Skip to content

এই আমাদের সোনার চর

Sonar-Char4

জঙ্গল পার হলেই দেখা মিলবে এমন নির্জন সৈকত। ছবি: লেখক

ফারুখ আহমেদ
সময় বেলা একটা। আমরা তিনজন দাঁড়িয়ে অর্ধচন্দ্রাকৃতির এক সমুদ্রসৈকতে। গোসল করার জন্য আদর্শ জায়গা। কিন্তু আমাদের ভাবনার জগৎজুড়ে আছে সমুদ্রসৈকত আর তার চারপাশের পরিবেশ। সমুদ্রসৈকতের পেছনে ঝাউগাছের সারি, ঢেউয়ের উথালপাতাল, অসংখ্য মাছ ধরার নৌকা, দূরে জেলেদের অস্থায়ী ছোট একটি গ্রাম মন কেড়ে নিয়েছে আমাদের। এমন জনমানবহীন সমুদ্রসৈকত দেখে ভেবে বসেছিলাম দ্বীপটির মালিক আমরা তিনজন। আমরা তিনজন হচ্ছি আমি, চিকিৎসক নাজমূল হক ও বন্ধু শরীফ নীড়। ছোট্ট একটি ট্রলার চেপে প্রথমে তেঁতুলিয়া নদী, তারপর বুড়াগৌরাঙ্গ হয়ে একটু আগে এখানে পা রেখেছি। চার ঘণ্টার ট্রলারভ্রমণ ছিল নিখাদ আনন্দে ভরপুর। কত যে পাখি দেখলাম। নাজমূল হক স্যার দীর্ঘদিন পাখির ছবি তুলেছেন। তিনিও একসময় বললেন, জীবনে একসঙ্গে এত পাখি এই প্রথম দেখলাম। আর সেই পাখির চোখে চোখ রেখে রেখে তিনজনের দল চলে এলাম যেখানে, তার নাম সোনার চর।

পরিকল্পনা ছিল শীত মৌসুমে পুরো দক্ষিণাঞ্চল ঘুরে দেখব। কিন্তু আমাদের সময় হলো বসন্ত মৌসুম শুরু হওয়ার পর। ছয়জনের দল শেষে গিয়ে ঠেকল তিনজনে। আমরা ঢাকা থেকে লঞ্চে চরফ্যাশন ও চর কচ্ছপিয়া হয়ে স্পিড বোটে চেপে চলে আসি চর কুকরি-মুকরি। সেদিন চর কুকরি-মুকরির নারকেল বন ও তারুয়া দ্বীপ ঘুরে দেখি। পরদিন ভোরে বের হই সোনার চরের উদ্দেশে। আমাদের সঙ্গে গাইড হয়ে যাবেন শিক্ষক জাকির হোসেন। আমরা সাতসকালে ইলিশ মাছ ভাজা আর লাল চালের গরম ভাত খেয়ে রওনা হই। ট্রলার দেখে পছন্দ না হলেও চড়ে বসতে কারোরই আপত্তি দেখলাম না। মেঘনার মোহনায় পড়তেই ম্যানগ্রোভ বনের পাশের ছোট্ট চর দিঘলে মহিষের পাল ও বক পাখির সঙ্গে অনেক নাম না-জানা পাখি ও ঝাঁকে ঝাঁকে কাস্তেচেরা দেখে মনটা আনন্দে নেচে উঠতেই বোঝা হয়ে গেল দিনটা আমাদের!

Sonarchar3

চর দিঘল পেরিয়ে সামনে যেতেই নিজেদের সাত সাগরের ওপার মনে হলো। চারদিকে অথই জল আর মাছ ধরার ফাঁদ ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছিল না। মাঝেমধ্যে একটা-দুইটা ইলিশের নাও চলে যাচ্ছে প্রচণ্ড শব্দ করে। এর মধ্যে গড়গড় আওয়াজ করে ট্রলার দাঁড়িয়ে পড়ল। তখনই চোখে পড়ল একঝাঁক সাদা রঙের পাখির ঝলক। নাজমূল স্যার ইশারায় ট্রলারচালককে গতি কমিয়ে ধীরে যেতে বললেন। তারপর শুনলাম তাঁর বিড়বিড় উচ্চারণ, পাতি চখা। ইতিমধ্যে ট্রলারচালক ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ করে বইঠা বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল পাতি চখার দিকে। শরীফ আর নাজমূল স্যার ততক্ষণ সমানে ক্যামেরা ক্লিক করে চলছিলেন। হঠাৎ কোনো আওয়াজে পাতি চখার দলের আকাশপানে উড়াল। সে দৃশ্যে মুগ্ধতা ছড়ানো ছাড়া আর কিছুই ছিল না। মেঘনা নদী পেরোনো শেষ হয়ে এখন আমরা চলছি বঙ্গোপসাগরের বুকের ওপর। ঢেউয়ের পর ঢেউ, এক কথায় অপূর্ব। এভাবে কতক্ষণ চলেছি মনে নেই। দুই চোখে সবুজ ভর করতেই বুঝলাম আমরা সোনার চরের খুব কাছে চলে এসেছি।

Sonar-Char2কিছুক্ষণের মধ্যে পাশের খাল ধরে চলে এলাম সোনার চরের শানবাঁধানো ঘাটে। সোনার চরে আমাদের প্রথম মুগ্ধতা ছিল ঝুনঝুনি ফুল আর ঝাউগাছ। আরও চোখে পড়ল উপকূলীয় অঞ্চলের গাছ হরগোজা ও বাবলা। এখানে পুরোটাই ইটের জিগজ্যাগ রাস্তা। সেই রাস্তা আর সবুজে চোখ জুড়িয়ে ঠিক ১০ মিনিটে চলে আসি সমুদ্রসৈকতে। মুগ্ধতায় ভরা সে সৈকতের আরেক সৌন্দর্য কাঁকড়া দলের অসাধারণ শিল্পকর্ম। অনেক পাখির দেখাও পেলাম। উল্লেখযোগ্য হলো চখাচখি, লালপা বা রেডস্যাঙ্ক, হলদে খঞ্জন, কমন স্নাইপ, বড় বুলিন্দা ও কাস্তেচেরা। বক দেখেছি অগণিত। এভাবেই আমরা পায়ে পায়ে চলে আসি জেলেপল্লিতে। সকালের মাছ ধরার পর্যায় শেষ হয়েছে। আবার জেলেরা বের হবে বিকেলবেলা। চলছে মাছ শুকিয়ে শুঁটকি বানানোর কাজ। এসব শুঁটকির বেশির ভাগই মুরগির খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে।

যেহেতু রাতে থাকব না, সেহেতু বেলা থাকতেই চর কুকরি-মুকরিতে ফেরার প্রস্তুতি হিসেবে ঝাউবনের ভেতর দিয়ে হাঁটা শুরু করি। ঝাউবন পেরিয়ে পেয়ে যাই কেওড়া বন। দেখতে পাই এই ম্যানগ্রোভ বনে সামাজিক বনায়নের চিহ্ন। আমরা চলে আসি আমাদের নির্দিষ্ট ঘাটে, যেখানে নোঙর করা আছে আমাদের বাহন ছোট্ট ট্রলারটি!

সুন্দরবনের পর চর কুকরি-মুকরি ও সোনার চরকেই ধরা হয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। সোনার চরের মূল সৌন্দর্য এখানকার ঝাউবন। এ ছাড়া এই বনে রয়েছে প্রচুর কেওড়া, ছৈলাসহ গোলপাতা, বাবলা, করমচা, নলখাগড়া ও জামগাছ। শীত মৌসুমে এখানে প্রচুর পাখি আসে, সে অর্থে সোনার চর প্রচুর দেশি-বিদেশি পাখির বিচরণক্ষেত্র।

Sonar-Char3

সোনার চরে দেখতে পাওয়া যায় প্রচুর পাখি

কীভাবে যাবেন
পটুয়াখালীর গলাচিপা থেকে সোনার চর যেতে পারবেন। এ ছাড়া চর কুকরি-মুকরি বা চর কচ্ছপিয়া ফেরিঘাট থেকে সরাসরি সোনার চর যেতে পারেন। যেভাবেই যান, ঢাকার সদর ঘাট থেকে সরাসরি গলাচিপা বা চরফ্যাশন চলে যাওয়া যাবে। চর কুকরি-মুকরি থেকে ট্রলারে করে সোনার চর।

ট্রলারভাড়া আসা-যাওয়া মিলে সর্বোচ্চ চার হাজার টাকার মতো। সোনার চরে দলবেঁধে যাওয়াই উত্তম। লঞ্চে ঢাকা থেকে চরফ্যাশন (বেতুয়া ঘাট বা ঘোষের হাট) ডেকের ভাড়া ২০০ টাকা। কেবিন এক হাজার টাকা। চরফ্যাশন থেকে চর কচ্ছপিয়া ফেরিঘাট যেতে হবে মোটরসাইকেল অথবা বোরাকে (ইজিবাইক) চেপে। এবার স্পিডবোট কিংবা ট্রলার রিজার্ভ নিয়ে নিন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় অথবা লাইনের ট্রলারে চেপে চলে যান চর কুকরি-মুকরি। উপজেলা পরিষদ ভবনে অনুমতি নিয়ে রাতে থাকা যাবে। থাকা যাবে বন বিভাগের অফিসার্স কোয়ার্টার ও স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়ি কিংবা খোলা মাঠে তাঁবু পেতে। খাওয়াদাওয়ার কোনো চিন্তা নেই। বাজারের হোটেলে অর্ডার দিলেই তাজা মাছের সঙ্গে দেশি মুরগি সহজেই পেয়ে যাবেন। দামও হাতের নাগালে। সোনার চরে থাকার জন্য বন বিভাগের বাংলোই একমাত্র ভরসা। যারা রোমাঞ্চপ্রেমিক তারা হয়তো সৈকতের কাছে তাঁবু পেতে থাকতে পারেন। খাবারদাবারের ব্যবস্থা চর কুকরি-মুকরি থেকেই করে আসতে বা নিয়ে আসতে হবে! সৌজন্যে : প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *