মমতাজ উদ্দিন আহমদ
বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের শ্যামল আঙ্গিনায় পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। পুরো উপজেলাকে সবুজ পর্বতরাজি, পাহাড়ি ঝর্ণা ও নানা নান্দনিক দৃশ্য ঘিরে রেখেছে। এখানে রয়েছে ঐতিহাসিক আলীর সুড়ঙ্গ, রূপমুহুরী ঝর্ণা, ডিম পাহাড়, মারাংইংতং জাদী আর তামাংঝিরি জলপ্রোপাত। পাহাড়ের বুকে এসব নয়নাভিরাম আল্পনা দেখে মুগ্ধ হন পর্যটকেরা।
রূপমুহুরী ঝর্ণা
আলীকদম উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে পোয়ামুহুরীতে মাতামুহুরী নদীর তীর ঘেঁষে রূপমুহুরী ঝর্ণার অবস্থান।
প্রাকৃতিক এ ঝর্ণাটি দেখতে পোয়ামুহুরী বাজার থেকে ৫ মিনিট হাঁটতে হয়। পোয়ামুহুরীতে দুইটি ঝর্ণা রয়েছে। সাধারণত পোয়ামুহুরী বাজারসংলগ্ন ঝর্ণাটিকে রূপমুহুরী এবং পোয়ামুহুরী ঝিরিমুখ সামনের ঝর্ণা পোয়ামুহুরী ঝর্ণা নামে পরিচিতি। ঝর্ণা দুইটির দূরত্ব এক-দেড় কিলোমিটার। তবে রূপমুহুরী ঝর্ণার সৌন্দর্য বেশি। ঝম্ ঝম্ কল্ কল্ রবে প্রায় ২০০ ফুট উঁচু থেকে পড়ছে স্বচ্ছ পানির ধারা। আর প্রায় ১৫০ ফুট উঁচু থেকে ফেনা তুলে নাচতে নাচতে উপচে পড়ছে পোয়ামুহুরী ঝর্ণার পানি। এ দুইটি প্রাকৃতিক ঝর্ণার শেষ গন্তব্য কুলুকুলু রবে বয়ে চলা খরস্রোতা মাতামুহুরীর স্নিগ্ধ গভীর স্রোত।
সরেজমিন দেখা যায়, রূপমুহুরী ঝর্ণার পানি সবুজের আস্তর কেটে গড়িয়ে পড়ছে পাথুরে ভূমিতে। উঁচু পাহাড় থেকে ঝরে পড়া পানি পাথরের আঘাতে কুণ্ডলী পাকিয়ে প্রতিনিয়ত এক মনোমুগ্ধকর শৈল্পিক দৃশ্য সৃষ্টি করছে। বৃত্তকারে পাথরে ঘেরা পাহাড়ের বুকে এক ঝর্ণাদেবী যেন চঞ্চল প্রবাহে নিজের বীরত্ব প্রকাশ করছে অহর্নিশ। সূর্যের কিরণ যখন ঝর্ণার বাষ্পীয় বিন্দুতে পড়ে তখন তৈরি হয় রঙধনু। এক পাহাড়ি রানী যেন অবিরাম কেঁদে স্বচ্ছ নীরে ভাসছে অনন্ত কোনো বিরহ বেদনায়! রূপমুহুরীর ঝর্ণার পানিতে গোসল করে পর্যটকেরা আনন্দ লাভ করেন। দুর্গম পাহাড়ি জনপদে অবস্থিত এ ঝর্ণা দর্শনই একটা বিরাট অ্যাডভেঞ্চার। সবুজ পাহাড়ের কোলে লোকচক্ষুর আড়ালে এ ঝর্ণাটি পর্যটকদের কাছে এখনো অপরিচিতই থেকে গেছে। তবে সম্প্রতি বছরগুলোতে কিছু পর্যটক ছুটে আসছেন এই প্রাকৃতিক ঝর্ণার অপরূপ শোভা দেখতে।
যেভাবে যেতে হবে
আলীকদম বাস স্টেশন থেকে রিকশা কিংবা টমটমে মাতামুহুরী ব্রিজে আসতে হবে। ইঞ্জিনবোট ও স্পিডবোটে মাতামুহুরী নদীপথে পোয়ামুহুরী বাজার ঘাটে নামতে হবে। বর্ষায় ইঞ্জিনবোট ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা ও শুষ্ক মওসুমে স্পিডবোট ভাড়া ৪০০-৫০০ টাকা। রিজার্ভ ইঞ্জিনবোট কিংবা স্পিডবোটে ভাড়া পাঁচ-ছয় হাজার টাকা।
আলীর সুড়ঙ্গ
ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান হিসেবে আলীর সুড়ঙ্গ এখনো এলাকাবাসীর মধ্যে আলোচিত হয়ে আছে। আলীর সুড়ঙ্গকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে নানা রূপকথা, কিংবদন্তি ও কল্পকাহিনী। শুষ্ক মওসুমে অসংখ্য দর্শনার্থী ভিড় জমান এ সুড়ঙ্গে। সুড়ঙ্গের গিরিপথ দুর্গম ও বন্ধুর। উল্লেখ্য, চীনের পরিব্রাজক হিওয়েন সাং বলেছেন, ‘নদী নাব্য জলাভূমির এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক নিদর্শনগুলো অতি অল্প সময়েই হারিয়ে যায়।’ চীনের এ পরিব্রাজকের উক্তিটি আলীর সুড়ঙ্গের বেলায় প্রযোজ্য।
ডিম পাহাড়
আলীকদম উপজেলা সদর থেকে পাকা সড়ক গিয়ে মিশেছে ডিম পাহাড়ের পাদদেশে! অন্তর্বিহীন মৌন নিস্তব্ধ সৌন্দর্য। চার পাশে গ্রন্থিল পাহাড়িকা। আকাশ আর পাহাড় মিলেমিশে একাকার। বর্ষায় মেঘের ভেলা লুকোচুরি খেলা করে ডিম পাহাড়ের চূড়ায়।
সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৭০০ ফুট উচ্চতায় ডিম পাহাড়ের অবস্থান। সম্প্রতি সেনাবাহিনী কর্তৃক আলীকদম-থানচি সড়ক নির্মাণের ফলে ডিম পাহাড় স্থানীয়দের নজরে আসে। ডিম পাহাড়কে ঘিরে স্থানীয় প্রশাসনের পর্যটনস্পট গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে।
ডিম পাহাড়ের পাশের রাস্তা থেকে দেখা যায় থানচি উপজেলার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
মারাংইংতং জাদী
যেখানে পাহাড়ের বুকে হেলান দিয়ে আকাশ ঘুমায় সে ধরনের এক কাব্যিক মনোরম পরিবেশে মারাইংতং জাদীর অবস্থান। আলীকদম-লামা উপজেলার সীমান্তবর্তী প্রায় ২০০০ ফুট উঁচু পাহাড় চূড়ায় মারাইংতং স্থানটির অবস্থান। এ পাহাড় চূড়া থেকে প্রকৃতি আর নীলাকাশের সাথে যেকোনো পর্যটক এককার হয়ে যেতে পারেন। পাহাড় চূড়া থেকে সোজা পশ্চিমে বিশ্বের বৃহত্তম বেলাভূমি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত অনায়াসে দেখা যায়। তা ছাড়া সেখানে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্যাদি অবলোকনের পাশাপাশি এক কাব্যিক পরিবেশের ছন্দময় প্রতিধ্বনী শোনা যায়। আলীকদম উপজেলা সদর থেকে ১৬-১৭ কিলোমিটার দূরে মারাইংতং জাদীর অবস্থান। আলীকদম-লামা-ফাঁসিয়াখালী সড়কের রেপারপাড়ী এলাকা থেকে পাহাড় চূড়ায় যাওয়ার রাস্তা আছে। রেপারপাড়ী থেকে দণিমুখী ইটের রাস্তা দিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে পাহাড় চূড়ায় ওঠার জন্য রয়েছে কাচা মাটির রাস্তা।
এই পাহাড় চূড়াকে সর্বপ্রথম বৌদ্ধরা দৃশ্যপটে নিয়ে আসেন। ১৯৯২ সালে ১০ একর পাহাড়কে মহইদই বৌদ্ধ ধাম্মা জেদী নামে একটি কমিটির মাধ্যমে বন্দোবস্তি নেয়া হয়। ১৯৯৩ সালে সেখানে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্থায়নে ৬´৪ হাত আয়তকার একটি বৌদ্ধ মূর্তি স্থাপন করা হয়। এ পাহাড় চূড়ায় স্থাপিত বৌদ্ধ জাদীকে ঘিরে প্রতি বছর মারাইংতংমেলা নামের একটি উৎসব পালিত হয়ে থাকে। এ উৎসবে পাশের দেশ থেকেও অসংখ্য বৌদ্ধ ভিু ও দায়ক/দায়িকার সমাগম ঘটে। প্রতি বছর তিন দিনব্যাপী এ সেখানে বৌদ্ধমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়াও অসংখ্য পাহাড়ি ঝর্ণা-নির্ঝরণী এ উপজেলাকে করেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত। এখানকার তৈন খাল সংলগ্ন তামাং ঝিরি ঝর্ণা ও পালংখ্যাং জলপ্রোপাত এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে করেছে রূপময়, যা দর্শক চিত্তে শিহরণ সৃষ্টি করবে অনায়াসে।
শৈল সমারোহে সুষমামণ্ডিত পার্বত্য আলীকদমে পর্যটন স্পটের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। মারাংতং পাহাড় চূড়াকে পর্যটনের অপার ত্রে হিসেবে এর উন্নয়ন ও সড়ক সংস্কার করা হলে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের যাতায়াতের অসুবিধা লাঘব হবে। পাশাপাশি আলীর সুড়ঙ্গে যাতায়াতের জন্য তৈনখাল এলাকায় একটি ঝুলন্ত ব্রিজ নির্মাণ করা প্রয়োজন বলে স্থানীয়রা জানান। সূত্র : নয়া দিগন্ত