Skip to content

ইতিহাসের বাঁকে পালমিরা শহর

সর্বশেষ সংবাদ হলো সিরিয়ার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহর পালমিরা দখল করে নিয়েছে ইসলামিক স্টেট নামের একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠি। ইরাকের রামাদি শহর দখলের পর সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের এই শহরটি দখল করে নেয় গোষ্ঠিটি। এর আগে যতগুলো স্থান এই গোষ্ঠিটি দখল করেছিল সেই স্থানগুলোর সকল ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস করে দেয় হয়। তাই পালমিরা দখলের আগেই আন্তর্জাতিক বিশ্ব এই শহরটির অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কারণ এই শহরটি ধ্বংস হয়ে গেলে প্রথমত পৃথিবী হারাবে একটি প্রাচীন শহর এবং মানুষ হারাবে ইতিহাসের অন্যতম একটি অধ্যায়। গোটা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশাল অঞ্চলের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পালমিরার ইতিহাস।

PALMIRA2

‘পালমিরা’ শব্দটি মূলত গ্রিক শব্দ, যাকে আরামিক ভাষায় বলা হতো ‘তেদমুরতা’, আরবি ও হিব্রুতে তাদমোর। আরামিক ভাষায় তাদমোর বলা হয় ‘তাল গাছ’কে। বর্তমানে পালমিরা শহর থেকে কিছু দূরেই তাদমোর নামের একটি ছোটো শহরও আছে, যা অতীতের অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আজও দাড়িয়ে আছে। পুরো শহরটি পর্যটকদের উপর নির্ভর করলেও প্রায় ৩৬ হাজার মানুষের বসবাস ওই তাদমোরে। ১৯ শতকের যে ট্যাবলেট পাওয়া যায় তাতেও উল্লেখ ছিল পালমিরা শহরের নাম। সেখানে উল্লেখ করা হয় যে, পালমিরা ছিল মেসোপটেমিয়া এবং উত্তর সিরিয়ার মধ্যবর্তী বাণিজ্যিক রুটের অন্যতম শহর।

এমনকি বাইবেলে পর্যন্ত পালমিরার বর্ননা পাওয়া যায়। বাইবেলে বলা হয় পালমিরা শহরটি বাদশাহ সোলায়মানের তৈরি(তামার নামের শহরটিও বাদশাহ সোলায়মানের তৈরি বলে জানা যায়)। এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে অনেক ঐতিহাসিক বলেন যে তাদমোর শহরটিও সোলায়মানেরই তৈরি, কিন্তু এই দাবির পক্ষে কোনো নিরেট তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। বিখ্যাত রোমান ইহুদি জোসেফাসের লেখাতেও পালমিরা শহরের নাম পাওয়া যায়।

খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তদোমর। কারণ সেসময় প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের বাণিজ্যিক রুট হিসেবে তাদোমরের উপর দিয়ে একটি রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল। ভূমধ্যসাগর থেকে পশ্চিমে এবং ইউফ্রেতাস নদীর ঠিক পূর্বদিকে ওই রাস্তাটি তৈরি করা হয়েছিল, যাতে প্রাচ্য হয়ে খুব সহজেই পণ্যবাহী ক্যারাভান পশ্চিমে প্রবেশ করতে পারে। মূলত প্রাচ্য এবং পাশ্চত্যের মিলনস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতো এই শহর। তবে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ সালে যখন সেলুসিডস সাম্রাজ্য সিরিয়া দখল করে নেয় তখন পালমিরা(তদোমর) শহরটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

PALMIRA3

খ্রিষ্টপূর্ব ৪১’এর দিকে মার্ক অ্যান্টনি পালমিরা দখল করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়। কারণ পালমিরার কর্তৃপক্ষ আক্রমনের খবর আগেই পেয়েছিলেন এবং ইউফ্রেতাসের বিপরীত তীরে শহরের অধিবাসীরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সিরিয়ায় রোমান সাম্রাজ্যের সময় রোমনরা পালমিরা শহরের বেশ উন্নয়ন করেছিল। কারণ সেই সময়েই পালমিরা শহরের কথা পারস্য, ভারত, চীন এবং গোটা রোমান সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে গিয়েছিল। ১২৯ সালের দিকে হাদ্রিয়ান এই শহরে আসেন এবং শহরটিকে মুক্ত ঘোষণা করে নতুন নামকরণ করেন ‘পালমিরা হাদ্রিয়ানা’ নামে। এরপর ২১৭ সালে সম্রাট কারাকাল্লা পালমিরাকে কলোনি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন, এবং সেই সময়েই প্রথমবারের মতো পালমিরার অধিবাসীদের কর দিতে হয়েছিল।

পালমিরার অধিবাসীদের মুখের ভাষা ছিল ‘আরামিক’। তবে তাদের লেখ্যরীতি ছিল দুই ধরণের। এক রীতিতে বিভিন্ন স্থাপনাকে প্রমাণ মেনে লেখা হতো, এবং দ্বিতীয়ত তারা মোসোপটেমিয়ার রীতিতে লিখতো। এরফলে খুব সহজেই এই শহরে প্রাচ্য এবং পাশ্চত্যের প্রভাব সম্পর্কে বোঝা যায়। শহরের বিভিন্ন স্থানে তৎকালীন অনেক নেতাদের স্থাপত্যকর্ম আছে। সেই স্থাপত্যগুলোয় প্রদর্শিত পোশাকের ফ্যাশন ইত্যাদি দেখলেও প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের প্রভাব সম্পর্কে সহজেই বোঝা যায়। পারস্য সাগর হয়ে পালমিরার ব্যবসায়িরা ভারতের সঙ্গে ব্যবসা করতো। তবে তৃতীয় শতকের শুরুর দিকে টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেতাসের সম্মুখভাগ দখল করে নেয় পার্সিয়ান সাসারিয় সাম্রাজ্য। ২৫৫ সালের দিকে সাসারিয়দের পক্ষে সেপটিমাসকে সিরিয়ার গর্ভনর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, এর পাঁচ বছর বাদে তাকে গোটা পূর্বাঞ্চলের গর্ভনর বানানো হয়েছিল।

২৬৬ সালের দিকে পালমিরার দায়িত্ব রানী জেনোবিয়ার হাতে আসে। তিনি ছিলেন অর্ধেক গ্রিক এবং অর্ধেক আরব(কোনো কোনো ঐতিহাসিক দাবি করেন যে, জেনোবিয়া ছিলেন মূলত অর্ধেক ইহুদি) এবং ক্লিওপেট্রার দূরসম্পর্কের আত্মীয়। তার বুদ্ধিমত্তার কাছে তৎকালীন অনেক রাজার রাজত্ব লোপাট হয়ে যায়। শিক্ষা-সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রেও তার অনেক অবদান ছিল বলে জানা যায়। তার আমলেই মূলত পালমিরার দক্ষ সেনাবাহিনী আনাতোলিয়ার বিশাল অংশ দখল করে নেয় এবং পালমিরা রোম থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তবে জেনোবিয়াকে রোমান বাহিনী একটা সময় গ্রেপ্তার করে রোমে নিয়ে গেলে তার ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা সঠিক জানা যায়নি। জেনোবিয়ার শেষ জীবন নিয়ে দুইটি ঘটনা চালু আছে। একটিতে বলা হয় জেনোবিয়া রোমে সুখে শান্তিতেই ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। আর অন্যটিতে দাবি করা হয় যে, তাকে বিষপানে হত্যা করা হয়েছিল এবং তাকে হত্যার এক বছর পরেই পালমিরায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় এবং অনেক অধিবাসীকে হত্যা করা হয়।

PALMIRA

ষষ্ঠ শতকের দিকে সম্রাট জাস্টিনিয়ানের নেতৃত্বে আবারও মাথা তুলে দাড়ায় পালমিরা। তৎকালীন সময়ে পালমিরায় বেশ কয়েকটি বাইজানটিন চার্চ তৈরি করা হয়ে। যদিও তখন শহরের অধিকাংশই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ৬৩৪ সালের দিকে পালমিরার দায়িত্ব চলে যায় মুসলিম বিশ্বের প্রথম খলিফা আবু বকরের নিয়ন্ত্রনে। সেসময় পালমিরার পাহাড়ের উপর একটি প্রাসাদ তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে থেকে উন্মুক্ত সাগর দেখা যেতো। ১০৮৯ সালের শুরুতে এক ভয়ংকর ভূমিকম্পে পালমিরার একাংশ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু ১৬৭৮ সালের দিকে দুই ইংরেজ ব্যবসায়ির চেষ্টায় পালমিরাকে পুনরায় আবিষ্কার করা সম্ভব হয়। ১৯২৪ সালে এই শহরটির খননকার্য শুরু হয় এবং ১৯৮০ সালে ইউনেস্কে এই শহরটিতে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা দেয়। সূত্র : বাংলামেইল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *