মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান
দক্ষিণ এশিয়ার একটি রাজতান্ত্রিক দেশ ভুটান। হিমালয় পর্বতমালার একেবারে পূর্ব অংশে অবস্থিত। উত্তরে চীনের তিব্বত। আর দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারত। দেশটির কোনো জলাভূমি নেই। তবে অনেকগুলো নদীর জন্মস্থান এই দেশ। পুরোটাই পাহাড়ি অঞ্চল এবং হিমালয় পরিবেষ্টিত।
দেশের পূর্ব প্রান্তের লোকজনের পশ্চিম প্রান্তে যেতে হলে পাহাড়ি রাস্তা ধরে পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করতে হয় চারদিন। লোকসংখ্যা আট লাখের বেশি নয়। জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য বিষয়গুলোর ব্যবস্থা ও নিয়ন্ত্রণই দেশটির এখনকার কাজ। পৃথিবীতে সম্ভবত ভুটানই একমাত্র দেশ যেখানে সিগারেট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে বিদেশিরা আড়ালে খেতে পারে। ক্রয়মূল্যের তিনগুন শুল্ক দিয়ে সিগারেট আনতে হয়। দোকানে পাওয়া যায় না।
হিমালয় পরিবেষ্টিত ক্ষুদ্র এ দেশটির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর একটি। টেলিভিশন কেন্দ্রও রয়েছে মাত্র একটি। পোশাক ও স্থাপত্যশৈলীর ক্ষেত্রে অনুমোদিত আইনের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। বারো বছর আগেও সেখানে টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের প্রবেশ ঘটেনি।
দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতার জোট সার্কের সদস্য ভুটান। সদস্য জাতিসংঘেরও। রাজধানীর থিম্পু।
ভুটান শব্দটি এসেছে ‘ভূ-উত্থান’ থেকে, যার অর্থ ‘উঁচু ভূমি’
ভুটান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘ভূ-উত্থান’ শব্দ থেকে। যার অর্থ ‘উঁচু ভূমি’। ভিন্নমতও আছে। ভুটান এসেছে ভোটস-আন্ত থেকে। যার অর্থ ‘তিব্বতের শেষ সীমানা’। যেহেতু ভুটান তিব্বতের ঠিক দক্ষিণে অবস্থিত। ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন সময়ে ভুটান বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলো। যেমন, লো মন (দক্ষিণের অন্ধকারাচ্ছন্ন রাজ্য), লো সেন্দেঞ্জং (সেন্দেন সাইপ্রেস বৃক্ষমণ্ডিত দক্ষিণের রাজ্য), লোমেন খাঝি (দক্ষিণের রাজ্য যাতে চারটি প্রবেশ পথ রয়েছে) লো মেন জং (দক্ষিণের রাজ্য যেখানে ওষধি গাছ পাওয়া যায়।
ভুটান একসময় পাহাড়ের উপত্যকার অনেকগুলো আলাদা আলাদা রাজ্য ছিল। ১৬শ’ শতকে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে এর আবির্ভাব ঘটে। ১৯০৭ সাল থেকে ওয়াংচুক বংশ দেশটি শাসন করে আসছে। ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত ভূটান ছিল একটি বিচ্ছিন্ন দেশ। ১৯৬০-এর দশকে ভারতের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সাহায্য নিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রে গঠনের কাজ শুরু করে দেশটি। তবে এখনও বিশ্বের সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর একটি ভুটান। ভুটানের অধিবাসীরা নিজেদের দেশকে মাতৃভাষা জংকা ভাষায় দ্রুক ইয়ুল বা বজ্র ড্রাগনের দেশ নামে ডাকে।
জিডিপি নয়, ভুটানিরা হিসাব করে সত্যিকারের সুখ বা জিএনএইচ
বিত্ত-বৈভব নয়। সত্যিকারের সুখ খুজছে ভুটান। দেশের সব চিন্তা এখন গ্রোস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস বা জাতীয় সুখ কেন্দ্রীক। সংক্ষেপে বলা হয় জিএনএইচ। ১৯৭০-এর দশকে জিডিপির (মোট জাতীয় আয়ের) পরিবর্তে জিএনএইচ ধারণাই ছিলো সাবেক রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুকের কাজের প্রেরণা। এখন আবার সে পথেই হাঁটছে তারা।
দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে যে দর্শন, সেই দর্শনকে আরো পরিমার্জিত ও উন্নীত করার লক্ষ্যে এখন কাজ করছে ভুটানিরা। এটিকেই তারা মনে করছে নতুন এক রাষ্ট্রবিজ্ঞান।
ভুটান সরকার মনে করে জিডিপি হচ্ছে একটি ভাঙ্গা প্রতিশ্রুতি। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে যে, কোনো দেশের সরকারের লক্ষ্য তাহলে কি হওয়া উচিত? সাবেক প্রধানমন্ত্রী জিগমে থিনলের বক্তব্য, ‘আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার আধুনিক রূপই আমাদের লক্ষ্য, যার মূল বক্তব্য হলো, সার্বিক জাতীয় সুখলাভের চেষ্টা।’
ভুটান যে নীতি গ্রহণ করেছে, সে নীতি যদি বাকি বিশ্বও গ্রহণ করে, তাহলে প্রথমেই সংজ্ঞা ও মান নির্ধারণের জন্য একটি নকশা আঁকতে হবে, যার দ্বারা সুখের পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব। এ ব্যাপারে ভুটান সরকারের অভিমত, ‘একদিন ভুটান গর্বসহকারে বলবে যে, জিএনএইচ দিয়ে আজ আমরা এই অবস্থানে।’ উন্নতবিশ্ব, বিশ্ব ব্যাংকসহ সব ব্যাংক ও আইএমএফ যখন জিজ্ঞেস করবে, তোমরা সুখ পরিমাপ করবে কিভাবে, ভুটানিরা তখন জবাব দেবে, অর্থনীতির বড় খেলুড়েদের প্রতিক্রিয়া দেখেই আমরা তা বুঝতে পারবো।
ভালো থাকার জটিল এক মডেল আবিষ্কার করেছে ভুটান
ভালো থাকার জটিল এক মডেল আবিষ্কার করেছে তারা। এতে আছে চারটি স্তম্ভ। অর্থনীতি, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও ভালো ব্যবস্থাপনা। এই চার স্তম্ভ আবার নয়টি উপ-স্তম্ভে বিভক্ত। সেগুলো হচ্ছে, মানসিকভাবে ভালো থাকা না-থাকা, প্রতিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, জীবনমান, সময়ের ব্যবহার, সম্প্রদায়গত অত্যাবশকতা এবং ভালো পরিচালনা। এর প্রত্যেকটির আছে নিজস্ব মূল্য নির্ণয়কৃত অথবা মূল্য নির্ণয়হীন জিএনএইচ সূচি। সব কিছু বিশ্লেষিত হয় ৭২টি সুখ-নির্দেশক চিহ্ন ব্যবহারের মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ মানসিক তৃপ্তির প্রসঙ্গে আসা যাক। মানসিক স্বস্তি বিষয়টির অধীনে নির্দেশকগুলো হলো- প্রার্থনা ও ধ্যানের পরিমাণ এবং স্বার্থপরতার অনুভূতি, ঈর্ষা, প্রশান্তি, সমবেদনা, ঔদার্য ও হতাশা অধিকন্তু আত্মহত্যার চিন্তা-ভাবনা।
ভুটানে শতভাগ জৈবকৃষি চালু হয়েছে
এ কথা ঠিক, দেখানোর মতো অনেক কিছু রয়েছে ভুটানের। সংবিধানে উল্লেখ আছে, দেশের মোট ভূমির কমপক্ষে ৬০ শতাংশ বনাঞ্চল থাকতে হবে। এটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে তারা। চালু হয়েছে শতভাগ জৈবকৃষি। দুই প্রজন্ম ব্যবধানে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে দ্বিগুণ। দেশের ৯৯ ভাগ শিশুই গ্রহণ করছে প্রাথমিক শিক্ষা। গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমন নাই বললেই চলে। নারীর ক্ষমতায়ন ও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে গ্রহণ করা হয়েছে নানামুখি উদ্যোগ। স্থানীয় অর্থনীতি ও শক্তিশালী কমিউনিটি নেটওয়ার্ক পাচ্ছে সরকারি সহযোগিতা।
ইতিহাস অনেকটা পৌরনিক কাহিনীর মতো
ভুটানের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে সেখানে প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনীর চেয়ে বেশি সুস্পষ্ট কিছু জানা যায় না। এখানে হয়ত খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দেও বসতি ছিল। তবে নবম শতকে এখানে তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের প্রচলনের পরেই এলাকাটি সম্পর্কে আরো জানা যায়। সেসময় বহু তিব্বতি বৌদ্ধ ভিক্ষু পালিয়ে ভুটানে চলে আসেন। ১২শ শতকে এখানে দ্রুকপা কাগিউপা নামের বৌদ্ধধর্মের একটি ধারা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটিই বর্তমানে ভুটানের বৌদ্ধধর্মের প্রধান রূপ। ভুটানের বৌদ্ধ মন্দির ও ধর্মশিক্ষালয় দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসের উপর সবসময় প্রভাব ফেলেছে।
ভুটান একসময় আলাদা আলাদা রাজ্য ছিল
বর্তমান ভুটান একসময় পাহাড়ের উপত্যকার অনেকগুলো আলাদা রাজ্য ছিল। ১৬১৬ সালে নগাওয়ানা নামগিয়াল নামের এক তিব্বতি লামা তিনবার ভুটানের উপর তিব্বতের আক্রমণ প্রতিহত করলে ভুটান এলাকাটি একটি সংঘবদ্ধ দেশে পরিণত হতে শুরু করে। নামগিয়াল বিরোধী ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে পদানত করেন। পরে তিনি একটি ব্যাপক ও সুক্ষ্ম বিবরণসমৃদ্ধ আইন ব্যবস্থা প্রচলন করেন এবং ধর্মীয় ও সিভিল প্রশাসনের উপর নিজেকে একনায়ক বা শাবদ্রুং হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর পর অন্তর্কোন্দল ও গৃহযুদ্ধের কারণে পরবর্তী ২০০ বছর শাবদ্রুঙের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে। ১৮৮৫ সালে উগিয়েন ওয়াংচুক শক্ত হাতে ক্ষমতা প্রয়োগে সক্ষম হন এবং ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসনের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন।
ভুটান জাতিসংঘের সদস্য হয় ১৯৭১ সালে
১৯০৭ সালে উগিয়েন ওয়াংচুক ভুটানের রাজা নির্বাচিত হন এবং ওই বছর ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার উপাধি ছিল দ্রুক গিয়ালপো বা ড্রাগন রাজা। ১৯১০ সালে রাজা উগিয়েন ও ব্রিটিশ শক্তি পুনাখার চুক্তি স্বাক্ষর করেন যেখানে ব্রিটিশ ভারত ভুটানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক না গলানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। উগিয়েন ওয়াংচুক ১৯২৬ সালে মারা গেলে তার পুত্র জিগমে ওয়াংচুক পরবর্তী শাসক হন। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভের পর ভুটানকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে গণ্য করে। ১৯৪৯ সালে ভুটান ও ভারত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে যেখানে ভুটান ভারতের কাছ থেকে বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারে পথনির্দেশনা নেয়ার ব্যাপারে সম্মত হয় এবং পরিবর্তে ভারত ভুটানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ১৯৫২ সালে জিগমে ওয়াংচুকের ছেলে জিগমে দর্জি ওয়াংচুক ক্ষমতায় আসেন। তাঁর আমলে ভুটান পরিকল্পিত উন্নয়নের পথে এগোতে থাকে এবং ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তার সময়েই ভুটানে একটি জাতীয় সংসদ, নতুন আইন ব্যবস্থা, রাজকীয় ভুটানি সেনাবাহিনী এবং একটি উচ্চ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ভুটানে পরম রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে ২০০৮ সালে
১৯৭২ সালে ১৬ বছর বয়সে জিগমে সিঙিয়ে ওয়াংচুক ক্ষমতায় আসেন। তিনি আধুনিক শিক্ষা, সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, পর্যটন এবং পল্লী উন্নয়নের মত ব্যাপারগুলোর উপর জোর দেন। তিনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি জনগণের সামগ্রিক সুখের একজন প্রবক্তা। উন্নয়ন সম্পর্কে তাঁর দর্শন কিছুটা ভিন্ন। এই ভিন্নতার কারণে তিনি আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান। তার আমলে ধীরে ধীরে ভুটান গণতন্ত্রায়নের পথে এগোতে থাকে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি রাজার পদ ছেড়ে দেন এবং তার ছেলে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক ভুটানের রাজা হন। ২০০৮ সালের ১৮ জুলাই ভুটানের সংসদ একটি নতুন সংবিধান গ্রহণ করে। এই ঐতিহাসিক দিন থেকে ভুটানে পরম রাজতন্ত্রের সমাপ্তি ঘটে এবং ভুটান একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও সংসদীয় গণতন্ত্রে পরিণত হয়।
মন্ত্রীদের একটি কাউন্সিল রাষ্ট্রের নির্বাহী কাজ পরিচালনা করে
রাজতান্ত্রিক ভুটানে একসময় পরম রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল। বর্তমানে দেশটিতে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র চলছে। ভুটানের রাজার উপাধি ড্রাগন রাজা। তিনিই রাষ্ট্রের প্রধান। মন্ত্রীদের একটি কাউন্সিল রাষ্ট্রের নির্বাহী কাজ পরিচালনা করে। সরকার ও জাতীয় সংসদ উভয়ের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ন্যস্ত। এছাড়াও খেনপো উপাধিবিশিষ্ট দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা রাজার সবচেয়ে কাছের পরামর্শদাতার একজন। ২০০৭ সালে একটি রাজকীয় আদেশ বলে রাজনৈতিক দল নির্মাণের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়া হয়। বর্তমান সংবিধানে দেশটিতে একটি দুই-দলবিশিষ্ট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। জিগমে খেসার নামগিয়াল ওয়াংচুক বর্তমানে ভুটানের রাজা।
ভুটানকে এশিয়ার সুইজারল্যান্ড বলা হয়
ভুটানের আয়তন ৪৬ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার। রাজধানী শহর থিম্পু দেশটির মধ্য-পশ্চিম অংশে অবস্থিত। দেশটির পারো, ফোয়েন্তশোলিং, পুনাখা ও বুমথং শহর উল্লেখযোগ্য। ভুটানের ভূপ্রকৃতি পর্বতময়। উত্তরে সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা, মধ্য ও দক্ষিণভাগে নিচু পাহাড় ও মালভূমি এবং দক্ষিণ প্রান্তসীমায় সামান্য কিছু সাভানা তৃণভূমি ও সমভূমি আছে। মধ্যভাগের মালভূমির মধ্যকার উপত্যকাগুলোতেই বেশির ভাগ লোকের বাস। ভুটানের জলবায়ু উত্তরে আল্পীয়, মধ্যে নাতিশীতোষ্ণ এবং দক্ষিণে উপক্রান্তীয়। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত হয়। স্থলবেষ্টিত ভুটানের আকার, আকৃতি ও পার্বত্য ভূ-প্রকৃতি সুইজারল্যান্ডের মতো হওয়ায় অনেক সময় দেশটিকে এশিয়ার সুইজারল্যান্ড নামে ডাকা হয়।
ভুটান প্রাণী ও উদ্ভিদের এক অভয়ারণ্য
ভুটান প্রাণী ও উদ্ভিদের এক অভয়ারণ্য। এখানে হাজারো দুর্লভ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যায়। ভুটানের বনাঞ্চল এলাকা প্রায় ৭০ ভাগ।
ভূটানের রাষ্ট্রীয় মুদ্রা গুলট্রাম
ভূটানের রাষ্ট্রীয় মুদ্রা গুলট্রাম। এর বিনিময় হার ভারতীয় রুপির সাথে সম্পর্কিত। নেপালের মত ভুটানেও ভারতের রুপি চলে। ভূটানের অর্থনীতি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র অর্থনীতিগুলোর একটি। এটি মূলত কৃষি ও বনজ সম্পদনির্ভর অর্থনীতি। ভুটানের জনসংখ্যার প্রায় ৬০% এই দুই ধরনের পেশায় জড়িত।
জনসংখ্যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ লামাবাদী বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী
ভুটানের অধিবাসীরা ভুটানি নামে পরিচিত। ২০০৫ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ভুটানে ছয় লাখ ৭২ হাজার ৪২৫ জনের বাস। আর ২০১২ সালে এই জনসংখ্যা ছিল সাত লাখ ৪২ হাজার ৭৩৭ জন। প্রতি বছর জনসংখ্যা বাড়ছে ২ শতাংশ হারে। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র ৪৫ জন। ভুটানে দ্রুপকা জাতির লোক প্রায় ৫০%। এর পরেই আছে নেপালি (৩৫%) এবং অন্যান্য আদিবাসী বা অভিবাসী জাতি। দেশের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ লোক লামাবাদী বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী। বাকিরা ভারত ও নেপালি ধারার হিন্দু ধর্ম পালন করে। জোংখা ভুটানের সরকারি ভাষা। এছাড়া বুমথাং-খা, শারচোপ-খা ও নেপালি ভাষাসহ প্রায় ১০টি ভাষা প্রচলিত। তবে স্কুল-কলেজে শিক্ষা দেয়া হয় ইংরেজি ভাষায়। ভুটানের সাক্ষরতার হার প্রায় ৬০%। জনগণের প্রায় ৯৪% শতাংশ কৃষিকাজ করে। ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী বেকারত্বের হার ৩.১%। আন্তর্জাতিক ব্যবসা বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়।
বেশির ভাগ পণ্যই ভারতের
ভুটানের বেশির ভাগ পণ্যই ভারত থেকে আমদানি করা। ভূ-প্রকৃত্রির জন্য পরিবহন খরচ বেশি। তাই পন্যের দামও তুলনামূলক বেশি। ভারত থেকে পাহাড়ি, সর্পিল, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এখানে পণ্য আসে। ভুটানের শিল্প বলে তেমন কিছু নেই। এদেশের মানুষের মূল আয় কৃষি থেকে। মোট জমির মাত্র তিন শতাংশ চাষযোগ্য। কিন্তু লোকসংখ্যা কম হওয়ায় তারা মশলা ও ফল চাষ করে রফতানি করে। বাংলাদেশেও আসে। জনসংখ্যা কম হওয়ার আরেক সুবিধা বেকারত্বের হার মাত্র ৪ শতাংশ। পাহাড়ি নদীতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের অবারিত সুযোগ আছে, কল-কারখানা না থাকায় চাহিদা কম, ফলে বাড়তি বিদ্যুৎ ভারতে রফতানি হয়। ভুটানের দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়ানোর সুবিধা হলো দোকানীরা বিরক্ত করে না। কোনো কিছু গছানোর প্রবণতা তাদের নেই। থাইল্যান্ড-ভিয়েতনামের মত এখানেও বেশিরভাগ দোকানদার মহিলা।
প্রকৃতির অসাধারণ সৌন্দর্য সত্ত্বেও পর্যটকদের ঢল নামতে দেয়া হয়নি
ভুটান ভ্রমণে কোনো ভিসার দরকার নেই। বিমানবন্দরে বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে হাজির হলেই ওরা ঢুকার অনুমতি দিয়ে দেয়। আবার দেশটি ভ্রমণে দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটকদের কোনো ফি লাগে না। তবে ২০১২ সাল থেকে অন্য বিদেশিদের গুনতে হয় প্রতিদিন ২৫০ ডলার করে। এয়ারপোর্টে ভিসাসহ আসতে হবে।
হিমালয়ের ভেতর থেকেও বহু শতাব্দী ধরে নিজের ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতি ধরে রাখতে পেরেছে ভুটান। প্রকৃতির অসাধারণ সৌন্দর্য সত্ত্বেও পর্যটকদের ঢল নামতে দেয়া হয়নি সেখানে। সরকারের ঘোষিত নীতির ফলেই ভুটান ভ্রমণ সাধারণ বিদেশি পর্যটকদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। একমাত্র সরকার অনুমোদিত বিশেষ কিছু পর্যটন সংস্থার মাধ্যমেই বিদেশি পর্যটকরা ভুটান ভ্রমণে যেতে পারে।
ভুটানের পর্যটন পরিষদ বলছে, সব পর্যটকের জন্য ভুটানের দরজা খুলে দেয়া হলে রাজস্ব বাবদ বিশাল অর্থ হাতে আসবে ঠিক, কিন্তু তার জন্য হয়তো অনেক মূল্য দিতে হবে। ভুটান এ ক্ষেত্রে সংযত থাকতে চায়।
ভুটান বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়
ভুটানের সাথে বাংলাদেশের দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহ্যবাহী বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভুটানই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানকারী প্রথম রাষ্ট্র। এক সময় ভুটানের গিরিপথ দিয়ে বাংলাদেশের সাথে চীন ও তিব্বতের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। তবে বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্য সরাসরি কোনো সীমান্ত নেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ কিংবা আসাম পার হয়েই তবে ভুটান যেতে হয়। ভুটান ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশের সৈয়দপুর বিমানবন্দর ব্যবহার করতে চায়। নৌ-ট্রানজিটও চেয়েছে তারা। ট্রান্সশিপমেন্টেরও প্রয়োজন হতে পারে। নারায়ণগঞ্জের পানগাঁও, মাওয়া আর চাঁদপুরে নদী বন্দরগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষও হয়েছে। অন্যগুলোর যাচাই অনেকদূর এগিয়েছে।
ভুটানের পার্বত্য এলাকায় ব্যাপকভাবে কৃষি উন্নয়ন ও নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণে কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রে ভুটানকে সহায়তা দিতে পারে। কৃষিখাতে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। ভুটানের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে সাহায্য করতে পারে। ভুটানে জলবিদ্যুত কেন্দ্র গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ ভুটান থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিদ্যুত আমদানি করতে পারে। চেষ্টা করলে দুটি দেশই যৌথ উদ্যোগে ভুটানে জলবিদ্যুত কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে। লেখক : সাংবাদিক ও ঢাকা ট্যুরিস্ট ক্লাবের প্রেসিডেন্ট
Pingback: ভুবনমোহিনী ভুটান ভ্রমণের আদ্যোপান্ত | Dhaka Tourist Club
Pingback: বাই রোড ভুটান, ৬ দিন ৭ রাত, জনপ্রতি ২০,০০০ টাকা | Dhaka Tourist Club
Pingback: Dhaka Tourist Club