রচারণা শুরু করে দিল। তার এ রকম শিশুসুলভ কর্মকাণ্ডে আনন্দ বাঁধ ভেঙে আরও অনেকের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। বার-বি-কিউ খাওয়ার স্বাদও বেড়ে যায় বহুগুণ। লেকের ধারে গভীর রাত পর্যন্ত জম্পেশ আড্ডা দিয়ে ঘরে ফিরি।

পরের দিন সকালে বগালেকের চারপাশ দেখে আপন মনে বিড়বিড় করে বলি, আমাদের মতো এমন সৌভাগ্যবান জাতি খুব কমই আছে, যে দেশের প্রকৃতি এতটা উজাড় করে দিয়েছে অথচ মনের দিক থেকে কতটা দৈন্যদশায় আছি, তা হারে হারে টের পাওয়া যায় এ দৃশ্যে—যত্রতত্র ঘর বানিয়ে পুরো এলাকা বস্তিতে পরিণত করে সৌন্দর্য কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখনো সময় আছে কর্তৃপক্ষ একটু নজর দিলে বেঁচে যাবে বিস্ময়কর সৌন্দর্যের প্রকৃতির দান বগালেক।

যোগাযোগ :ঢাকা, গাবতলী ও ফকিরাপুল থেকে বাসে যেতে হবে বান্দরবান। ভাড়া নন-এসি ৬২০ টাকা, এসি ৭৫০ টাকা। বান্দরবান শহর থেকে রুমা বাজারে যেতে হবে চান্দের গাড়ি/বাস/জিপে। ভাড়া ২০০ টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা। রুমা বাজারে রাত যাপন করতে চাইলে বিভিন্ন রিসোর্ট, কটেজ, হোটেল ও বোর্ডিং আছে। ভাড়া ৫০ টাকা হতে ১২০০ টাকা পর্যন্ত। গাইড দিনপ্রতি ৫০০ টাকা নেবে। বগালেকে খাবার জনপ্রতি ১০০ টাকা, থাকা মাথাপিছু ১২০ টাকা। ফেরার সময় বগালেক থেকে জিপে চান্দের গাড়ি রিজার্ভ নেবে ৩৫০০ টাকা।

বিশেষ তথ্য : পর্যাপ্ত পরিমাণ শুকনো খাবার ও স্যালাইন এবং মশা ও জোঁক প্রতিরোধক ক্রিম সঙ্গে রাখুন। হাইকিং করার সময় একতাবদ্ধ থাকুন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখুন। সূত্র : ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *