Skip to content

আমার এভোরা ও আসুম্পসাম

সাজিদ বিন দোজা পর্তুগালে পড়ছেন স্থাপত্যবিদ্যা। একদিন বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে দেখেন বাংলা ব্যাকরণের আদিগ্রন্থ। সেই ১৮ শতকে গাজীপুরের কালীগঞ্জে বসে পাদ্রি মানোএল-দা-আসুম্পসাম এটি লিখেছিলেন। পর্তুগালে এভোরা ইন মাই আইজ নামের একটি চিত্রকর্মের প্রদর্শনীও করেছেন সাজিদ

Evora

ছোট্ট শহর এই এভোরা। পর্তুগালের আলিন্তেজো প্রদেশের রাজধানী এটি। লিসবন থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরে। দেয়ালঘেরা এই শহর একটি প্রাচীন জনপদ। মোস্ট এনশিয়েন্ট ইউরোপিয়ান টাউন নেটওয়ার্ট থেকে স্বীকৃতি পেয়েছে শহরটি। খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে রোমানরা শহরটি দখল করে নেয়। সবাই জানে, রোমান শহরগুলোয় মন্দির থাকে, বড় চত্বর থাকে, থাকে রোমান ফোরাম। তবে এভোরায় রোমান জিনিসপত্র এখন আর বেশি টিকে নেই। শুধু টেম্পলো ডায়ানা দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। আর আছে কিছু শহররক্ষা দেয়াল ও তোরণ। রোমানরা চলে যাওয়ার পর আরো অনেক রাজনৈতিক উথাল-পাথালের মধ্য দিয়ে যায় শহরটি। যেমন ৫৮৪ অব্দে ভিসিগথরা এসেছিল। আরো এসেছিল মুররা। ৭১৫ থেকে তারা ছিল প্রায় ৪০০ বছর। তাঁরা ছিল কৃষিজীবী। গড়েছিল মসজিদ। পর্তুগিজরা ১১৬৫ সালে হঠাত্ আক্রমণ চালায় মুরদের ওপর। জিতে নেয় শহরটি। সে থেকে এভোরা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক শহর। ১৯৮৬ সালে শহরটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষণা করে।

Evora3Evora2এই পুরনো শহরে আমি কোনো আগন্তুক নই
একটি বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে এভোরা এখন পুরোপুরি একটি পর্যটন নগরী। বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্যই এ শহরে আমার আগমন। এর নাম ইউনিভার্সিটি অব এভোরা। এটি পর্তুগালের দ্বিতীয় প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। ১৫৫৯ সালে প্রতিষ্ঠা। আমি এখানে পড়ার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৃত্তি পেয়েছি। আমি একজন স্থপতি, দেশে স্থাপত্য বিষয়ে শিক্ষকতা করি ১২ বছর হলো। স্থাপত্যের সঙ্গে ইতিহাসের মামা-ভাগ্নে সম্পর্ক। তাই ইতিহাসও আমার প্রিয় বিষয়। সৌভাগ্য মানি আমি একটি প্রাচীন শহরের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। আমি যে এ শহরটাকে ভালোবেসে ফেলেছি, তা আমাকে দেখেও বোঝা যায়। এর পথে পথে আমি সকাল, বিকেল এমনকি রাতেও হেঁটে বেড়াই। গির্জার ঘণ্টা আমাকে ঘুম থেকে ওঠায়। এই শহরটা আমাকে প্রথম দেশের বাইরে একটি প্রদর্শনী আয়োজনের সুযোগ করে দেয়।

Evora4শহরটির ছবি এঁকে ফেলি
এভোরার ছবি আমি আপনা থেকেই আঁকতে থাকি। ছবি আঁকা আমার শখ। জল রঙে আঁকি, তেল রংও ভালো লাগে। শহরটায় এসে দেখলাম আঁকার আছে অনেক কিছু। মানুষগুলোর কথাই ধরা যাক। তাঁরা পোশাকে-আশাকে ইদানীংকালের কিন্তু মন-মগজ যেন সেসব দিনের। তাঁদের মনে রোমানরা আছে, মুররাও। ঘরবাড়িগুলোর সোঁদা গন্ধ তাঁদের মগজেও লেগে আছে। তাই তাঁদের সঙ্গে মিশলে আমি বুঝি চড়ে বসি কোনো টাইম মেশিনে। দূর-অতীতে ঘুরতে থাকি। এখানকার দেয়ালগুলো ছুঁতেও আমার ভালো লাগে। আমি যেন সেই মজনু যে লায়লার শহরের দেয়াল ধরে দিন পার করে দেয়। আমি এভোরার চত্বরগুলো এঁকেছি, গির্জা এঁকেছি, ফোয়ারার ধারে গল্প করা মানুষ এঁকেছি। আমি এভোরাকে দেখেছি উঁচু দালান থেকে আবার নগর রক্ষা প্রাচীরের নিচে বসে। আমার প্রদর্শনীটির নাম দিয়েছিলাম এভোরা ইন মাই আইজ। প্রদর্শনীটি হয়েছিল ২০১৪ সালের মে মাসে। টাউন হল এট্টিয়ামে।

একটি পুরনো লাইব্রেরি আছে এভোরায়
শুনতাম লাইব্রেরিটি অনেক সমৃদ্ধ। অনেক পুরনো বইপত্র আছে। নাম বিবলিওথেকা ডি এভোরা। সামনে দিয়ে অনেকবার যাওয়া-আসা করেছি। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে সময় গেছে ঢের। স্যারদের লেকচার শুনে বাসায় এসে রান্না করে খেয়েদেয়ে রাত হয়ে যেত। পরদিন আবার গির্জার ঘণ্টা শুনে জেগে উঠতাম। হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এভাবেই চার-পাঁচ মাস গেছে। তারপর একদিন পুরনো কাগজের নিস্তব্ধতার ভেতরে ঢুকে পড়লাম বড় উঁচু খিলানের তলা দিয়ে। আলো আর আঁধারি আমায় ঘিরে ধরল। আমি পুরনো গন্ধ শুঁকতে থাকলাম। যা দেখি তাতেই মন লেগে যায়। জানতাম না তো যে আমাদের ব্যাকরণ বইটি এখানে কোথাও আছে। তবে সেটির লেখক আসুম্পসাম যে পর্তুগিজ ছিলেন, তা জানা ছিল।

Evora6

ডিভিসাও ম্যানাসক্রিপ্ট লেখা আছে দরজায়
যখন আমি ওই বিশাল আর মূর্তিমান জ্ঞানের ভাণ্ডারে নিজের জন্য রেফারেন্স বই খুঁজতে যেতাম, তখন কয়েকজনের সঙ্গে চিনা-পরিচয় হয়। তারাই আমাকে প্রথম ম্যানাসক্রিপ্ট বিভাগের কথা জানায়। তখনো আসুম্পসামের কথা আমার মনে আসেনি। যাইওনি পাঁচ-সাত দিনের ভেতর। তারপর একদিন ঘুরতে ঘুরতেই দরজার গায়ে লেখা দেখি, ডিভিসাও ম্যানাসক্রিপ্ট। দরজা ঠেলে ঢুকে দেখি থরে থরে হাজার হাজার নথি, দলিল, গণিত সমাধান, ড্রইংস, ইলাস্ট্রেশন সাজানো। প্রতিটির আলাদা আলাদা ভাগ আছে। পুরনো দিনগুলো এখানে ভারী হয়ে জমে আছে। অনেক গবেষক এখানে কাজ করেন। ইতিহাসের অজানা অধ্যায় তাঁরা উন্মোচন করেন। দিন আর ক্ষণ খোঁজার কাজ চলছে এখানে নিত্য।

Evora5আসুম্পসামের সঙ্গে দেখা
আমার মাথায় কি যেন একটা বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি। কিছুতেই ব্রেনটাকে বাগে আনতে পারছি না। হঠাত্ই মনে পড়ল…পর্তুগিজ মিশনারি, বাংলায় প্রথম ব্যাকরণ…ব্রিটিশরা আসার আগে। নামটা যেন কী…।

যাহোক আমি লাইন পেয়ে গেলাম। বইটি ছাপা হয়েছিল ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে। পাদ্রির নাম হলো মানোএল-দা-আসুম্পসাম। বাংলা বইগুলোয় এভাবেই লেখা আছে। পাদ্রি পাণ্ডুলিপিটি উত্সর্গ করেছিলেন আর্চবিশপ ডিএফ মিগুয়েলকে (১৬৮৩-১৭৫৯)। মিগুয়েল খুব বিদ্যানুরাগী ছিলেন। কঠিন সময়ে এভোরার হাল ধরেছিলেন। তিনিই ‘ভোকাবুলারিও ইডিওমা বেঙ্গলি এ পর্তুগিজে’ পাণ্ডুলিপিটি লিসবনের এক ছাপাখানা থেকে ছাপানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

পাদ্রি মানোএল তখন ভাওয়াল রাজার এস্টেটে বাস করেন। ধর্মপ্রচার ও সেবার জন্য পাদ্রিদের তখন অনেক পড়াশোনা করতে হতো। তাঁরা যে জায়গায় ধর্ম প্রচার করতে যেতেন, সেখানকার ভাষা ও সংস্কৃতি শিখতেন। পাদ্রি মানোএল চেয়েছিলেন বাংলা শব্দাবলিকে পর্তুগিজ ভাষায় রূপান্তর করতে, যেন পাদ্রিরা স্থানীয় লোকদের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে নিতে পারে। পর্তুগিজরা বাংলায় এসেছিল ষোল শতকে। নাম পেয়েছিল ফিরিঙ্গি। পর্তুগিজদের জাহাজে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে থাকত চিত্রকর, কবি, ভূগোলবিদ ও পাদ্রি। সুলতানদের রাজধানী গৌড় নিয়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ লেখনী আছে। আন্তনিও ডি বৃত্ত (১৫২১), কাস্তেন হাদা ডি লোপেল প্রমুখের নাম পাওয়া যায়।

ওয়েট, আসছি
এসব মনে পড়তেই আমি ব্যাকুল হয়ে ম্যানাসক্রিপ্ট ডিভিশনের নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি অ্যাপ্রন পরা এক সুশ্রী মহিলা। নাম আনা মিরিন্ডা। বাংলা ভাষার ব্যাকরণ কথাটি বলতেই তিনি মুচকি হেসে বললেন, ওয়েট, আসছি। আমার যে কেমন লাগছিল…তা আসলে বর্ণনা করা দুরূহ। যে শহরে পড়তে বসেছি, আমার কাজের জায়গা যে লাইব্রেরি থেকে মাত্র ৫০০ ফুট দূরে, সেই শহর, সেই দালানকোঠার ভেতরে আমার মাতৃভাষার ব্যাকরণ-দলিল যত্নে রক্ষিত আছে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। আমি অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পর আনা এলো। দাস্তানা পরা হাতটি এগিয়ে দিল আমার দিকে। সে হাতে ছিল একটি ছোট আকারের (এ-ফাইভ আকারের চেয়েও ছোট) বই। তবে বইটি আমি স্পর্শ করতে পারব না, শুধু দেখতে পারব। প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো বইটি অতি অমূল্য সম্পদ। আনাকে বললাম, মুহূর্তটি আমার জন্য কত বড়, জানো? সে মাথা নেড়ে বলল, বুঝতে পারছি। বইটি দেখলাম আমি বেশ সময় নিয়ে।

এবার ডকুমেন্ট
ভাওয়াল রাজার এলাকার সেই পর্তুগিজ পাদ্রির জন্য মন শ্রদ্ধায় ভরে গেল। ধন্য তুমি আসুম্পসাম। যেখানেই আছ এখন ভালো থেকো। এরপর আমাকে চমকাতেই বুঝি আনা আরো তিনটি ডকুমেন্ট নিয়ে এলো। তার মধ্যে একটির গায়ে লেখা ক্যাথেক্রিসমো ডক্ট্রিনা ক্রিস্টিয়ানা…ডায়ালোগো এম ইডিওমা বেঙ্গলি এ পর্তুগিজ ১৭৬৩। আমি শক্ত হয়ে চেয়ে রইলাম ইতিহাসের সেই অক্ষরগুলোর দিকে। এই অক্ষরগুলো পাড়ি দিয়েছে সাত সমুদ্র তেরো নদী। এখন ধরা দিয়েছে আমার চোখের সামনে। আনাকে বললাম, আমি এর কপি পেতে পারি? সে আমার এড্রেসটি নিল এবং বলল, গ্রন্থাগারিক অনুমতি দিলে তবে আমাকে পাঠিয়ে দেবেন। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *