ইবনে বতুতা ২১ বছর বয়সে হজ করতে তানজানিয়া থেকে মক্কার পানে যাত্রা করেন। পরের ২৮ বছর তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর প্রায় ৭৫ হাজার মাইল। লিখেছেন মুকুল মল্লী
প্রথম হজ
ইবনে বতুতার সফরনামা থেকে, ‘দুই রজব ৭২৫ হিজরি বৃহস্পতিবার (১৪ জুন ১৩২৫ খ্রি.) ২২ বছর বয়সে মক্কার কাবা শরিফে হজব্রত পালন ও মদিনায় রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আমি জন্মভূমি তানজানিয়া ত্যাগ করি। পথের সঙ্গী হিসেবে কোনো বন্ধু বা ভ্রমণকারী না পেয়ে আমাকে একাকীই রওনা হতে হয়। পবিত্র স্থানগুলো দর্শনের অদম্য আবেগ ও বাসনা নিয়ে আমি প্রিয় বন্ধুবান্ধব ও গৃহের মায়া কাটানোর সংকল্প করি।’
পশ্চিম থেকে হজযাত্রীদের সাধারণ পথ ছিল উত্তর মিসরের মধ্য দিয়ে। সেই পথে সরাসরি মক্কা গমনের প্রথম ইচ্ছা ব্যর্থ হওয়ায় তিনি দামেস্কের হজযাত্রীদের সঙ্গে যোগ দেন।
তবে এর আগে তিনি দেশ দেখতে বেরিয়ে এশিয়া মাইনরের সীমান্ত পর্যন্ত যান। তাঁর সময় ছিল অফুরান, আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও ছিল না। ১৩২৬ সালের ৫ এপ্রিল ইবনে বতুতা আলেকজান্দ্রিয়া পৌঁছেন। সেখানে দুজন সাধকের দেখা পান। তাঁর বিশ্বভ্রমণে তাঁরা প্রেরণা জুগিয়েছেন। রমজান মাস দামেস্কে (বর্তমান সিরিয়ার রাজধানী) কাটিয়ে তিনি মদিনাগামী একটি হজযাত্রী দলের সঙ্গে যোগ দেন। হজযাত্রী দলে বেশ কয়েক হাজার মানুষ ছিল। প্রত্যেকেই তার বহনকারী পশু, রসদ এবং ব্যয়ের জন্য অর্থশালী ছিল। কিন্তু ইবনে বতুতার কাছে এত অর্থ ছিল না। পথে হজযাত্রীদের অনেকেই অনেককে সহায়তা করত, তা দিয়েই তাঁর চলত। দামেস্ক থেকে মদিনার দূরত্ব প্রায় ৮২০ মাইল এবং এই পথ দিয়ে যেতে ৪৫ থেকে ৬০ দিন সময় লাগে। পথ অতিক্রমও খুব সহজ ছিল না। পথে অনেকে মহামারী রোগে পড়ত। এছাড়া স্থানীয় যাযাবররাও আক্রমণ করত। তা সত্ত্বেও হজযাত্রীরা ভ্রমণ থেকে বিচ্যুত হতো না। যে কারণে যাচ্ছে তা পূর্ণ না হওয়ার আগ পর্যন্ত তা চলতে থাকত।
কোনো বড় ঘটনা ছাড়াই ইবনে বতুতার দলটি মদিনায় পৌঁছে। ইবনে বতুতা বলেন, ‘মদিনায় চার দিনের জন্য আমরা অবস্থান করেছিলাম। প্রতি রাতেই আমরা পবিত্র মসজিদে থাকতাম, যেখানে সবাই একটি চক্র হয়ে বসে মোমবাতি জ্বালিয়ে পবিত্র কোরআন পড়ত। অনেকেই আবার সুর করে খোদার প্রশংসাগীত গাইত। অন্যরা সমাধির স্থানে ধ্যানে মগ্ন থাকত। ওই রাতগুলোতে সবাই নির্দিষ্ট পোশাক পরত এবং সবাই বিপুল পরিমাণ অর্থ হজযাত্রীদের এবং যাদের দরকার তাদের মাঝে বিতরণ করত।’ মদিনায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারত করে চার দিন পর মক্কার উদ্দেশে রওনা দেন। মদিনা থেকে কিছুদিনের যাত্রায় আরো কিছু পবিত্র স্থান ভ্রমণ করে তারা মক্কার কাছাকাছি চলে আসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই পবিত্র ভূমিতে রাতে অবস্থান করলাম। হৃদয় ছিল আমাদের আশায় পূর্ণ এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে আনন্দে উদ্বেলিত প্রাণ। কারণ সকাল হলেই মক্কার সুরেতি শহরে প্রবেশ করব আমরা।’
ইবনে বতুতা মদিনা ছাড়ার পর থেকেই মক্কার রীতি অনুযায়ী সাদা ‘ইহরাম’ পোশাক পরেন। প্রথমেই তিনি গেলেন কাবা শরিফে। তিনি বলেন, ‘আমরা পুরো জায়গাটি সাতবার প্রদক্ষিণ করলাম এবং পবিত্র পাথরটিতে চুমু দিই। মাকামে ইব্রাহিমে আমরা দুবার নামাজ আদায় করি এবং কাবার গায়ের ঝোলানো পর্দা ছুঁয়ে দেখি। আমরা জমজম পানি পান করি, এরপর আল-সাফা ও আল-মারওয়াতে দৌড়ে বেড়াই। ইব্রাহিম গেটের নিকটবর্তী একটা গৃহে আমাদের সরঞ্জাম রেখেছিলাম।’ ইবনে বতুতা মক্কার অন্যান্য স্থান ঘুরে মোট তিন সপ্তাহ ছিলেন। মক্কায় হজ পালন শেষে মধ্য এশিয়া যাত্রার সিদ্ধান্ত নেন।
মোঙ্গল রাজ্য ঘুরে আবার মক্কা
১৭ নভেম্বর ১৩২৬ সালে আরব উপসাগর হয়ে ইরাকগামী এক কাফেলার সঙ্গে যোগ দেন বতুতা। কিন্তু বাগদাদ পৌঁছার আগেই আরেকটি কাফেলার সঙ্গে নাজাফ চলে যান। সেখানে হজরত আলী (রা.)-এর মাজার জিয়ারত শেষে বসরা রওনা হন। বসরা থেকে যান ইস্পাহান। সেখান থেকে শিরাজ। সব শেষে বাগদাদ পৌঁছেন ১৩২৭ সালের জুন মাসে। বাগদাদে শেষ মোঙ্গল সম্রাট আবু সাঈদের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর উপদেশে তিনি রাজকীয় কাফেলায় যোগ দিয়ে উত্তর দিকে সিল্ক রোড হয়ে তাবরিজ শহরে যান। তখন উত্তর দিক দিয়ে মোঙ্গল সাম্রাজ্যে প্রবেশের প্রধান পথ ছিল তাবরিজ। পরে আবার বাগদাদ রওনা হয়ে মসৌল যান। আরো কিছু ঘোরাঘুরি করে বেশ কিছুদিন পরে আরেকটি কাফেলার সঙ্গে যোগ দিয়ে আবার মক্কায় এসে দ্বিতীয়বারের মতো হজ করেন।
তৃতীয় হজ
তৃতীয়বার হজ করেন সম্ভবত ১৩২৮ সালে, কারো কারো মতে ১৩৩০। তারপর তিনি জেদ্দা থেকে ছোট নৌকায় ইয়েমেন যাত্রা করেন। ইয়েমেনের তৎকালীন সুলতান ছিলেন নূর-উদ-দীন। ইয়েমেনের তাঈজ শহরে সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর চার দিন অবস্থান করেন। এরপর তিনি রাজধানী সানার দিকে যাত্রা করেন। তারপর এডেন বন্দর থেকে জাহাজে চার দিনের যাত্রা করে তিনি সোমালিয়ার তীরবর্তী জায়লা শহরে পৌঁছেন। জায়লা থেকে ১৫ দিনের যাত্রা করে পৌঁছেন মোগাদিসু। সুলতানের আতিথেয়তায় মোগাদিসুতে চার দিন ছিলেন। মোগাদিসু ছেড়ে তিনি সাওয়াহিলি রওনা দেন। (আরবি শব্দ আস-সাওয়াহিল অর্থ উপকূলীয় এলাকা) সাওয়াহিলি তৎকালীন সময়ে ‘বিলাদ-আল-যাঞ্জ’ নামে পরিচিত ছিল, যার অর্থ যাঞ্জদের ভূমি।
তাঁর সাওয়াহিলি আসার অন্যতম কারণ ছিল কুলওয়া (বর্তমানে কেনিয়া ও তানজানিয়ার উপকূলের কিছু অংশের নাম) শহর পরিদর্শন। ইবনে বতুতা এই শহরকে অত্যন্ত সুন্দর শহর হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ১৩৩০ সালে তিনি ওমান ও হরমুজ প্রণালি হয়ে আবার হজ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কার দিকে রওনা দেন।
মক্কায় আরো এক বছর কাটিয়ে তিনি ভারতবর্ষের পথে বেরিয়ে পড়েন। গোটা মুসলিম বিশ্ব ছাড়াও তিনি ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনদেশ ভ্রমণ করে ১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরেন। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ