Skip to content

আরব সাগরের তীরে

ড. গুলশান আরা
২৩ মার্চ ২০১৫। মক্কা থেকে জেদ্দা রওয়ানা দিলাম আরব সাগর দেখবো বলে। ট্যাক্সি ভাড়া করা হয়েছে। সঙ্গী হয়ে যাচ্ছে ছোট বোন পত্তানা ভাসনি আল্পনা, জামাই ও তাদের ছোট ছেলে তামীম।

ভাগনি জামাই সোবহান মওলানা আমাদের উমরা হজ্বের মোয়াল্লেম। তিনি গাইড দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। রাস্তার দু’পাশে দোকানপাট। আমরা হেঁটে গেলাম মিসমালা ব্রিজ পর্যন্ত। এখান থেকেই গাড়িতে উঠতে হয়। আমরাও উঠে বসলাম। সুউচ্চ দালান কোঠা, ঐতিহ্যবাহী ভাস্কর্য, সুদৃশ্য মনোরম আইল্যান্ড দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। একসময় দেখতে পেলাম ‘হাওয়া গেট’। তেমন কোন কারুকার্য নেই অথচ হালকা হলুদ রঙের হাওয়া গেট—দেখতে অপরূপ। আদি মাতা হাওয়া এখান দিয়েই হয়তো প্রবেশ করেছিলেন মক্কা নগরে। সেই স্মৃতিতে হাওয়া গেট। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পাওয়া গেল মা হাওয়ার গোরস্থান। ড্রাইভারসহ পুরুষরা নেমে গেলেন কবর জিয়ারত করতে, মা হাওয়ার কবর জিয়ারতে। আমরা গাড়িতে বসেই দুই রাকাত নামাজ পড়ে নিলাম।

Arab-Sea2

আবার যাত্রা শুরু। ট্যাক্সি ড্রাইভার বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের ছেলে। বয়সে নবীন হলেও তার চিন্তা ভাবনায় গভীরতা আছে। নানা প্রসঙ্গে আলাপ করছে। এক সময় বললো—বাংলাদেশ থেকে মেয়েরা যাতে এদেশে গৃহকর্মী হয়ে না আসে সেজন্য তারা মিটিং-মিছিল করেছে। কারণ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিরিয়া, মিসরের অবস্থা হবে—বাংলাদেশের মান থাকবে না।

চমত্কার সব স্থাপনা আরবদের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন আমলের দ্রব্যাদি সড়কদ্বীপের মাঝখানে সুদৃশ্যভাবে রাখা। সুরাই, চিকন কাঁধযুক্ত মোটা পেটের হাঁড়ি কাত হয়ে শুয়ে যেন আরাম করছে। মহাসড়কের দু’দিকেই মনোরম দৃশ্যরাজি। কোনটার থেকে কোনটা কম নয়। এমটি টানেল পাড় হতে হলো—ইসলামিক ঐতিহ্যের কৌনিক আর্টে সাজানো দু’পাশের দেয়াল।

একটি দৃশ্য খুবই অপূর্ব লাগলো। সৌদি আরবের বিশাল আকৃতির জাতীয় পতাকা বাতাসে ঢেউ খেলে উড়ছে। মধ্যখানে যে তরবারি ওটি বাতাসের দোলে এমন দেখাচ্ছ যেন সাগরের কোন অচেনা প্রাণি সাঁতার কেটে এগিয়ে চলেছে। কানে এলো সাগরের গর্জন, বাতাসের শাঁ শাঁ গান।

যেতে যেতে হাতের বামে চোখে পড়লো সাগর। আরব সাগর। যার কথা শুনেছি গানে, গল্পে, কবিতায়। মরমী কবি লিখেছেন—‘আরব সাগর পাড়ি দেবো নাইকো আমার কড়ি। পানির সাথে লইয়া যাওরে আমার চোখের পানি… আমার সালাম পৌঁছে দিও মদীনার বাদশায়’ ইত্যাদি। কাজী নজরুল ইসলাম আরব সাগরের মনোহরণ বর্ণনা দিয়েছেন ‘বাঁধন হারা’ পত্রউপন্যাসে। করাচি বুড়ি সমস্ত রাত্তির এই সমুদ্দুরের ধারে গাছপালা শূন্য ফাঁকা প্রান্তরটায় দাঁড়িয়ে থুরু থুরু করে কেঁপেছে….।

All-Tour

আরব সাগরের জেদ্দা পাড়ও গাছপালা শূন্য। ভেবেছিলাম আমাদের বঙ্গোপসাগরের মত সাগর সৈকত বালুকাময় হবে। আসলে তা নয়। হয়তো ভঙ্গুর সাগর তীরে—সেজন্য বড় বড় পাথর ফেলে আছড়ে পড়া ঢেউ আটকে রাখা হয়েছে। যেখানে সাগর এগিয়ে পিছিয়ে গেছে সেখানে পাথুরে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা। ছিমছাম সাগর তীর দেখতে ভালই লাগে। পাশেই পায়ে হাঁটার পাকা রাস্তা। মাঝে মাঝে আফ্রিকান মহিলারা নানারকম খেলনা সামগ্রী নিয়ে বসে আছেন। উন্নতমানের খেলনা নয় বিধায় ক্রেতাও কম। পর্যটকরা হেঁটে হেঁটে পথ পেরিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ গাড়ি।

বোধকরি সাগর ভরা মাছ। আঁশটে গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। পানি কিছুটা কালচে মনে হলেও দুধের মত শুভ্রতা মাথায় মেখে ঢেউ ছুটে এসে তীরে আঘাত করে ঢেউ-এর সাথে আসে ছোট মাছ, পাথরের উপর উঠে যেন নাচতে থাকে। অপূর্ব যে ঢেউ-এর নাচন-জলকণা উড়ে এসে বৃষ্টির মত ভিজিয়ে দেয়।

এই অনবদ্য দৃশ্য আরো কাছ থেকে অনুভব করতে তীর থেকে সাগরের পানির মধ্যে পিলার দিয়ে রাস্তার মত করা হয়েছে। অনেকে সেখানে দাঁড়িয়ে গায়ে মাখছে সাগর জলের ঝাপটা বাতাস।

কক্সবাজারে সাগরে নেমে আমরা যেমন জলকেলিতে বিভোর হই এখানে তেমন দৃশ্য নেই। একটিমাত্র লোককে দেখলাম ছোট একটি ছেলে নিয়ে সাগরের হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে আছেন।

সেদিন ছিল সোমবার। পাত্তানা রোজা রেখেছে। সূর্য অস্ত পর্যন্ত সাগর তীরে হাঁটছি। সামনে মসজিদ—এ মসজিদও অর্ধেক মাটিতে অর্থাত্ সাগরতীরে বাকি অর্ধেক সাগর বক্ষে।

সূর্য অস্ত যাচ্ছে। দেখলাম বঙ্গোপসাগরে যেমন রং ছড়াতে ছড়াতে সূর্য ডিমের আকার ধারণ করে সহসা ঝুপ করে ডুব দেয় সাগরে—এখানে রঙের ছড়াছড়ি তেমন নেই। সামান্য হলুদ আভা পানিতে দোল খেলে। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। জাহাজ নেই, নৌকা নেই, কিছু নেই।

Arab-Sea

সাগরপাড়ে এমন চমত্কার সুউচ্চ বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছে যে তার উপরে হেলিকাপ্টার পর্যন্ত নামতে পারে। মাঝে মাঝে সাগরের পানি আটকে কৃত্রিম জলাধার বানানো হয়েছে, সৌন্দর্য বাড়াতে দেয়া হয়েছে বাদশাহজাদির সাজ।

পাত্তানার ইফতার শেষে সাগর পাড়ের মসজিদে নামাজ পড়ে বাইরে এসে দেখি আরব সাগর আলোর মালা গলায় দিয়ে রানীর গরিমায় দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো দিনের চেয়েও তার রাতের রূপ কম না।

সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে একেবারে ঢালুতে সাগরের কাছাকাছি এক পর্যটক পরিবার বসে আছে, মুগ্ধ নয়নে দেখছে আরব সাগরের অপরূপ রূপ। তাদের সঙ্গে খাঁচায় বন্দী এক ধূসর রঙের টিয়া সবার দৃষ্টি কাড়ছে।

এবার ফেরার পালা। নয়ন মন ধন্য করে ফিরছি মক্কার উদ্দেশ্যে। মনে হচ্ছে কোন মায়ার ধনকে যেন ফেলে যাচ্ছি। সামনে চোখ ফেরাতেই দেখি মক্কা টাওয়ারের মায়াবি সবুজ আলো ধ্রুবতারার মত কাছে ডাকছে। লেখক : নজরুল গবেষক। সূত্র : ইত্তেফাক

Advertisement

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *