সুনামগঞ্জের জাদুকাটা নদীটির সৌন্দর্য অপার। খাসিয়া পাহাড় থেকে নুড়ি পাথর নিয়ে নেমে আসে নিত্য। টাঙুয়ার হাওরকে দিচ্ছে জল। তার আত্মকথা লিখেছেন শামস শামীম
এখন বইপত্রে আমার নাম লেখা হয় জাদুকাটা। আগে নাম ছিল রেণুকা। আমার বাড়ি সুনামগঞ্জ। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে আমি পণাতীর্থ। জনশ্রুতি আছে, সাধক অদ্বৈত আচার্যের মা নাভাদেবি চেয়েছিলেন সপ্তবারিতে পুণ্যস্নান করতে। অদ্বৈত মায়ের ইচ্ছাপুরণে গঙ্গা, যমুনা, নর্মদা, সরস্বতী, কাবেরি ও সিন্ধুর জল মিলিয়েছিলে আমার বুকে। আর তাই আমি পুণ্যতীর্থ।
প্রাচীন বাংলার প্রথম রাজধানী লাউড়ের কথা আপনারা জানেন। লাউড়ের উজানে আছে খাসিয়া পাহাড়। সেই পাহাড়েই আমার জন্ম। পাহাড়টি ভারতের মেঘালয়ের অংশ। মহাভারতের প্রথম অনুবাদক মহাকবি সঞ্জয় আমার বুকেই হেসেখেলে বড় হয়েছে। চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে আমার জলে লাখো মানুষ গা ধোয়। পাপ মোচন করে।
ওই একই সময়ে মুসলমানরাও আসে। তাঁরা আসে শাহ আরেফিনের ওরশে। আমার তীরেই তাঁর মাজার। তিনি তাঁদের কাছে জিন্দাপীর। সে সময় আমার তীরে প্রায় তিন কিলোমিটার জায়গাজুড়ে মেলা বসে। আজ আমি কলম ধরেছি, অনেক কথার সঙ্গে দুঃখের কথাও বলব। গেল শতকের ষাটের দশকে পাহাড়ি ঢলের চাপ আমার ওপর খুব বেশি ছিল। তার আগে আমার দুই তীরের বাসিন্দারা শান্তিতেই ছিল। আমার উৎসমুখ পাহাড়ে ছিল বিশাল বিশাল বাগান। কিন্তু যেই না উজানের বাগান পরিষ্কার করে স্থাপনা তৈরির কাজ শুরু হলো অমনি আমার ওপর চাপ পড়ল বেশি। তারা নাকি এখানে ইউরোনিয়াম পাচ্ছে! যা-ই হোক, আমি চাপ সইতে না পেরে ভাঙতে শুরু করলাম। ১৯৮৮ সালের বন্যায় লাউড়ের গড় ও মাহরাম গ্রাম দুটিকে ভেঙে ফেলতে হলো। গ্রামগুলো আমার বুকে মিশে ভেসে গেল দিগ্বিদিক। আরেকটি শাখা নদীই তৈরি হয়ে গেল আমার প্রবল বেগে। সেই চরপড়া নদীকে তোমরা ডাকো মাহরাম নামে। ভাঙনের মধ্য দিয়ে তোমাদের কিছু উপকারও হলো। পাহাড়ি ঢলে আমার গা বেয়ে নেমে এলো বালু-পাথর। তা দিয়ে তোমরা বানাচ্ছ অট্টালিকা, সেতু, কালভার্ট।
আমাকে দেখতে অনেক পর্যটক ভিড় করেন। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় আমার হরেক রূপ। যদি বারেকের টিলার ওপর বসে আমায় দেখো, তবে তোমার নয়ন ভরে যাবে। রাত-দিন হাজার হাজার বারকি শ্রমিক মুখর করে রাখে আমায়। তাঁরা নূড়ি পাথর তোলে। আমার পানি স্বচ্ছ, অনেকে খেতেও ভালোবাসে। গারো-খাসিয়া কন্যারা কলসি কাঁখে এসে দাঁড়ায় আমার পাড়ে। আমি নয়নভরে দেখি। কেউ কেউ তো গানও শোনায়। আমার উৎসমুখের ঠিক উল্টো দিকে বাংলাদেশের বড়গুপ টিলা। বারেকের টিলা তার কিছু পরেই। প্রায় দেড় শ ফুট উচ্চতার ঘন সবুজ টিলা বড়গুপ। আমার বুক থেকে পাথর তুলে তোমরা জীবিকা উপার্জন করছ, ভালো কথা, তবে বেশি লোভ করো না। তাহলে হয়তো আবার ভাঙব। আমাকে বেশি খুঁড়ে ফেলো না।
এবার শোনো আমার প্রবাহ বৃত্তান্ত। পশ্চিম খাসিয়া পাহাড়ে জন্ম নিয়েছে ওয়াহ রিলাং, ওয়াহ ব্লেই ও ওয়াহ খেনচি—মানে তিনটি নদী। এই ওয়াহ খেনচিই কিন্তু আমি। মেঘালয়ের রানীকর এবং গুমাঘাট হয়ে আমি বাংলাদেশে ঢুকেছি। এখানে লোকজন আমায় ডাকছে জাদুকাটা নামে। মানুষজন বলে, আমার পাড়ে বসে মাছ কুটছিল এক পাহাড়ি মা। ছোট্ট ছেলেও ছিল কাছে। আমার সৌন্দর্যে সে এতই মোহিত ছিল যে মাছের বদলে জাদুধনকে কেটে ফেলে। সেই থেকে এই নাম।
তোমাদের বলে রাখি, আমার জলপ্রবাহের সঠিক পরিমাপ এখনো কেউ করেনি। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন আমাকে নিয়ে কোনো বৈঠক করেনি। অথচ আমি ভারতের মেঘালয় ও বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জলপ্রবাহ। বিশেষ করে ভাটির কৃষি-অর্থনীতিতে আমার বিশেষ অবদান রয়েছে।
বাংলাদেশে প্রবেশের পর আমি তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে একই জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার দুর্লভপুরে সুরমায় মিশেছি। আমার দৈর্ঘ্য ৪০ কি.মি.।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ শীর্ষক প্রকাশনায় সীমান্ত নদী হিসেবে আমার পরিচয় নম্বর ২৫১। আমার প্রস্থ ১০০ মিটার (লাউড়ের গড় এলাকা), গভীরতা আট মিটার (লাউড়ের গড় এলাকা) এবং অববাহিকা ১২৫ বর্গ কি.মি. হিসেবে বর্ণনা করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। জানি, তোমরা আমাকে ভালোবাসো। তাই আমার দেখভালও করবে আশা করি। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ