Skip to content

ইরানের ঐতিহাসিক দুর্গ সা’রু

Semnan

ইরান প্রাচীন সভ্যতার দেশ। বিশাল বিস্তৃত এই ইরান-ভূমির আশেপাশে বসবাস করতো বিভিন্ন বংশ ও গোত্র। এখানকার অধিবাসীদের সৃজনশীলতা পরিলক্ষিত হয় প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শনের মধ্যে। মানব সমাজের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার হিসেবে ইরানের গুরুত্ব বিশ্ব পটভূমিতে অপরিসীম। আর সেমনান প্রদেশও এই গৌরবের অন্যতম উত্তরাধিকার। কারণ এখানেও রয়েছে প্রাচীন সভ্যতার বহু নিদর্শন। পুরাতাত্ত্বিকদের গবেষণার ফলে ‘দমাগন’ এবং ‘শাহরুদ’ টিলাসহ এখানকার অন্যান্য ঐতিহাসিক অঞ্চল থেকে যেসব গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন পাওয়া গেছে, সেসব থেকে অনুমিত হয় যে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ সহস্রাব্দে এখানে বিভিন্ন গোত্র ও বংশের লোকজন বসবাস করতো।

এদিক থেকে বিচার করলে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে কাজারী যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন যুগের বিচিত্র নিদর্শন এই সেমনানে দেখতে পাওয়া যাবে। চলুন ইরানের এই প্রাচীন প্রদেশের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক। প্রথমেই যাওয়া যাক সেমনান শহরের দিকে। সেমনান শহরের মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিকভাবে মূল্যবান বহু নিদর্শন এবং এই শহরের আশেপাশে রয়েছে বেশকিছু কেল্লা। শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজস্ব ভূখণ্ড রক্ষার তাগিদে এই শহরের লোকজন দুর্গগুলো নির্মাণ করেছিল। এইসব কেল্লার নাম স্থানীয় নামের সাথে মিল রেখে রাখা হয়েছিল।

তবে দু:খজনক বিষয়টি হলো কালের পরিক্রমায় এখানকার অধিকাংশ কেল্লাই ধ্বংস হয়ে গেছে। কেবল সর্বপ্রথম যেই দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল ঐ দুর্গটিই তার অস্তিত্ব ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। আমরা এখানকার ‘সা’রু’ নামে পরিচিত এলাকার কেল্লাগুলোর সাথে আজ পরিচিত হবার চেষ্টা করবো। সেমনান থেকে দশ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে ‘সা’রু’ নামের পার্বত্য অঞ্চলে দুটি দুর্গ আছে বেশ মজবুত ও দৃঢ়। দুর্গ ভবনের নির্মাণকৌশল এবং এই দুর্গ নির্মাণের জন্য ঠিক এই এলাকাটিকে বেছে নেওয়ার বিষয়টি পর্যালোচনার দাবি রাখে। সা’রু কৃষিক্ষেত্রের দুইপাশের বেশ সুন্দর জায়গায় কেল্লাগুলো অবস্থিত। উত্তরপাশের কেল্লাটির নাম ‘ছোট সারু’,আর দক্ষিণ দিকের কেল্লাটির নাম ‘বড় সা’রু’।

ছোট সা’রু দুর্গটির কিছু অংশ সময়ের ব্যবধানে এবং প্রাকৃতিক বৈরিতায় নষ্ট হয়ে গেছে। দক্ষিণ দিকের বড় সারু দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছে পাহাড় চূড়ার ওপরে। এই দুর্গটি এত মজবুত করে বানানো হয়েছে যে,গবেষকদের দৃষ্টিতে এই বড় সা’রুই পূর্ব ইরানের প্রতিরক্ষা দুর্গগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই দুর্গ থেকে উপরের দিকে যাবার পথ বেশ দুর্গম ও ভয়াবহ। বাহ্যত কেল্লাটিকে তিনতলা বিশিষ্ট বলে মনে করা হয়। আর যেসব প্রমাণপঞ্জি পাওয়া গেছে,তা থেকে অনুমিত হয়,তৃতীয় তলায় বসবাস করতো সেনা এবং কেল্লার ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গরা।

এই দুর্গের আকর্ষণীয় দিকটি হলো ঝর্নার পানি কেল্লার ওপরে স্থানান্তর বা সরবরাহের ব্যবস্থা। ঝর্নাটির পানি কেল্লা থেকে প্রায় এক শ’মিটার নিচুতে প্রবহমান। স্থানীয় পদ্ধতিতে এই পানিকে কেল্লার ওপরে নিয়ে ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুর্গের চার কোণেও আকর্ষণীয় সুন্দর টাওয়ার বানানো হয়েছে। দর্শনার্থীদের জন্যে এগুলো বেশ আনন্দময় ও উপভোগ্য করে।

DTC-Travel-ad

সারু কেল্লাগুলো তৈরির ইতিহাস বেশ প্রাচীন। এগুলো পিশদাদীয়ান এবং কিয়ানি রাজবংশের সময় নির্মিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে,এই কেল্লাগুলো যুগের পর যুগ ধরে বিভিন্ন গোত্রের লোকজন ব্যবহার করেছে।

তাবারিস্তানের এস্ফাহবেদান এবং আশকানিয়ান আধিপত্যবাদীদের সময় এই কেল্লাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসেবে পরিগণিত ছিল। এমনকি ইসলামী যুগের পরেও ইসমাইলি ফেরকার অনুসারীদের জন্যে সারু কেল্লাগুলো ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। তারা প্রায় দুই শতাব্দীকাল তাদের কেন্দ্র হিসেবে এই কেল্লাগুলোকে ব্যবহার করেছে।

সেমনানের ঐতিহাসিক ও মূল্যবান নিদর্শনগুলোর মধ্যে আরেকটি নিদর্শন হলো এখানকার ‘জামে মসজিদ।’এই জামে মসজিদটিও সেমনানের প্রাচীনত্ব ও ঐতিহাসিকতার প্রমাণ বহন করে। সেমনানের সর্বপ্রাচীন ইসলামী নিদর্শন হিসেবে এই মসজিদটিকে ধরা হয়। সম্প্রতি এখানে যে খননকাজ ও গবেষণা চালানো হয়েছে তার ভিত্তিতে বলা হয়ে থাকে যে, হিজরি প্রথম শতাব্দীতে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে।

কালের পরিক্রমায় এই মসজিদে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন ও সংস্কারকাজ হয়েছে। তবে মসজিদের বর্তমান কাঠামোতে তৈমুর এবং মোগল আমলের একটা নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। এই মসজিদ যে পুরোণো তার প্রমাণ মেলে এর মিনারটিতে। মিনারটি বত্রিশ মিটার উঁচু। মসজিদের উত্তর-পূর্ব কোণে এই মিনারটি অবস্থিত। হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। মিনারের গায়ে কুফি অক্ষরে লেখা লিপিকর্ম দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া ইটের কারুকাজও বেশ দর্শনীয়। সেমনান জামে মসজিদের এই মিনারটি সালজুকি মিনার নামেও প্রসিদ্ধ। সালজুকি শাসনামলে নির্মিত ঐতিহাসিক মিনারগুলোর অন্যতম এবং ইরানের জাতীয় নিদর্শনের তালিকাভুক্ত।

ইমাম মসজিদ বা সুলতানি মসজিদও সেমনান শহরে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি স্থাপনা। গুরুত্ব ও ঐতিহাসিকতার কথা বিবেচনা করে ইরানের জাতীয় নিদর্শনের তালিকায় মসজিদটির নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই মসজিদটির চারটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব দিকের প্রধান প্রবেশদ্বারটি বেশ সুন্দর। এতে প্লাস্টারিং এর কারুকাজ এবং টাইলসের কারুকাজ করা হয়েছে বেশ সুন্দর করে। তাছাড়া ইমাম মসজিদের সুবিশাল আঙ্গিনা এবং এর সবুজ বাগিচা মসজিদটির সৌন্দর্য আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সবমিলিয়ে এই মসজিদের স্থাপত্যশৈলী এবং এর ভেতর-বাইরের কারুকাজ ইরানী নির্মাণ শিল্পীদের মেধা ও দক্ষতারই স্বাক্ষর বহন করে। সৌজন্যে : রেডিও তেহরান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *