ফখরুল আবেদীন
ছোটবেলায় আমার বাবা আমাকে কোনো দিন কক্সবাজার নিয়ে যাননি। কক্সবাজার বলে যে কোনো জায়গা আছে, তা–ই জেনেছি অনেক পরে। বাবা আমাদের দাদাবাড়ি নিয়ে যেতেন। লঞ্চের রেলিং ধরে আমাদের চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে ইলিশ মাছ ধরা দেখাতেন। পাশাপাশি বয়ে চলা পদ্মার স্বচ্ছ আর মেঘনা নদীর ঘোলা জল দেখিয়ে আমাদের অবাক করে দিতেন।
আমি এখন অনেক বড় হয়েছি, কিন্তু আজও আমি লঞ্চের রেলিং ধরে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকি। ইলিশ ধরা জেলেনৌকা খুঁজি। পদ্মা–মেঘনার দুই রঙের পানি দেখে আজও ছেলেমানুষি উত্তেজনায় ভুগি। বাবার মুখটা মনে পড়ে। আমার চোখের অবাক দৃষ্টি দেখে তাঁর খুশি হওয়া মুখটা মনে পড়ে।
আমার মেয়েটা তখন অনেক ছোট। রাতের বাসে কক্সবাজার যাচ্ছি। মেয়ে একটু পরপর জিজ্ঞেস করে, বাবা, আমরা এখন কোথায়? কুমিল্লা। কুমিল্লা কি বাংলাদেশে? হু।
আবার একটু পর, বাবা, আমরা কি এখনো বাংলাদেশে? হু। আমরা কখন কক্সবাজার দেশে যাব? সকাল হলেই চলে যাব।
বেচারি বাবার ঊরুর ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে চোখ খুলেই সে সাগর দেখে। চিৎকার করে বলে—বাবা দেখো, বাবা দেখো কত্তগুলো পানি। মেয়ের খুশি দেখে আমার মন ভরে যায়।
এই আনন্দ আর এই আজীবন জমিয়ে রাখা স্মৃতি পেতে বেড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
বেড়ানোর কথা উঠলেই প্রথম যে প্রশ্নাটা মাথায় আসে তা হলো কোথায় যাব? ইউরোপ নাকি আমেরিকা? সিঙ্গাপুর নাকি থাইল্যান্ড? নেপাল নাকি ভুটান? আমি বলি আগে নিজের দেশ ঘুরুন, তারপর নাহয় অন্য দেশে গেলেন। পরের প্রশ্ন—দেশে কি বেড়ানোর জায়গা আছে? বলি, আছে মানে? এক জীবনে ঘুরে শেষ করা যাবে না আমাদের দেশ। চলুন বাংলাদেশের দক্ষিণের শেষ ভূখণ্ড সেন্ট মার্টিন দ্বীপ দিয়ে শুরু করি।
বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন বা নারিকেল জিঞ্জিরা দেখতে গেলেই পথিমধ্যে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার দেখা হয়ে যায়। মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ বেলাভূমি সাগরের আলতো ঢেউয়ে ভিজে যায় বারবার। আপনিও পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভিজুন এর ফেনিল জলে। তীর ধরে জিপে চড়ে বেড়িয়ে আসুন হিমছড়ি, নিরালা ইনানি, স্পিড বোটে করে বেড়িয়ে আসুন মহেশখালী দ্বীপ, নয়তো চলে যান কুতুবদিয়া। দেখে আসুন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উইন্ডমিল। ঘুরে বেড়ান ঝিনুক মার্কেট, রামুর বৌদ্ধমন্দির। এ ছাড়া শহরের কেন্দ্রস্থলে বার্মিজ মার্কেট তো আছেই। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই সৈকত শহরে দুটো দিন কীভাবে কেটে যাবে টেরও পাবেন না।
কক্সবাজারের পাট চুকিয়ে এক ভোরে বেরিয়ে পড়ুন সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে। তবে আপনার প্রথম গন্তব্য হবে কক্সবাজার থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরের টেকনাফ। যেখানে অপেক্ষা করবে সাগরপাড়ি জাহাজ। সাধারণত নয়টা থেকে দশটার মধ্যে ছাড়ে। বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের সীমানা নির্দেশকারী নাফ নদী আর বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে জাহাজগুলো দুই আড়াই ঘণ্টায় আপনাকে নিয়ে যাবে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। নারকেলগাছে ছাওয়া দ্বীপটি আপনার নজর কেড়ে নেবে প্রথম দর্শনেই। দ্বীপে নেমে তৃষ্ণা জুড়ান মিষ্টি ডাবের পানিতে। তারপর বেরিয়ে পড়ুন ঠিকানার উদ্দেশে। এখানকার প্রায় বেশির ভাগ হোটেলই সাগর মুখ করে তৈরি। ফলে যেখানেই থাকুন না কেন সাগর আপনার দৃষ্টিসীমা ছেড়ে যাবে না কখনোই।
রাতের আঁধারে মুখোমুখি হোন সাগরের। দেখুন ঢেউগুলো কেমন ফসফরাস জ্বালিয়ে ভেঙে পড়ে তীরে। রাতের আকাশকে আবিষ্কার করুন নতুন করে। এখানে মাছের বাজারটা বসে জেটির ধারে সকাল সকাল। চাইলে নিজেরাই বাজার করুন পছন্দমতো। যদি এক–দেড় কিলোগ্রামের লবস্টার পান তবে তো কথাই নেই। দ্বীপটাকে নিজের মতো করে দেখতে হাঁটাপথে ছেঁড়াদ্বীপ যাওয়ার বিকল্প নেই। এক পার ধরে গিয়ে অন্য পার হয়ে ফিরে আসতে সময় লাগবে চার-পাঁচ ঘণ্টা। তবে ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে গেলে সে ভিন্ন হিসাব।
চলুন এবার বান্দরবান ঘুরে আসি। চট্টগ্রাম থেকে ৯২ কিলোমিটার দূরে একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য বান্দরবান। এখানে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ নিই। আছে স্বচ্ছ টলটলে জলের সাঙ্গু নদী, আছে বগা লেক, রুমা বাজার, চিম্বুক পাহাড় আর নয়নাভিরাম নীলগিরি পাহাড়। আছে নীলাচল পাহাড়, আছে স্বর্ণমন্দির আর আছে স্থানীয় আদিবাসীদের আতিথেয়তা। যদি অ্যাডভেঞ্জার পছন্দ করেন, তবে দেখে আসুন ঋজুক ঝরনা, রেমাক্রি হয়ে চলে যান নাফাখুম জলপ্রপাত দেখতে।
রাঙামাটি নামটার মধ্যেই একটা অন্য রকমের জাদু আছে। আর সেই জাদুর টানে প্রতিবছর হাজারো পর্যটক ভিড় করে সেখানে। ঘন সবুজ পাহাড়ি বনাঞ্চল, নয়নাভিরাম কাপ্তাই হ্রদের সঙ্গে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও তাদের জীবনধারা রাঙামাটিকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। রাঙামাটি ভ্রমণে ঘুরে দেখতে পারেন আদিবাসী জাদুঘর, কাপ্তাই হ্রদের ওপর ঝুলন্ত সেতু, রাজবন বিহার বৌদ্ধমন্দির। নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ান কাপ্তাই হ্রদে। দেখে নিন চাকমা রাজার বাড়ি, শুভলং ঝরনা। তবে হ্রদের মাঝে দ্বীপের ওপর পেডা টিং টিং নামের বেস্তোরাঁয় এক বেলা খেতে ভুলবেন না। কাপ্তাই লেকের টাটকা মাছের স্বাদ মনে থাকবে কত দিন।
পার্বত্য তিন জেলার দুটোই আপনি ঘুর ফেললেন, তখন রইল বাকি খাগড়াছড়ি। এ শহরটা শুধু হেঁটে ঘুরে বেড়াতেও ভালো আগে। যদি কিছুক্ষণের জন্য গুহাবাসী হতে মন চায় তবে চলে যান আলুটিলা গুহায়। আপনার এক হাতে থাকবে মশাল আর আরেক হাতে সন্তানের হাত। অন্ধকারের গা–ছমছমে পরিবেশে আপনার সন্তান শক্ত করে ধরে থাকবে আপনার হাত। ভাবা যায়? এ ছাড়া রয়েছে বৌদ্ধবিহার আর ঝরনা। তবে হালের সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো এর সাজেক ভ্যালি। এক রাত থাকতেই হবে এখানে। থাকার জন্য সেনাবাহিনীর বিসোর্ট ছাড়াও স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি তো রয়েছেই।
এবার দলবেঁধে যাওয়া যাক সুন্দরবন। ঢাকা থেকে চলে যান খুলনা বা মংলা। পথে দেখে নিতে পারেন বাগেরহাটের খান জাহান আলীর মাজার আর এর বিশাল দিঘি। দেখে নিন ষাটগুম্বুজ মসজিদ। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় দেখে নিতে পারেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি আর এর সংলগ্ন জাদুঘর। শান্ত–সুন্দর এর পরিবেশ আপনার ভালো লাগবে।
বাংলাদেশের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন। চমৎকার জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই বনের ঘন সবুজ বনাঞ্চলের ছায়ায় ঘুরে বেড়ায় বাঙালির অহংকার রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ আরও অনেক প্রাণী। ভোরের প্রথম আলোয় নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ান সরু খালের জলে, উপভোগ করুন ঘুমভাঙা জঙ্গলটাকে। সারাটা দিন কাটিয়ে দিন লঞ্চে করে নদী বেড়িয়ে, জেলেপল্লিতে ঘুরেফিরে। রাতে নাহয় নৌকা নিয়ে আরেকবার বেরিয়ে পড়লেন সরু খালে অ্যাডভেঞ্জারের সন্ধানে। বিস্তীর্ণ সাগরসৈকতে হৈ-হুল্লোড় করে সমুদ্রস্নানটাই বা বাদ যাবে কেন?
চলে যেতে পারেন সিলেটের দিকে। পুরো সিলেট বিভাগে রয়েছে অসংখ্য বেড়ানোর স্থান। তবে চা–বাগানের রাজ্য শ্রীমঙ্গলের জুড়ি নেই। বিস্তীর্ণ চা–বাগানের গাঢ় সবুজ প্রকৃতি মন কেড়ে নেবে মুহূর্তেই। শ্রীমঙ্গলে দেখতে পারেন লাউয়াছড়া অভয়ারণ্য। আবার শীতের পাখি দেখতে যাওয়া যায় বাইক্কার বিল। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় হলে দেখে আসুন হামহাম ঝরনা।
সিলেট শহরটাকে কেন্দ্র করে দেখে নিতে পারেন বিছানাকান্দি, জাফলং বা রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট। বিছানাকান্দির অগভীর শীতল জল যেমন গা জুড়িয়ে দেবে, অন্য দিকে রাতারগুলোর পানির ওপরে জেগে থাকা বন দেখে শিহরিত হবেন। এর বাইরে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত তো সেই ছোটবেলার পাঠ্যপুস্তক থেকেই আমাদের মনে গেঁথে আছে। উফ, শুধু এই কয়েকটা জায়গার কথা লিখতেই বরাদ্দকৃত স্পেস শেষ হয়ে গেল। এখনো তো নিঝুম দ্বীপ, কুয়াকাটা, উত্তরবঙ্গসহ বাকি বাংলাদেশের কথা তো বলাই হলো না। সে নাহয় অন্য দিন বলা যাবে। শুধু এটুকুই বলব, চলুন বেরিয়ে পড়ি। নিজের সন্তানকে নিজের দেশ দেখাই। নিজের দেশের মানুষ দেখাই। দেশকে ভালোবাসতে শেখাই, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে শেখাই। আসুন, সুখস্মৃতি সংগ্রহ করি। সূত্র : প্রথম আলো