টেস্ট ক্রিকেটে গতকালই ষোল বছর পার করে ফেলা বাংলাদেশের উন্নয়ন, পথচলা ও প্রস্তুতি নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। তারপরও সাফল্য কিছু আসছে।
বিষয়টা কাছ থেকে সবচেয়ে ভালো দেখছেন নিশ্চয়ই টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। তিনি গতকাল মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের অ্যাকাডেমি মাঠে বসে দীর্ঘ সাক্ষাত্কার দিলেন বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের বাস্তবতা নিয়ে। অনেক অপ্রিয় সত্যি উঠে এলো অধিনায়কের এই সাক্ষাত্কারে।
বিস্তারিত এই সাক্ষাত্কার নিয়েছেন দেবব্রত মুখোপাধ্যায়—
১৬ বছরে কতটা এগোলো বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট?
প্রথমেই আমি বলব, গত এক দেড় বছর আমরা যে ক্রিকেট খেলছি, তাতে উন্নতির একটা ছাপ আছে। কিন্তু এটা আরও পাঁচ-ছয় বছর আগেই হওয়া উচিত ছিল।
আগে কেন হয়নি? কী মনে হয় আপনার…
এর জন্য এটা ওভারঅল প্লানিং লাগে, প্রস্তুতি লাগে। সবচেয়ে বড় কথা খেলতে হয়। আপনি যদি না খেলেন, কিভাবে পারবেন? টেস্ট আমরা খেলেছি ১২ মাস, ১৩ মাস, ১৫ মাস বিরতি দিয়ে দিয়ে। আমি বলি যে, ৫০টা টেস্ট খেলে ফেলার পরও প্রতিটা টেস্ট খেলতে নামার সময় মনে হয় ডেব্যু ম্যাচ। পুরো দলকেই তো আবার নতুন করে শুরু করতে হয়।
মানে, আপনারা যখন উন্নতি শুরু করেন, তখনই বিরতিটা আসে।
হ্যাঁ, যখনই আমরা বুঝতে শুরু করি যে, টেস্টে আমাদের এই করতে হবে, তখনই আবার বিরতি আসে। আবার দীর্ঘকাল পর নতুন করে শুরু করতে হয়। আমরা যারা তিন ফরম্যাটই খেলছি, তারা তবু খেলার মধ্যে থাকছি। কিন্তু যারা স্পেশালিস্ট, মুমিনুল বা শহীদ, এরা তো সেই সুযোগটাও পায় না। ফলে টেস্ট স্পেশালিস্টও তৈরি হচ্ছে না।
খেলোয়াড়দের জন্য তো এই দীর্ঘ বিরতির পর খেলতে নামাটাও খুব চ্যালেঞ্জের?
দীর্ঘ সময় বসে থাকার পর আপনি চারটে ইনিংস পাচ্ছেন। ওখানেই আপনার বেস্টটা করে দেখাতে হবে। কোনো কারণে ওই সময়টায় না পারলে নিজেকে প্রমাণই করতে পারলেন না।
অবস্থাটা মনে হয় বদলাচ্ছে। আগামী বছর বাংলাদেশ ১১টা টেস্ট খেলবে।
হ্যাঁ, এখন থেকে মনে হয় আমরা একটা ভালো সময়ের মধ্যে ঢুকছি। আগামী বছর মনে হয় ১১টা বা এরকম টেস্ট খেলবো আমরা। এই সংখ্যায় যদি আমরা খেলে যেতে পারতাম, আমার ধারণা আজ যে রেজাল্টটা দেখছেন, এটাই পাঁচ বছর আগে দেখতে পেতেন।
দীর্ঘ বিরতি ছাড়া আরেকটা সংকট হলো, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট কাঠামো—উইকেট।
সেটা খুব গুরুত্বপূর্ন জায়গা। প্রতিবছরই এ নিয়ে কথা বলি আমরা। শুরুতে এক দুটো ম্যাচ হয়তো স্পোর্টিং উইকেটে হয়, তারপর আবার ফিরে যাই আগের মতো উইকেটে। দেখেন, আমরা যেমন স্পিনিং উইকেটে খেললাম, তেমন সবসময় পাবো না। পেস বোলার লাগবেই। আর পেস বোলার পেতে হলে তাদের খেলার, বল করার সুযোগ দিতে হবে।
টেস্ট মানের পেস বোলার উঠে না আসার এটাই কী কারণ?
অবশ্যই। আমাদের ঘরোয়া উইকেট যেমন হয়, তাতে দিনশেষে ওই স্পিনাররাই যা একটু প্রভাব ফেলতে পারে। এখন আমাকে যদি বলেন, রাজশাহীর হয়ে যখন খেলতে যাই, আমি তো দলের দিকটা দেখবো। আমি দেখি পেসাররা এখানে ইফেক্টিভ হতে পারছে না। আমি তখন পেসারদের কেনো আনবো। ফলে কী হয়, পেসাররা হঠাত্ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পছন্দের উইকেট পেলেও নিজেদের স্কিলটা দেখাতে পারে না। কারণ ওরা তো অভ্যস্ত না। পুরোনো বলে যে বলটার এক পাশ শাইন রাখতে হবে, এটা প্র্যাকটিস না থাকলে কিভাবে করবে? আপনি বলেন, ঘরোয়া ফার্স্ট ক্লাশ ক্রিকেটে কয়টা পেসার দিনে পনেরো ওভার বল করে।
ব্যাটসম্যানদেরও তো উন্নয়নের পক্ষে উইকেট একটা বাঁধা?
হ্যাঁ। ব্যাটসম্যানরাও যে কন্ডিশন, যে বোলিংয়ের বিপক্ষে খেলছে; আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসে তার চেয়ে অনেক টাফ বোলিং আর উইকেট পাচ্ছে। আমাদের ঘরোয়া প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে দিনে হয়তো পাঁচ বা ছয় ওভার প্রেশার থাকে ব্যাটসম্যানের ওপরে। সেখানে টেস্টে ৯০ ওভার ধরে চলতে থাকে।
এই এতো প্রতিবন্ধকতার পরও বাংলাদেশ কিভাবে উন্নতি করছে? ইংল্যান্ডকে হারাচ্ছে?
মূল ব্যাপার অবশ্যই ইনডিভিজুয়াল ব্রিলিয়ান্স। এর পাশাপাশি আমরা একটা গ্রুপ হিসেবে স্কিল ভিত্তিক অনেক উন্নতি করেছি। এখন আপনি কিছু খেলোয়াড় পিক করতে পারেন, যাদের ওপর ভরসা করতে পারেন। আমাদের এখন প্রধান দুর্বলতা তো খুব অনভিজ্ঞ বোলিং লাইন আপ। মিরাজ বলেন, আর তাসকিন, মুস্তাফিজ; কারোরই বেশি অভিজ্ঞতা নেই। তবে আগামী কিছুকালের মধ্যে এরা ভিন্ন ভিন্ন কন্ডিশনে খেলবে। আশা করি, এরা দ্রুতই অভিজ্ঞ হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ দলের অধিনায়কত্ব করা কতোটা কঠিন?
টাফ। যে কোনো ফরম্যাটেই অধিনায়কত্ব করা কঠিন। আর আমার এই দশ বছরে একটা উপলব্ধি হয়েছে, ফলাফল ভালো হয়ে অধিনায়কের কৃতিত্ব থাকে না। তবে খারাপ হলে পুরো দায় তো অধিনায়কের। ফলে খুব কঠিন কাজটা। কিন্তু আমি দারুণ উপভোগ করি।
ক্যারিয়ার শেষে টেস্টে বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চান?
টেস্টের কথা বললে বাংলাদেশকে অন্তত ৬-৭ নম্বর দল হিসেবে নিয়মিত পারফরম করে যেতে দেখতে চাই। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশ যেন টেস্ট ক্রিকেটে দেশে ও দেশের বাইরে যে কোনো দলকে হারানোর মতো একটা অবস্থায় চলে যেতে পারে।
প্রথম টেস্টের সময় কোথায় ছিলেন, মনে আছে?
বিকেএসপিতে ছিলাম। উম.. হ্যাঁ। ওই বছরই তো বিকেএসপিতে ভর্তি হলাম জুলাই মাসে। নভেম্বরে ওখানে বসেই খেলা দেখেছিলাম।
খেলাটার কথা মনে আছে?
বিস্তারিত কিছু মনে নেই। বুলবুল ভাইয়ের একটা শট মনে আছে। দুর্জয় ভাইয়ের ৬ উইকেট, রাজিন ভাই খুব ভালো একটা ক্যাচ ধরেছিলেন। এরকম টুকরো টুকরো ঘটনা মনে আছে।
তখন বুঝেছিলেন যে, টেস্ট একটা বিরাট ব্যাপার?
একটু পেরেছিলাম। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকেই তো এই পাঁচ দিন ধরে ক্রিকেট খেলা হবে, সেটা খুব আলোচনায় ছিলো। তারপর বাংলাদেশ এতো তাড়াতাড়ি টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে গেলো, সে নিয়ে সবাই খুব এক্সসাইটেড ছিলো।
সেই টেস্ট দলের অধিনায়ক এখন আপনি; দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জয় এলো আপনার হাত ধরে। এমন কল্পনা করতে পেরেছিলেন?
এতো বড় স্বপ্ন ছিলো না। তবে বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার ফলে একটা স্বপ্ন ছিলো যে, জাতীয় দলে খেলবো। টেস্ট, ওয়ানডে; স্বপ্নটা এভাবে ছিলো না মনে হয়। তবে পরের বছরই তো আন্ডার ফিফটিন টিমের হয়ে ইন্ডিয়াতে প্রথম ট্যুরে গেলাম। ফলে ওই সময় থেকে আস্তে আস্তে বিশ্বাস তৈরি হয়েছিলো যে, একবার যখন ন্যাশনাল খেলেছি, তার মানে আমার ভেতরে কিছু একটা আছে।
অধিনায়ক হিসেবে আপনার যেমন অর্জন আছে, সমালোচনাও আছে। সমালোচনাগুলো কিভাবে দেখেন?
আমি বিশ্বাস করি যে, নিজের কাছে সৎ থাকা ও সঠিক থাকাটাই প্রধান ব্যাপার। আমি যদি সঠিক কাজগুলো করি এবং সবাই সর্বোচ্চ পরিশ্রম করি, তারপর ফলাফল যাই হোক, আমি অখুশি হই না। কে কী বললো, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ না। আমি সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ করি নিজের সাথে। আমার সমালোচনা আমি সবচেয়ে বেশি করি এবং ভুল ধরার চেষ্টা করি। একজন অধিনায়ক হিসেবে, ব্যাটসম্যান হিসেবে, উইকেটরক্ষক হিসেবে আমার প্রধান বিবেচ্য হলো- আমি সততার সাথে কাজটা করছি কি না। সেটা করতে পারলে অন্য কারো কথায় কোনো প্রভাব পড়ার কথা নয়।
আপনার কী মনে হয়, চাইলে আরেকটু পপুলার ক্রিকেট তারকা হতে পারতেন?
টু বি অনেস্ট, আমি কখনোই পপুলার হওয়ার জন্য ক্রিকেট খেলিনি এবং সে চেষ্টাও করি না। আমি কখনো এই পরিকল্পনাও করিনি যে, অনেক বড় স্টার হবো বা এখনো নিজেকে সেটা মনেও করি না। আমি বুঝি, আমার কাজ হলো পারফরম করা। আমাদের সে জন্য জাতীয় দলে নেওয়া হয়। আমি কখনো আমার কোনো পারফরম্যান্সে আত্মহারা হই না।
আপনি খুব আবেগী, এটা একটা সমালোচনা।
খারাপ করলে খারাপ লাগে। মানুষ হিসেবেই খারাপ লাগে। সেটা সমালোচনার চেয়ে বেশি নিজের কাছেই খারাপ লাগা। মানুষ হিসেবে ইমোশন তো থাকবেই। ইমোশন ছাড়া উন্নয়ন করাই কঠিন। সেটুকুই।
অধিনায়কত্ব, কিপিং ও ব্যাটিং— তিন ভূমিকা আপনাকে খুব চাপে রাখে বলে অনুমান করা হয়।
দেখেন, আমি যেটা বুঝি, জাতীয় দলের হয়ে আপনি চাইলেই ২০-২৫ বছর ধরে খেলতে পারবেন না। যে কয় বছর পারবেন, সেই সময়ে যতোটা অবদান রাখা যায়, যতভাবে অবদান রাখা যায়, সেটাই তো চাওয়া হওয়া উচিত। আমি তিন ভূমিকায় যদি অবদান রাখতে পারি, সেটা তো আমার জন্য বড় পাওয়া। আমি বরং বাড়তি প্রতিটা দায়িত্ব উপভোগ করি।
বলা হয়, এতে আপনার ব্যাটিংয়ের সেরাটা পাওয়া যায় না। যদিও আপনি এ ক্ষেত্রে কিপিং করেও ডাবল সেঞ্চুরির উদাহরণ দেন।
আপনি চট্টগ্রাম টেস্টের কথা ধরেন। ইংল্যান্ডের সাথে ২০১০ সালের সেই টেস্টে প্রথম ইনিংসে আমি প্রায় দেড়শ ওভার কিপিং করলাম। আমি ৭৯ রান করলাম। আবার দ্বিতীয় ইনিংসে ১১০ ওভার কিপিং করলাম। ব্যাট হাতে নব্বইয়ের ওপরে রান করলাম। উল্টোটাও হয়েছে। ফলে আমার জন্য কখনো লোড মনে হয় না।
তারপরও আপনার গ্রেট হওয়ার যে সম্ভাবনা আছে, সেটার পথে কিপিংকে একটা বাঁধা মনে করেন অনেকে।
এখন আউটকাম দেখে বিবেচনা করার কাজ তো আমার নয়। এটা বিবেচনা করার জন্য ম্যানেজমেন্ট আছেন। তারা যদি মনে করেন যে, কোনো একটা রোল আমার না থাকলে আমার কাছ থেকে অন্য জায়গায় বেশি পাওয়া যাবে, এ সিদ্ধান্ত তারা নেবেন। আমি নিজে কখনোই চাইবো না। কারণ, আমি আগে কিপার, তারপর ব্যাটসম্যান। আমি মনে করি, কিপিং ও ব্যাটিংয়ে আমার এখনো কিছু করার আছে।
এইসব কথা, টুকরো খোচা; কতোটা আহত করে?
খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। আসলে যারা বলার, তারা সারা জীবন বলতেই থাকবে। এ নিয়ে ভাবলে চলবে না। আবার অন্য দিক থেকে ভাবি, আমাকে নিয়ে আলোচনা করার মতো সময়ও মানুষের আছে। হা হা হা…
সমালোচনা থেকে কী কিছু নেন, নাকি পুরোটাই এড়িয়ে যান?
নেওয়ার চেষ্টা করি। আমি জানি যে, আমি মানুষ, ভুল করতেই পারি। ফলে গঠনমূলক সমালোচনা থেকে তো নেওয়ার কিছু থাকেই। আমি এই ধরনের সমালোচনা সবসময় পছন্দই করি। সমালোচনাটা গঠনমূলক হলে সেখান থেকে শেখারও থাকে অনেক কিছু। এতে অনুপ্রেরণাও পাওয়া যায়।
আবার অধিনায়কত্বে আসি। নিজেকে একটু আনলাকি মনে হয়? টেস্টে কখনোই দেশের সেরা বোলারদের এক সাথে পান না। মানে, তুলনামূলক দুর্বল দল নিয়ে খেলতে হয়।
খানিকটা মনে হয়। একটু আনলাকি মনে হয়। মাশরাফি ভাই লাকি যে, মুস্তাফিজ, তাসকিনদের সার্ভিসটা পেয়েছেন। ওরা যেহেতু ফর্মে ছিলো, ওরা টেস্টে খেলতে পারলেও ভালো করতো হয়তো। এটা আসলে আমাদের জাতীয় দলের জন্যই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার ছিলো। সৌজন্যে: দৈনিক ইত্তেফাক