
একািকত্ব অনেক সময় বিষণ্নতাকে বাড়িয়ে দেয়। মডেল: লাবণ্য, ছবি: সুমন ইউসুফ
আহমেদ হেলাল
দীপ্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ভালোবাসে তারই বিভাগের আরেকটি মেয়েকে। দিন দু-এক আগে দুজনের মধ্যে বেশ ঝগড়া হয়, কথা-কাটাকাটি থেকে কথা বলা বন্ধ। রাগে-দুঃখে দীপ্ত এ দুই দিন বাসা থেকে বের হয়নি। কারও সঙ্গে কথা বলছে না, মুঠোফোন বন্ধ রেখেছে। আজ হঠাৎ করে তার কী মনে হলো, ধারালো ছুরি দিয়ে নিজের হাত কেটে ফেলে রক্তারক্তি। বাবা-মা তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গেলেন। চিকিৎসার পর হাতের অবস্থা ভালো, কিন্তু তার মন ভালো হচ্ছে না। অবশ্য এখন সে এই হাত কাটার জন্য লজ্জিত। বুঝতে পেরেছে, হুট করে এটা করা উচিত হয়নি।
সামিয়া পড়ছে উচ্চমাধ্যমিকে। কোচিং শেষে সেদিন সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরতে দেরি হয়েছিল। বান্ধবীরা মিলে একটু কেনাকাটা করতে গিয়েছিল। মুঠোফোনে চার্জ না থাকায় বাসায় জানাতে পারেনি। বাসায় ফিরতেই মা রেগে আগুন। বকাবকি করলেন তাকে। সামিয়ার মন খুব খারাপ হলো। রাতে ফেসবুকে নিজের মনের সব রাগ, অভিমান উজাড় করে একটি স্ট্যাটাস দিল, যার মূল কথা: এই পৃথিবীতে কেউ তাকে ভালোবাসে না, সবাই তাকে ভুল বোঝে। তার বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই। এরপরই একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলল সামিয়া। মা-বাবা কিছু জানত না, তার এক বান্ধবী ফেসবুকের স্ট্যাটাস দেখে সামিয়ার মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করল। এরপর যথারীতি হাসপাতালে।
দীপ্ত বা সামিয়ার মতো অনেকে রয়েছে, যারা নিজের আবেগকে সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। আবেগের বশবর্তী হয়ে আগে-পিছে না ভেবে এমন কিছু করে ফেলে, যা তাদের ও তাদের পরিবারের জন্য ক্ষতির কারণ হয়। পরবর্তী সময়ে এ জন্য লজ্জিত বা অনুতপ্ত হলেও অনেক সময় ক্ষতির মাত্রা বেশিও হয়ে যেতে পারে।
যেকোনো বয়সের, যেকোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ আবেগতাড়িত হয়ে এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে। তবে পরিণত বয়সের চাইতে বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই আবেগের তাড়না বেশি থাকে। আমাদের চেতনার যে অংশ অনুভূতি ও সংবেদনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাপেক্ষে যা আমাদের মনের অবস্থার পরিবর্তন করে, শারীরিকভাবেও তার প্রকাশ হয়, সেটা হচ্ছে আবেগ। আবেগ আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিছু আবেগ ইতিবাচক—আনন্দ, ভালোবাসা, সুখ। আবার কিছু নেতিবাচক—ভয়, দুঃখ, রাগ ইত্যাদি। কিছু আবেগ থাকে মিশ্র যেমন—হতাশা, এটি দুঃখ আর বিস্ময়ের মিশ্রণ; হিংসা, যা ভালোবাসা আর রাগের মিশ্রণ।
বেগের সৃষ্টি, প্রকাশভঙ্গি, অপরের আবেগকে ধারণ করার ক্ষমতা একেকজনের একেক রকম। শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, হরমোন, নিউরো ট্রান্সমিটার, মস্তিষ্কের কাজ, ব্যক্তিত্বের ধরন, ছোটবেলার বেড়ে ওঠা ইত্যাদির ওপর মানুষের আবেগ নির্ভর করে। আবেগ কিন্তু মোটেই ফেলনা নয়। পরিপূর্ণ ও সুস্থ মানুষের জীবনে আবেগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যখন বাস্তবতা আর যুক্তিকে ছাপিয়ে আবেগ মানুষকে বশীভূত করে, তখন নানা রকম হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে কেউ কেউ; যা মোটেই শুভ কিছু বয়ে আনে না। বুদ্ধিমান মানুষ আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আইকিউ বা ইন্টেলিজেন্স কোয়াশিয়েন্টের (বুদ্ধ্যাঙ্ক) পাশাপাশি ইকিউ বা ইমোশনাল কোয়াশিয়েন্ট (আবেগাঙ্ক) দিয়েও মানুষের মানসিক সক্ষমতা পরিমাপ করা হয়।
অনেক সময় ব্যক্তিত্বের বিকার, ইমপালস কন্ট্রোল ডিস-অর্ডারসহ বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়। সেসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। আর কারও আবেগ নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করা কখনোই উচিত নয়।
আবেগের পরিমিত ও সঠিক ব্যবহার জীবনকে সফল আর রঙিন করে তুলতে পারে। আবার আবেগের অনিয়ন্ত্রিত প্রকাশ জীবনকে করে তুলতে পারে দুর্বিষহ। নিজের আবেগকে বশে রাখতে পারলে নেতৃত্বসুলভ গুণাবলি আপনার মধ্যে থাকবে, সফলতা বেশি হবে। অপরের আবেগকে ধারণ করতে পারলে আপনি সবার প্রিয় হবেন, ভালোবাসা পাবেন। আবেগকে বাদ দিয়ে নয়, বরং আবেগের লাগাম টেনে ধরেই পৌঁছে যেতে পারেন সাফল্যের শিখরে।
পরিবার, বন্ধুরা যা করতে পারে
পরিবর্তন লক্ষ করুন
কাছের কারও মধ্যে আবেগতাড়িত কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কি না, তা লক্ষ করুন। সব সময় স্বতঃপ্রণোদিত না হয়ে কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে বিনীতভাবে সাহায্যের প্রস্তাব দিন। তবে এমনভাবে সাহায্য করার ইচ্ছা বলতে হবে, যাতে তার আবেগ আরও ফুলে-ফেঁপে না ওঠে।
কিছু আবেগ লুকানো থাক
আপনি কারও আচরণে বা বহিঃপ্রকাশে যে ধরনের আবেগের কথা ভাবছেন, তা সঠিক না-ও হতে পারে। রাগের পেছনে লুকানো থাকতে পারে অভিমান, কৌতুকের পেছনে থাকতে পারে কান্না। তাই পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে আরেকজনের আবেগকে বিচার করুন।
উড়িয়ে দেবেন না
কারও মধ্যে হঠকারী আচরণ, বিশেষ করে নিজের ক্ষতি করার ইচ্ছা দেখলে, আত্মহত্যার প্রবণতা মনে হলে কখনোই সেটাকে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনার বন্ধুর এ ধরনের স্ট্যাটাস-মন্তব্য বা মুঠোফোনের খুদে বার্তাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিন। প্রয়োজনে বন্ধুর পরিবার, চিকিৎসক এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও জানাতে পারেন। আপনার একটি দায়িত্বপূর্ণ পদক্ষেপ একজন মানুষের জীবন বাঁচাতেও পারে।
আবেগকে উসকে দেবেন না
ব্যঙ্গ করে বা ঠাট্টা করে কারও আবেগকে আরও উসকে দেবেন না। আপনি আপনার বন্ধু বা স্বজনের মনের অবস্থা জানেন না।
অভিভাবকেরা সতর্ক ও দায়িত্বশীল হোন
আপনার সন্তানের মধ্যে আবেগজনিত সমস্যা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো সমস্যা আছে কি না, জানার চেষ্টা করুন। তবে গোপন নজরদারির বদলে তার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করুন। তার আবেগকে যে আপনি ধারণ করতে পারবেন, সেটা তাকে বুঝতে দিন, সে যেন আপনার ওপর আস্থা রাখতে পারে এমন সম্পর্ক তৈরি করুন।
প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ
আপনার কাছের মানুষটি যদি তার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে ক্রমাগত ব্যর্থ হতে থাকে, তবে প্রয়োজনে তাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে পারেন।

মন খারাপ হতেই পারে, তা থেকে আবার বেরিেয়ও আসতে হবে।
আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখবেন যেভাবে
আপনার ঝুঁকিগুলো চিনতে শিখুন
কোন কোন পরিস্থিতিতে আপনি বেশি আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন, সেগুলো চিহ্নিত করুন। সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আপনার কর্মকৌশল নির্ধারণ করুন আগে থেকেই। সব সময় যে পরিস্থিতির মোকাবিলায় আপনি সক্ষম হবেন তা নয়, তাই সব ধরনের ফলাফলের জন্য প্রস্তুত থাকুন।
আগের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিন
নিজের জীবনের বা আরেকজনের জীবনের একই ধরনের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিন। হঠকারিতা যে সুফল বয়ে আনে না, তা বারবার নিজেকে বলুন।
সময় নিন
নিজেকে সময় দিন। অপরকেও। হুট করে সিদ্ধান্তে আসবেন না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনিও বদলাতে পারেন, বদলাতে পারে আরেকজন, বদলাতে পারে পরিস্থিতি। তবে একেবারে অদৃষ্টবাদী হবেন না। এই সময়ে নেতার মধ্যে থাকবে পরিকল্পনা আর পরবর্তীতে আপনি কী করতে পারেন তার বৈজ্ঞানিক কিছু সমাধান।
ভাবুন, একান্ত সময় কাটান কিছুক্ষণ
একান্তে নিরালায় বসে কিছুক্ষণ ভাবুন। যে কারণে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছেন, সেটিকে আপনার দিক থেকে ব্যাখ্যা করুন। পরিস্থিতি আর প্রতিপক্ষের দিক থেকে ব্যাখ্যা করুন, একজন নিরপেক্ষ দর্শকের দিক থেকে ব্যাখ্যা করুন।
শরীরের যত্ন
শরীরের যত্ন নিতে ভুলবেন না। যতই আবেগতাড়িত হন না কেন, সবার আগে নিজের পুষ্টি আর পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করুন। কারণ শরীর সুস্থ না থাকলে আপনি স্বচ্ছ চিন্তা করতে পারবেন না, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না।
ঘুম
একটা ছোট্ট ঘুম দিয়ে নিতে পারেন। ঘুম না এলেও বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিন। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঘুমের ওষুধ কখনোই খাবেন না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এড়িয়ে চলুন
আবেগতাড়িত অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এড়িয়ে চলবেন। সেখানে অন্যের স্ট্যাটাস-মন্তব্য আপনাকে আরও আবেগতাড়িত করে ফেলতে পারে আর আবেগের বশবর্তী হয়ে দেওয়া আপনার স্ট্যাটাস-মন্তব্য আপনাকে পরবর্তী সময়ে লজ্জায় ফেলে দিতে পারে।
কাছের কারও সঙ্গে কথা বলুন
খুব কাছের কেউ, হতে পারে পরিবারের সদস্য বা বন্ধু, তাঁর সঙ্গে আপনার মনের আবেগটি ভাগ করে নিন। আপনার রাগ, ক্ষোভ, হতাশা, আনন্দ বা ভালোবাসার কথা তাঁকে বলুন।
অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নয়
আবেগতাড়িত হয়ে নিজের ক্ষতি করা, হাত কাটা, ঘুমের ওষুধ খাওয়া, নেশার দ্রব্য গ্রহণ কখনোই নয়। এগুলো আপনার আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আরও কমিয়ে দেবে। আপনাকে আবেগের ভৃত্যে পরিণত করবে। আপনি বারবার এই ভুল পথে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে থাকবেন।
সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া নয়
কোনো ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। ভাবুন, কারণ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দুর্বল প্রতিক্রিয়া হবে। প্রস্তুতি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখান, এতে আবেগ বশে থাকবে।
বিকল্প চিন্তা করতে শিখুন
একটি ঘটনার নানা ধরনের ব্যাখ্যা হতে পারে। প্রাথমিকভাবে আপনি যা ভাবছেন, সব সময় তা সত্য না-ও হতে পারে। তাই বিকল্প ভাবনার চর্চা করুন। অবসর সময়ে বসে বসে দিনের একটি ঘটনাকে নানা আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করে এই বিকল্প ভাবনার চর্চা করতে পারেন।
মনোযোগ সরিয়ে নিন
অনেক সময় পরিবর্তিত পরিস্থিতি আপনার নিয়ন্ত্রণের একবারে বাইরে চলে গেলে উৎকণ্ঠিত না হয়ে সেটার দিক থেকে অন্যদিকে মনোযোগ সরিয়ে নিন। বই পড়ুন, সিনেমা দেখুন, প্রিয়জনের সঙ্গে কোথাও বেড়িয়ে আসুন।
সামনে তাকান
মনে রাখবেন, আমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত চোখ দুটি সামনে রয়েছে। তাই সব সময় সামনে তাকান। অতীতমুখিতা পরিহার করে সামনের জন্য পরিকল্পনা করুন।
শারীরিক ব্যায়াম
আবেগতাড়িত হয়ে পড়লে বড় করে শ্বাস নিন। পানি পান করুন। দুই মিনিট চোখ বন্ধ করে শরীরের মাংসপেশিগুলো সংকুচিত-প্রসারিত করুন। গলার স্বর নিচে রাখুন।
ব্যর্থতাকে মানতে শিখুন
সফলতার মতো ব্যর্থতাও যে জীবনের একটি অনুষঙ্গ, তা মানার চেষ্টা করুন। ব্যর্থতা মানেই সব শেষ নয়। ব্যর্থতাকে মানতে শিখুন।
আহমেদ হেলাল : সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা। সৌজন্যে: প্রথম আলো