এই মূর্তিগুলো প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়গুলোর একটি। কেউ বলে রোপা মোয়াইয়ের মূর্তি আবার কারও কাছে এলিয়েনদের স্মৃতিচিহ্ন। কিন্তু আসলে কারা তৈরি করেছিল অতিকায় এসব মূর্তি? আবার কেই-বা পরবর্তীতে কিছু মূর্তির মাথায় পরিয়েছিল টুপি? হাজার বছর ধরে আজও রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুতে ইস্টার আইল্যান্ডের সেই মূর্তিগুলো। ইস্টার দ্বীপের এই আজব মূর্তিগুলো সম্পর্কে জানাচ্ছেন— আবদুল কাদের
ইস্টার দ্বীপ। রহস্যমোদীদের কাছে চিলির এই দ্বীপ ব্যাপক সমাদৃত। বিখ্যাত পাথুরে মূর্তিগুলো নিয়ে একসময় প্রচুর রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে যার কিছুটা এখনো বিদ্যমান। প্রশান্ত মহাসাগরের বিচ্ছিন্ন নির্জন এই দ্বীপটিতে রয়েছে অনেকগুলো ভাস্কর্য। দ্বীপটি ইস্টার দ্বীপ নামেই পরিচিত। এর মূল রহস্য আসলে তিনটি আগ্নেয়গিরি দ্বারা পরিবেষ্টিত। জনমানবহীন ইস্টার দ্বীপে নেই কোনো বসতি। চিলির উপকূল থেকে ৩৬০০ কিলোমিটার দূরের এই দ্বীপটিকে পৃথিবীর অন্যতম নিঃসঙ্গ দ্বীপ বলা হয়। নীরব এই দ্বীপটিতে এখনো নীরবে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য পাথরের তৈরি ভাস্কর্য। কে বা কারা এই বিশাল আকৃতির মূর্তিগুলো তৈরি করেছিল তা এখনো সবার কাছেই অজানা। কেন বা কী কারণে এই জনবিরল দ্বীপে এসব ভাস্কর্যগুলো তৈরি করা হলো তাও রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু। রহস্যঘেরা ইস্টার দ্বীপের বড় রহস্য প্রতিটি মূর্তিই বিশাল পাথর কেটে তৈরি করা। ধারণা করা হয়, পলিনেশীয় কিছু দ্বীপেই পাথরের গায়ে খোদাই করে ছবির নমুনা দেখা যায়, যাকে বলে পেট্রগ্লিপস। তবে এই পেট্রগ্লিপস সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় ভাণ্ডার সংগ্রহ রয়েছে ইস্টার দ্বীপে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখানে প্রায় ১০০০টি স্থানে ৪০০০-এর মতো পেট্রগ্লিপসের নমুনা আছে। উল্লেখ্য, মার্কেসাস দ্বীপেও পেট্রগ্লিপসের প্রচুর নমুনা পাওয়া যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো এ দ্বীপবাসী এই কৌশল রপ্ত করল কীভাবে? তা ছাড়া এত বড় বড় বিশাল পাথরগুলোই বয়ে আনল কীভাবে এবং কোথা থেকে? এসব রহস্যের কূলকিনারা এখনো খুঁজছেন বিশ্লেষকরা।
দ্বীপটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো সাতটি বৃহদাকার ভাস্কর্য। যাদের আসলে ‘নেভল অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বলা হয়। দ্বীপটিতে সব মিলিয়ে প্রায় হাজারখানেক ভাস্কর্য রয়েছে। স্থানীয়রা এসব ভাস্কর্যকে ‘মোয়াই’ বলে থাকে। পুরো দ্বীপেই মোয়াই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। একেকটি ভাস্কর্য প্রায় ১২ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট। আর একেকটির ভাস্কর্যের ওজন কম করে হলেও ২০ টনেরও বেশি। সবচেয়ে বড় ভাস্কর্যটির উচ্চতা ৩২ ফুট। ওজনও কম নয়, প্রায় ৯০ টন। তা ছাড়া আরও আছে পাথুরে তৈরি ৮০০টি মূর্তির মাথা। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় মাথাটির উচ্চতা ৩২ ফুট এবং ওজন ৯০ টন। এ ছাড়া ইস্টার দ্বীপে আছে ‘আহু’ বলে পরিচিত পাথরের বিশাল বিশাল প্লাটফর্ম। আছে পাথরের তৈরি বিস্ময়কর দেয়াল, পাথরের ঘর ও গুহাচিত্র। পরস্পর সঙ্গতিহীন এসব সৃষ্টি বিস্ময়কে যেন আরও বাড়িয়ে দেয়। মূর্তিগুলোর মাথায় টুপি দেখা যায়, যা বানানো হয়েছিল পরে। দেখতেই বোঝা যায় কাঁচা হাতের কারুকাজ। যারা প্রথম ভাস্কর্যগুলো বানিয়ে ছিল তাদের কারুকাজ ছিল নিখুঁত। কিন্তু রহস্য কেবল বাড়তেই থাকল। আসলে কেন এই মূর্তিগুলোকে টুপি পরানো হলো? ইস্টার দ্বীপের ইতিহাস থেকে জানা যায়, আকাশ থেকে দেবতা নেমেছিল পৃথিবীতে আর তারা ছিল সবাই অভিশপ্ত। পরবর্তীতে আকাশের দেবতা তাদের আবার স্বর্গে ফিরিয়ে নেন। ১৭৭২ সালে কোনো এক ইস্টার সানডে উত্সবে অ্যাডমিরাল জ্যাকব রগেউইন দ্বীপটি আবিষ্কার করেন। ডাচ এই অভিযাত্রী দ্বীপটির নাম দেন ‘ইস্টার আইল্যান্ড’। তিনি দ্বীপে নেমে স্থাপিত বিশালাকায় পাথুরে মূর্তিগুলো দেখে অবাক হয়ে যান। কারণ তিনি দ্বীপটি প্রায় বৃক্ষশূন্য অবস্থায় দেখতে পান। বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব থর হেয়ারডাল প্রচুর গবেষণা ও খননকার্যের পর তথ্য দিলেন ৩৮০ খ্রিস্টাব্দে পেরু থেকে কিছু মানুষ দ্বীপটিতে বসবাস শুরু করেন। তারাই এসব রাস্তা, মন্দির, মানমন্দির ও সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করেছিল।
১২৮০ খ্রিস্টাব্দে পেরু থেকে আসা কিছু লোকজন দ্বীপটি দখল করে। এমনকি তারা এও দাবি করে যে, মূর্তিগুলো তাদের তৈরি। মূর্তিগুলোর কান লম্বা। তাদের মতে, অতি প্রাচীন, অথচ উন্নত সভ্যতার চিহ্ন এগুলো। কিন্তু ব্যাপারটি রহস্যময়। ইস্টার দ্বীপের মূর্তিগুলো আসলে কারা তৈরি করেছে? অনেকে মনে করেন, দ্বীপটিতে বাইরের জগৎ থেকে অভিবাসীরা বাস করে গেছে। যার ধ্বংসাবশেষ এই ইস্টার দ্বীপ।
আবার অনেকে মনে করেন, দ্বীপের বাসিন্দারা ছিল প্রাচীন মিসরীয়। মোয়াইগুলোর সঙ্গে প্রাচীন পলিনেশীয় জাতির ধর্মীয় দেবতা ও পূর্বপুরুষদের মিল খুঁজে পেয়েছেন। তাহলে কি ইস্টার দ্বীপে কোনো ভিনগ্রহের প্রাণীর আগমন ঘটেছিল নাকি অন্য কিছু? বিস্ময় পৃথিবীর হাজারো রহস্যের মতো এই রহস্যেরও কোনো সমাধান নেই। বর্তমানে বিখ্যাত এই ইস্টার দ্বীপ আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। ইউনেসকো কর্তৃক রহস্যঘেরা স্থানটিকে বিশ্বের অন্যতম ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়। সৌজন্যে : বাংলাদেশ প্রতিদিন