Skip to content

আমার যমুনার জল …

jamuna2

সামিউল্যাহ সমরাট
সকাল থেকেই আকাশের মন খারাপ। বৃষ্টি নামি নামি করেও কেন জানি নামছে না। এমনই এক ছুটির দিনের এক সকালে বেরিয়ে পড়লাম যমুনা নদীর সান্নিধ্যে কাটাব বলে। সঙ্গে সদালাপি সোহাগ ভাই। হানিফ পরিবহনের রাজশাহীগামী গাড়িতে দুটি আসন পাওয়া গেল।

রাতে ভালো ঘুম হয়নি। হয়তো সে কারণেই কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সোহাগ ভাইয়ের মৃদু ধাক্কায় ভাঙল সেই ঘুম। চোখ খুলতেই দেখি বঙ্গবন্ধু সেতু অতিক্রম করছি। যমুনায় এখন অনেক পানি। অনেক দিন পরে দিনের আলোয় যমুনা সেতু দেখলাম। রাতের চিরচেনা সেতুটি আজ তাই অন্য রকম হয়েই ধরা দিল আমাদের কাছে।

সিরাজগঞ্জ শহরের প্রবেশমুখ বলে খ্যাত কড্ডার মোড়ে বাস থেকে নামলাম। সিএনজি অটোরিকশা আর শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ভটভটি দাঁড়িয়ে আছে সারি বেঁধে। এখানকার আকাশও মেঘলা। শীতল বাতাস বইছে। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। সিএনজি করেই শহরের পথ ধরলাম। আমাদের অনুমানই সত্যি হলো। কিছু দূর এগোতে না এগোতেই একেবারে বেড়াল-কুকুরের বৃষ্টি। বৃষ্টির ঝাপটায় অর্ধেক ভিজে গেলাম। কড্ডার মোড় থেকে উত্তর দিকে শহরের অবস্থান ১০ কিলোমিটার। আমাদের সিএনজি এসে দাঁড়াল সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশনে ‘মুক্তির সোপানে’র পাশে।

সোহাগ ভাই ঘন ঘন চা খান। এই শহরে তিনি অনেকবার এসেছেন, এখানকার অলিগলিও তাঁর চেনা। জলিল হোটেলে গরুর দুধের চা খেলাম। দুর্দান্ত চা। চায়ের দেশ সিলেটে পাঁচ-পাঁচটি বছর কাটিয়েছি, কিন্তু এমন স্বাদের চা কখনো গলা দিয়ে নামেনি।

মেঘের আড়ালে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। তবে রোদ উঠবে বলে মনে হলো না। বৃষ্টিও থেমে গেছে। এবার রিকশা নিলাম। যমুনার পারে সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধের হার্ড পয়েন্টে যাব। শহরের মুজিব সড়ক দিয়ে এগিয়ে চলেছি। মিনিট দশেক পরেই হার্ড পয়েন্টে এসে গেলাম। পাথরের বড় বড় ব্লকের তৈরি বাঁধ দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে যমুনার বিশাল তীর। বাঁধের ওপরে ছোট ছোট কয়েকটি কৃষ্ণচূড়া দাঁড়িয়ে। ডানে, বাঁয়ে, সামনে তাকিয়ে বিস্তীর্ণ জলরাশিতে দৃষ্টি হারিয়ে গেল। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। ডান দিকে অনেক দূরে বঙ্গবন্ধু সেতু আবছা আবছা চোখে পড়ে। আকাশ এখনো পরিষ্কার হয়নি। নদীর পানি বেশ ঘোলাটে। বাঁধের ওপর থেকে নদীর জল পর্যন্ত বাঁধানো সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে সোজা নিচে নেমে গেলাম। অসাধারণ সব দৃশ্য! যুমনার ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাথরের ব্লকের গায়ে। কিছুক্ষণের জন্য তো মনে হলো যেন সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে আছি। এমন মোহনীয় রূপ অবলোকন করতে অনেকেই এসেছে। সোহাগ ভাই বললেন, আগে এখানে বেশ পালতোলা নৌকা চোখে পড়ত। এখন সেসব প্রায় বিলুপ্তই বলা চলে।

আমরা হাঁটছি একেবারে বাঁধের পাদদেশে নদীর তীর ধরে। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই দেখা গেল কয়েকটি কিশোর বালু নিয়ে খেলছে, আবার কেউ বা লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে নদীর অশান্ত জলে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই থাকি। হঠাৎ করেই যেন ফিরে যাই ফেলে আসা শৈশবে। যমুনা ঘেঁষে আমার নানাবাড়ি। সেখানেই কেটেছে আমার শৈশব। যমুনা তীরের বালুরাশিতে জড়িয়ে আছে ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি। জলে দাপাদাপি করে চোখ লাল করে ঘরে ফিরে খেয়েছি নানির বকুনি। আহ! কী সুখের ছিল সেই দিনগুলো। সোহাগ ভাইয়ের টোকায় বাস্তবে ফিরে আসি।

আবার হাঁটা শুরু হয়। এর মধ্যে হাজির হলো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। তবে বেশিক্ষণ নয়। থেমে গেল হঠাৎ করেই। মাঝবয়সী কয়েকজন জেলে জাল নিয়ে যুমনার জলে নেমেছেন। একজনের জালে ধরা পড়েছে ছোট একটি বোয়াল। বেশ খুশিই মনে হলো তাঁকে। সোহাগ ভাই সেই মাছ কিনতে চাইলেন। কিন্তু ঢাকায় নেওয়ার বিড়ম্বনার কথা ভেবে পিছু হটলেন।

jamuna

হাঁটতে হাঁটতে মতিন সাহেবের ঘাটে এসে পড়েছি। বেশ ব্যস্ত ঘাট এটি। বড় বড় নৌকা নোঙর ফেলেছে এখানে। এখান থেকে সামনে বয়রা চর, রূপসী, কাজিপুর, পূর্ব দিকে টাঙ্গাইলের কিছু এলাকার উদ্দেশ্যে নিয়মিত নৌকা ছেড়ে যায়। বয়রা চর থেকে একটি ঘাসবোঝাই নৌকা এসে ঘাটে দাঁড়াল। কী সুন্দর সব সবুজ ঘাস! চরের বালিয়াড়িতে জন্ম নেওয়া এই ঘাস গবাদি পশুর জন্য খুব উপাদেয়। ঘাট থেকেই ঘাস কিনে নিয়ে যান অনেকে। এই ঘাটেই বসে বাঁশের হাট। আজ অবশ্য হাটের দিন নয়। তার পরও দেখা গেল বাঁশের ভেলা এসে তীরে ভিড়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক বাঁশ একত্র করে ভেলা তৈরি করে এখানে আনা হয়। দারুণ শৈল্পিক সেই ভেলা। এই যমুনার জলেই নির্ভর করত কত মানুষের জীবন-জীবিকা। আবার এই যমুনার জলই কেড়ে নেয় কত জীবন। প্রকৃতি বড়ই বিচিত্র।

খুব ইচ্ছা ছিল নদীর পানিতে রোদের প্রতিফলনের ছবি তোলার। রোদ একবারের জন্যও দেখা গেল না বলে সেটি সম্ভব হলো না; বরং আকাশ আরো কালো হয়ে আসছে। এবার বোধ হয় ঝড় আসবে। বেশ চাঞ্চল্য শুরু হলো ঘাটে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল বিকেল বেলা এখানে ব্যাপক লোকসমাগম হয়। সিরাজগঞ্জের অন্যতম আকর্ষণীয় জায়গা হিসেবে এই হার্ডপয়েন্ট বেশ জনপ্রিয়।

খেয়াল হলো প্রায় এক কিলোমিটারের বেশি পথ হেঁটে ফেলেছি। ঘরে ফেরা দরকার। উঠে এলাম বাঁধে। এখানে একটি পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। বসার জন্য বেশকিছু বেঞ্চ, ফুলের গাছ। যদিও বেঞ্চে কাউকে দেখা গেল না। সবাই তীর ধরেই বসেছে কিংবা হেঁটেই যমুনার রূপ উপভোগ করছে। সোহাগ ভাই সঙ্গে থাকলে কিছু না কিছু বাড়তি পাওনা থাকেই। মতিন সাহেবের ঘাট থেকে জেসি রোড ধরে চলতে চলতে ধানবান্ধি এলাকায় এসে তিনি দেখালেন বিখ্যাত গণিতবিদ যাদব চক্রবর্তীর বাড়ি। সে গল্প না হয় অন্য কোনো একদিনের জন্য তোলা থাকুক। হারানো শৈশবের স্মৃতি গায়ে মেখে সিরাজগঞ্জ শহরে পৌঁছলাম।

কিভাবে যাবেন
ঢাকার মহাখালী ও গাবতলী থেকে সিরাজগঞ্জের গাড়ি ছাড়াও উত্তরবঙ্গগামী যেকোনো গাড়িতে সিরাজগঞ্জের কড্ডার মোড়ে নেমে পড়ুন। ভাড়া তিন শ থেকে সাড়ে তিন শ টাকা। সেখান থেকে সিএনজি অথবা স্থানীয় বাহন ভটভটিতে সিরাজগঞ্জ শহর। ভাড়া জনপতি ২৫ থেকে ৩০ টাকা। শহরের যেকোনো প্রান্ত থেকে ক্লোজার বললেই রিকশাওয়ালা নিয়ে যাবে যমুনার পারে। সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *