ফেরদৌস জামান
ঘটে যাওয়া প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে নেপাল আজ প্রায় বিদ্ধস্ত। ভেঙে পড়েছে সেখানকার পর্যটন শিল্প। তারপরও তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে কম-বেশি আমরা সকলেই জানি। আর্থসামাজিক বাস্তবতায় অন্যান্য শিল্প সেখানে গড়ে ওঠেনি বললেই চলে। দেশটির প্রধানতম শিল্প হিসেবে পর্যটনকেই তারা অবলম্বন করেছিল। আমরা যারা প্রকৃতিপ্রেমী, ভ্রমণ প্রিয়, নতুন নতুন জায়গা ও বৈচিত্রময় এই পৃথিবী ঘুরে ঘুরে দেখতে পছন্দ করি তারা চাইলে হয়তো নেপালের এই দুঃসময়ে সামান্য হলেও অবদান রাখতে পারি। আপনার অবগতের জন্য জানিয়ে রাখি, পৃথিবীর নানা দেশের পর্যটকগণ বর্তমানে নেপাল ভ্রমণ করছেন এই মানসিকতা থেকে যে, সেখানে দুটো পয়সা খরচ করলে কোনো না কোনোভাবে তাদের জাতীয় অর্থনীতিতে যুক্ত হবে। সুতরাং আসছে ঈদুল আজহার ছুটিতে আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনায় থাকতে পারে হিমালয় কন্যা নেপালের পোখারা ভ্যালি।
পোখারা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম পর্যটন আকর্ষণগুলোর মধ্যে একটি। পর্যটকদের ভ্রমণ পরিকল্পনায় জীবনে একবার হলেও পোখারা দর্শনের ইচ্ছা থাকে। এক সময়ের ভারত-তিব্বতের অন্যতম এই বাণিজ্য পথ বর্তমানে পর্যটকদের কাছে বায়ু পরিবর্তনের আদর্শ স্থান। ঘুম থেকে জেগে জানালার পর্দা সরালেই অন্যপূর্ণা রেঞ্জের বরফ ঢাকা শ্বেত শরীরে সূর্যের আলোয় সোনালি আভা দেখে আপনার দু’চোখ বিস্ময়ে স্থির হয়ে যাবে। এমন আরো অনেক বিস্ময় সেখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক পোখারায় গিয়ে আপনি আর কী কী দেখবেন-
ফেওয়া তাল: বাংলায় এর অর্থ হলো ফেওয়া লেক। নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম লেক এটি। চারদিকে উঁচু পাহাড়, মাঝখানে লেকটির অবস্থান। সূর্যের আলোর তারতম্যের কারণে লেকের পানির রং বদলে যায়। এ দৃশ্য দেখতে বেশ ভালো লাগে। ইচ্ছা করলে নির্দিষ্ট ভাড়ায় সারা দিন ধরে লেকে বোটিং করতে পারেন। দেখবেন আপনার পাশাপাশি লেকের পানির উপর উড়ছে নাম না জানা অনেক পাখি। লেকটি পাখিদের অভয়ারণ্য। চাইলে ফিশিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে পাখি শিকার করতে পারবেন না।
বারাহি টেম্পল: ফেওয়া লেকের প্রায় মাঝখানে ছোট্ট দ্বীপ। এখানেই বারাহি টেম্পল। দুই তলা এই মন্দিরে হিন্দু এবং বৌদ্ধ উভয় ধর্মের অনুসারীগণ পূজা প্রার্থনা করেন। ফেওয়া তালে ঘুরতে যাওয়া প্রায় শতভাগ পর্যটক এই মন্দির দর্শন করেন। মন্দিরে যাওয়ার জন্য নৌকা ভাড়া করতে হবে। এ জন্য জনপ্রতি দশ রুপি খরচ করলেই হবে।

অন্যপূর্ণা
মাউন্ট ভিউ: পোখারা ভ্যালির প্রায় সব জায়গা থেকেই অন্যপূর্ণা পর্বত দেখতে পাওয়া যায়। এক দৃষ্টিতেই দেখে নেয়া যায় সম্মোহিত হয়ে যাওয়ার মতো তার সৌন্দর্য। একটু সময় নিয়ে শহরের আশপাশে হেঁটে বেড়াতে পারলে চোখে পড়বে অন্যপূর্ণা এক, দুই, তিন ও চার নাম্বার শৃঙ্গ। আপনি অবাক হয়ে যাবেন, যখন দেখবেন দূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ৮,১৬৭ মিটার উচ্চতার মাউন্ট ধবলগিরি এবং ৮,১৬৩ মিটার উচ্চতার মাউন্ট মানাসলু।

শান্তি সুপ্তা বা বিশ্ব শান্তির মন্দির
শান্তি সুপ্তা: ১৯৯৯ সালে নির্মাণ হওয়া এই প্যাগোডা বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব শান্তির মন্দির’ বলে পরিচিত। ফেওয়া তাল থেকে দূর পাহাড়ের চূড়ায় শান্তি সুপ্তার মাথাটুকু শুধু দেখা যায়। সেখানে আরোহণ করলেন তো আপনার সম্মুখে স্পষ্ট দাঁড়ানো দেখতে পাবেন মেছোপুঁচড়ে শৃঙ্গ। ফেওয়া তালে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য উপভোগের সর্বোত্তম জায়গা এটি। যাওয়ার সহজ উপায় হলো, এক হাজার টাকার মধ্যে ট্যাক্সি ভাড়া করা। অনেকে হেঁটেই উঠে যায়, বিশেষ করে যারা একটু অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন। সেক্ষেত্রে নৌকায় লেকের দক্ষিণ পাশে গিয়ে সেখান থেকে বন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে ট্রেইল ধরে প্যাগোডায় পৌঁছতে হবে।
সারাংকোট: পোখারা ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের নিকট সারাংকোট ভীষণ আকর্ষণীয় জায়গা। মূলত এটি একটি পর্বত চূড়া। এখান থেকে অন্যপূর্ণা রেঞ্জের সুন্দরতম শৃঙ্গ মেছোপুঁচড়ে সবচেয়ে নিকটে ও স্পষ্ট দেখা যায়। তার চেয়েও বড় আকর্ষণ হলো, গোল্ডেন সানরাইজ ও সানসেট। সারাংকোটে ১২টি হোটেল রয়েছে। সানরাইজ উপভোগের জন্য বহু পর্যটক অন্ধকার রাতে গিয়ে সেখানে অপেক্ষা করেন। সূর্যের প্রথম আলো ফুটে বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে বরফ রাশির উপর সোনালি রং ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক মিনিটের জন্য পর্বত শ্রেণীটিকে তখন মনে হয় যেন স্বর্ণের একটি দীর্ঘ দেয়াল।

পর্যটকেরা মাহেন্দ্র গুহায় প্রবেশ করছেন
মাহেন্দ্রা কেভ: হেঁটে যেতে পারলে পোখারা থেকে উত্তরে মাত্র দুই ঘণ্টার পথ। গুহাটি সম্পূর্ণ চুনাপাথর দ্বারা গঠিত। চুনা পাথরের এত বড় গুহা বিরল। দশ রুপি প্রবেশ মূল্যে ঘুরে দেখা যায় গুহাটি। নিরাপদে ঘুরে দেখার স্বার্থে গুহার ভেতরে রয়েছে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা। সাবধানে পা ফেলতে হয়, কারণ গুহার ভেতরটা সারাক্ষণ স্যাঁতস্যাতে হয়ে থাকে। সামান্য অসাবধানতার কারণে ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা।

দেভিস ফল
দেভিস ফল: স্থানীয়ভাবে ‘চ্যাঙ্গো’ বলে পরিচিত। শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে সিদ্ধার্থ মহাসড়কের পাশে এর অবস্থান। মূলত এটি একটি ঝরণা। সাধারণ ঝরণার মতো নয় বরং এর পানি ঝরে একটি সুড়ঙ্গের মুখ দিয়ে। দেখতে চাইলে এখানেও আপনাকে দশ রুপির প্রবেশ মূল্য পরিশোধ করতে হবে।
ওল্ড বাজার: বাজারটি ফেওয়া তাল থেকে চার কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত। নেপালের ঐতিহ্যবাহী বাজার এটি। বাজারের সমস্ত ব্যবসায়ী স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতীসত্তার অধিবাসী। তাদের হস্তশিল্পের সমাহারে ঠাসা প্রতিটি দোকান। পোখারার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মন্দির ‘বিন্দুবাসীনি’র অবস্থানও এখানে।
পোখারা রিজিওনাল মিউজিয়াম: নেপালের বিভিন্ন জাতী গোষ্ঠী ও তাদের জীবন সংগ্রামের পরিষ্কার ধারণা অর্জনের জন্য এটি একটি আদর্শ জাদুঘর। প্রবেশ মূল্য মাত্র দশ রুপি।
উল্লেখিত দর্শনীয় স্পটগুলো ছাড়াও পোখারার আরো কিছু আকর্ষণ রয়েছে। যেমন প্যারাগ্লাইডিং। এই বিনোদনটি মিস করা অনুচিত। প্যারাগ্লাইডিং করে উড়তে থাকুন আকাশে, নয়ন ভরে উপভোগ করুন ফেওয়া তাল, হিমালয়ান ভিলেজ, বৌদ্ধ মন্দির এবং এর আশপাশের নয়নাভিরাম দৃশ্য। ত্রিশ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা বিভিন্ন মেয়াদের রাইড রয়েছে। পকেটের স্বাস্থ্য বিবেচনা করে বেছে নিতে হবে আপনি কোনটি করবেন। বিভিন্ন মেয়াদে রাইডের ভাড়ার পরিমাণ শুরু হয় সর্বনিম্ন ৭৫ ডলার থেকে। বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরি রয়েছে। এর মধ্যে সানরাইজ প্যরাগ্লাইডিংয়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
র্যাফটিং: র্যাফটিংয়ের জন্য নেপালের নদীগুলোর সুনাম সবচেয়ে বেশি। পোখারা তার মধ্যে অন্যতম। সোজা কথায় এই বিনোদনের ক্ষেত্রে আদর্শ স্থান পোখারা। জনপ্রিয় নদী ‘ত্রিশুলি’ র্যাফটিংয়ের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। নদীটি কাঠমান্ডু-পোখারা মহাসড়কের পাশ ধরে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়াও কালীগান্দাকী ও সাতি নদীও র্যাফটিং উপযোগী। নির্দিষ্ট পরিমাণ সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে আপনি পাহাড়ি নদীতে র্যাফটিং করার সাধ মিটিয়ে নিতে পারেন।
মাউন্টেইন বাইকিং: চাইলেই বাইক যোগে শহর ছেড়ে খানিক দূরে গিয়ে গ্রামের সৌন্দর্য দর্শন করা যেতে পারে। উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে নিমিষেই পৌঁছা যায় গন্তব্যে। হতে পারে সারাংকোট, শান্তি সুপ্তা প্যাগোডা, লেক সাইড অথবা অন্য কোথাও। ভাবছেন বিদেশ বিভূঁইয়ে বাইক কোথায় পাবেন? চিন্তা নেই হাত বাড়ালেই পেয়ে যাবেন। শহরের রাস্তার পাশে ভাড়া দেয়ার জন্য সেগুলো সাজানো থাকে। যথাক্রমে ৫০০ ও ৩০০ রুপির বিনিময়ে ভাড়া নিতে পারেন আপনার পছন্দের এই বাহন। ভাড়ার সাথে জমা দিতে হবে শুধু পাসপোর্টের ফটোকপি। ব্যাস হয়ে গেল, এবার মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় ছুটতে থাকুন পোখারার বিভিন্ন জায়গায়।

স্থানীয়রা পর্যটকদের নেচে গেয়ে আনন্দ দেয়
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: ভাবছেন সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর পর গানবাজনা হলে মন্দ হয় না। এ জন্য মোটেও ভাববেন না, আপনি চাইলেই রয়েছে ঐতিহ্যবাহী মিউজিকের দারুণ সব ব্যবস্থা। লেকসাইডের অধিকাংশ লজ বা রেস্ট হাউসের লনে রয়েছে ক্ষুদ্রাকৃতির মঞ্চ। দৈনিক সন্ধ্যা থেকে ডিনারের আগ পর্যন্ত চলে স্থানীয় শিল্পীদের অংশগ্রহণে সংগীত ও নৃত্যের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা। এ জন্য আপনাকে আলাদাভাবে দাম মেটাতে হবে না। তবে চাইলে পছন্দের শিল্পীকে পুরস্কৃত করতে পারেন।
ভূরিভোজ: পোখারায় আপনি যেখানেই থাকেন না কেন খাবারের অভাব হবে না। সবখানে পাবেন পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের বিশেষ খাবার। শুধু বললেই হাজির হবে আপনার টেবিলে। তবে সেখানকার স্ট্রিট ফুডের তুলনা হয় না! মাত্র দশ রুপিতে নানা স্বাদের খাবার মিলবে। নানা রঙের কুলফি, তিব্বতিয়ান খাবার, ফ্রায়েড নুডলস্, ফেম্বি, থোপ্পা আরো কত কী!
থাকার জন্য পর্যটকগণ সাধারণত লেকসাইডকেই প্রাধান্য দেন। এখানে অনেক লজ ও গেস্ট হাউস রয়েছে। পোখারায় প্রায় আড়াইশ হোটেল, রিসোর্ট রয়েছে।
ভিসা ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা: যদি সড়ক পথে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন, প্রথমে ইন্ডিয়ান ট্রানজিট ভিসা নিতে হবে। ভিসা আবেদনের জন্য প্রথমে ই-টোকেন সংগ্রহ করতে হবে। টোকেনে প্রদেয় তারিখ ও সময় মোতাবেক গুলশান এক নাম্বার ইন্ডিয়ান ভিসা সেন্টারে প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাগজপত্র জমা দিতে হবে। গুলশান ছাড়াও ধানমন্ডি দুই নাম্বারে ভিসা ইস্যু সেন্টার ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া মতিঝিল শাখায় জমা দিতে পারেন। ভিসা ফি ছয়শ’ টাকা।
নেপালের ভিসা প্রসেজ তুলনামূলক সহজ। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ জমা দিন, দু’তিন দিনের মধ্যেই ভিসা পেয়ে যাবেন। কাগজের মধ্যে নেপাল অ্যাম্বেসি সবচেয়ে গুরুত্ব দেয় প্রার্থীর কর্মস্থল সম্বন্ধীয় কাগজ। যেমন ট্রেড লাইসেন্সের নোটারাইজড্ ফটোকপি এবং প্রার্থীর কর্মস্থল থেকে এনওসি। নেপালে ভিসা আবেদনের জন্য ফি লাগে না।

লেকের পানিতে অন্নপূর্ণার ছায়া
আপনার ভ্রমণ যদি সড়ক পথে হয় তাহলে ঢাকার কল্যাণপুর থেকে শ্যামলী, হানিফ, এসআর বাস পাবেন। বাসগুলো রাতে ছেড়ে যায়। ভাড়া এসি ৮৫০, ননএসি ৬৫০ টাকা। রাতে রওনা হলে পর দিন ভোরে গিয়ে পৌঁছবেন লালমনিরহাট বুড়িমাড়ি সীমান্তে। সীমান্তের আনুষ্ঠানিকতা সেরে ওপারে গিয়ে উঠে পরুন শিলিগুড়ির বাসে। শিলিগুড়ি পৌঁছার পর সেখান থেকে অন্য একটি বাসে রাণীগঞ্জ সীমান্তে যেতে হবে। সীমান্তে আনুষ্ঠানিকতা সেরে প্রবেশ করবেন নেপালের কাকরভিটা। এরপর প্রায় ১০-১২ ঘণ্টার বাস জার্নি করে পৌঁছে যাবেন পোখারা।
আকাশপথে ঢাকা থেকে ফিরতি টিকিট মূল্য জেড এয়ারওয়েজ ১৪ হাজার টাকা এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ১৬ হাজার টাকা। বেশ কিছু টুর অপারেটর কোম্পানি ঈদ উপলক্ষে ৫ দিন ৪ রাত কাঠমান্ডুসহ পোখারা ভ্রমণের প্যাকেজ টুরের অফার করেছে। তাদের অফারগুলো হয়ে থাকে সাধারণত আকাশপথ বিবেচনা করে। সেক্ষেত্রে জনপ্রতি প্যাকেজ মূল্য ৩৪ হাজার থেকে ৩৬ হাজারের মধ্যে। সূত্র : রাইজিংবিডি