আজিজুল পারভেজ
রাজধানীর ফুসফুস হিসেবে পরিচিত রমনা পার্ক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা আসছে। এখানে সব ধরনের অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ হচ্ছে। পহেলা বৈশাখে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী প্রভাতি আয়োজনের বাইরে আর কোনো অনুষ্ঠানের অনুমতি মিলবে না। পাশাপাশি উচ্ছেদ করা হবে পার্কের সব অবৈধ স্থাপনা। অবাঞ্ছিত বিদেশি বৃক্ষের বদলে পার্কজুড়ে লাগানো হবে দেশীয় বৃক্ষ।
সরকারের এমন শুভ উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন গৃহায়ণ ও পূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তিনি জানান, রমনা পার্কের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও এটিকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ব্যাপক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে এ পার্ক হবে রাজধানীর একটি প্রধানতম ল্যান্ডমার্ক। চূড়ান্ত পর্যায়ে এটিকে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে সংরক্ষণ করা হবে।
মন্ত্রী জানান, পরিবেশবাদীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে এখানে এমন কিছু বিদেশি বৃক্ষ রয়েছে, যা এ পার্কের সঙ্গে মানানসই নয়। এমন বৃক্ষগুলোকে চিহ্নিত করে সেসবের পরিবর্তে দেশীয় গাছ লাগানো হবে। গোটা পার্ককে দেশীয় ফুলের বাগানে শোভিত করা হবে, যাতে সারা বছরই বৈচিত্র্যময় ফুলের সৌরভ পাওয়া যায়। পার্কের ভেতরের লেকটিও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে আকর্ষণীয় করে তোলা হবে। প্রাতর্ভ্রমণকারীরা বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন স্থানে স্থাপনা গড়ে তুলেছে। পার্কের সঙ্গে সংগতিহীন স্থাপনাগুলোও উচ্ছেদ করা হবে। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের নিয়ে সেমিনার আয়োজন করা হবে। পাশাপাশি নিরাপত্তার ব্যবস্থাও জোরদার করা হবে।
রমনা পার্কের পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয় নিয়ে গত ২১ ডিসেম্বর পূর্ত মন্ত্রণালয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে একজন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ রমনা পার্কে পরিবেশের বিরূপ প্রভাব এবং অবাঞ্ছিত বৃক্ষ থাকার বিষয়টি পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন। সভায় প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় রমনা পার্কে কোনো ধরনের সভা-সমাবেশ ও অনুষ্ঠান আয়োজনে অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে পার্কের পরিবেশের সঙ্গে সংগতিহীন অবৈধ স্থাপনাও উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
পরিবেশবাদীরা বারবারই অভিযোগ করে আসছেন, বাণিজ্যিক ব্যবহার ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের কারণে রমনা পার্কের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে রেস্তোরাঁর কারণে পার্কের ভেতরে অবাধে যানবাহন যাতায়াত করছে। অনুষ্ঠানাদিতে উচ্চ স্বরে মাইক ব্যবহারের কারণে পার্কের নির্জনতা ও বৈচিত্র্যময় পাখির বসবাস হুমকির মুখে পড়েছে।
নিসর্গসখা অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা কিছুদিন আগে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশে আর দ্বিতীয় একটি রমনা উদ্যানের জন্ম হবে না। অথচ এর ভেতরেই রেস্তোরাঁ বসিয়ে পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে। এটি বন্ধের জন্য আমরা অনেক সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ করেছি। কোনোই কাজ হয়নি। ফলে যা হওয়ার হচ্ছে। প্রতিদিন রেস্তোরাঁয় শত শত গাড়ি ও হাজার হাজার মানুষ আসছে। এতে উদ্যানের নীরবতা ভঙ্গ হচ্ছে। পাখির কলধ্বনি স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে।’ রেস্তোরাঁর কারণে পার্কের পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে মর্মে গত ১৮ ডিসেম্বর কালের কণ্ঠে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়।
গত ২১ ডিসেম্বরের সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুসারে, রেস্তোরার জন্য বরাদ্দ জায়গার বাইরের অংশ এবং অননুমোদিত স্থাপনা সরিয়ে নিতে রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষকে নোটিশ পাঠানো হচ্ছে বলেও জানা গেছে। নতুন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে পার্কের সীমানাবেষ্টনী নতুন করে নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এতে ইটের দেয়ালের বদলে লোহার বেড়া দেওয়া হচ্ছে। উদ্দেশ্য, পার্কের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ও যেন এর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
এদিকে ২১ ডিসেম্বরের পর থেকে পার্কে আর কোনো অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। এ নিষেধাজ্ঞার কারণে গত ১৭ বছর থেকে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হওয়া পৌষ মেলাও এবার হতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে পৌষ মেলা কমিটির সভাপতি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘পূর্তমন্ত্রী আমাদের নিশ্চিত করেছেন যে ছায়ানটের অনুষ্ঠান ছাড়া আর কোনো অনুষ্ঠান হবে না পার্কে। পার্কটিকে হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হবে। রমনা পার্কের প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা আমাদেরও কাম্য।’
জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, বর্তমানে ৬৮ দশমিক ৫০ একর জমির ওপর রমনা পার্ক অবস্থিত। রাজধানীর বুকে এটিই সবচেয়ে বড় পার্ক। এখানে ৭১ প্রজাতির ফুল, ৩৬ প্রজাতির ফল, ৩৩ প্রজাতির ঔষধি, ৪১ প্রজাতির বনায়ন ও অন্যান্য ১১ প্রজাতির গাছ রয়েছে।
রমনা পার্ক প্রতিষ্ঠা পায় মোগল আমলে, ১৬১০ সালে। মোগলদের মাধ্যমেই রমনার নামকরণ হয়। সে সময়ে রমনার পরিসীমা ছিল বিশাল এলাকাজুড়ে। কম্পানি আমলে এলাকাটি জঙ্গলে পরিণত হয়। পরে উনিশ শতকে ব্রিটিশ শাসক ও ঢাকার নবাবদের সহায়তায় এটির উন্নয়ন সাধন হয়। ঢাকা শহরের নিসর্গ পরিকল্পনার কাজ শুরু হয়েছিল ১৯০৮ সালে লন্ডনের কিউই গার্ডেনের অন্যতম কর্মী আর এল প্রাউডলকের তত্ত্বাবধানে। শহরের সেই নিসর্গ পরিকল্পনার ফল ছিল রমনা পার্কের উন্নয়ন। সেই কাজ শেষ হতে সময় লেগেছিল ২০ বছর। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ