বানগঙ্গা আর গম্ভীর নদীর সঙ্গমে বাঁধের সাহায্যে সৃষ্ট কৃত্রিম জলাশয় সন্নিহিত নাবাল জমি আজ পৃথিবীবিখ্যাত পাখিরালয়। লিখছেন পৃথ্বীরাজ ঢ্যাং
ফেব্রুয়ারি মাসে ভোরের দিকে বেশ ঠাণ্ডা রাজস্থানের এই দিকটায়। তারই মধ্যে ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত হয়ে সাড়ে ৬টা নাগাদ যখন কেওলাদেও জাতীয় উদ্যানের টিকিট কাউন্টারে পৌঁছলাম তখন সেখানে দর্শনার্থীদের উপস্থিতি বেশ উল্লেখযোগ্য। বড় বড় লেন্সসহ ক্যামেরা নিয়ে আলোকচিত্রী, দূরবীন হাতে পক্ষীপ্রেমিকদের ভিড়ই মুখ্য। আমরা টিকিট কেটে সাইকেলরিকশায় সওয়ার হয়ে গেট পেরিয়ে উদ্যানে ঢুকলাম।
আলো এখনও পরিষ্কার নয়। কিছুটা কুয়াশা কিছুটা ধোঁয়াশায় দিন এখনো পুরোপুরি আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি। পথের দুধারে ঝোপঝাড়, গাছপালা আর নিচু জমি। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাতাঝরা গাছের সারি। আরও একটু এগিয়ে দেখলাম, সবাই বাঁ দিকের দূরের পাতাঝরা গাছের দিকে ক্যামেরা বাগিয়ে দাঁড়িয়ে। রিকশা থেকে নেমে সে দিকে চোখ রাখলাম। শুকনো গাছের ওপরের ডালে ময়ূর দম্পতি বেশ সুন্দর ভঙ্গিমাতে বসে রয়েছে, আর ঠিক তাদের পেছন থেকেই গোলাপি রঙের গোল থালার মতো সূর্যদেব আবির্ভূত হলেন।

ভোরের আমেজ কেওলাদেও জাতীয় উদ্যানে
দিল্লি হয়ে ভরতপুর পৌঁছতে প্রায় বিকেল হয়েছিল। বিকেলেই পায়ে পায়ে ঘুরে নিয়েছি পুরনো জনপদ বাজার লোহাগড় কেল্লার প্রাচীর ও তোরণের অবশেষ। আস্বাদ করেছি উৎকৃষ্ট সামোসা এবং গাজরের হালুয়া। হোটেলের ছাদে দাঁড়িয়ে সাক্ষী হয়েছি এক অপরূপ চন্দ্রোদয়ের।
শীতযাপন ও বংশ বিস্তারের কারণে ডেরা বাঁধে অগণিত হাঁস জাতীয় পাখিও। পেন্টেড স্টর্ক, পেলিকান, সারস, নানান হেরন, ইগ্রেট আর বিভিন্ন প্রজাতির হাঁসের চারণভূমি এটি। রয়েছে নীলগাই, হরিণ, শিয়াল প্রভৃতি স্তন্যপায়ী, কচ্ছপ এবং গোসাপ ও অন্যান্য সরীসৃপ।
ভরতপুর বিখ্যাত তার প্রায় ২৯ বর্গ কিলোমিটারব্যাপী মনুষ্যসৃষ্ট জলা আর অরণ্যভূমির জন্য। বানগঙ্গা আর গম্ভীর নদীর সঙ্গমে বাঁধের সাহায্যে সৃষ্ট এই কৃত্রিম জলাশয় সন্নিহিত নাবাল জমি আজ পৃথিবীবিখ্যাত পাখিরালয়। ইউনেস্কো বিশ্ব ইতিহ্যের তালিকাভুক্ত এই জাতীয় উদ্যান প্রায় ২৩০ প্রজাতির স্থায়ী এবং বহু পরিযায়ী পাখি, নানান স্তন্যপায়ী, উভচর ও সরীসৃপের আবাসস্থল। শীতে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখির সমাবেশ হয় এখানে।

ক্যামেরায় ধরা পড়ল ডারটার বা স্নেক বার্ড
অপরূপ সূর্যোদয় দেখে এগিয়ে চললাম। সামান্য এগিয়ে চৌমাথা আর চেকপোস্ট। এর পর থেকে আর কোনো মোটরযানের এগনোর অনুমতি নেই। আমরা তো সাইকেলরিকশায়, চালকই গাইড। তারই তৎপরতায় দেখতে পেলাম ইয়েলো পিজিয়নের ঝাঁক। গাছের মগডালে মালাবার হর্নবিল, নাইট হেরন, মায় জলের ধারে আধো অন্ধকারে ঝুপ্সি জঙ্গলের মধ্যে একটি বিরল ব্ল্যাক বিটার্ন-ও। তার ছবি তোলার উৎসাহে অনেকে মাটিতে প্রায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে দেখলাম। তারপরে পথের দু’দিকের জলাশয়ে পিনটেল, স্পটবিল ডাক, শোভলার, কূট, গ্রে ল্যাগ গুজ, নানা হেরন ও ইগ্রেটের সকালের ব্যস্ততা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল।
তবে পানির মধ্যে জেগে থাকা টুকরো জমি ও গাছে একাধিপত্য দেখলাম পেন্টেড স্টর্কের। প্রচণ্ড বায়নাদার ছানা নিয়ে তাদের ভরপুর সংসার। এরই মাঝে ধীরে ধীরে জল পেরিয়ে ওপারে গেল একটি বেশ বড়সড় নীলগাই। আরও এগিয়ে ডান দিকের পরিচ্ছন্ন জলাশয়ের নাম স্বপনমুরি। পরিষ্কার জলে পানকৌড়ির মাছ শিকার ক্যামেরাবন্দি করার আশায় জলাশয়ের পাড়ে , কালভার্টের উপর ইতিউতি আলোকচিত্রীদের অবিচল প্রতীক্ষা সম্ভ্রম উদ্রেককারী।

গাছের ডালে ডেরা বেধেছে গ্রিন হ্যারন
স্বপন মুরিতে পানকৌড়ির মাছধরা দেখে, ডারটার পাখির ব্যস্ততাহীন ডানা শুকনো করার ছবি তুলে কেওলাদের মন্দিরের দিকে এগোলাম। সামান্য পথ, মন্দিরের কাছে পথের বাঁ দিকের বড়সড় টলটলে জলের দীঘির নাম মানস সরোবর, আর উল্টো দিকেই ক্যান্টিন। কোনও কোনও বার এই সরোবরে পেলিকানদের ভাসতে দেখা যায়। এ বার এ দিকটাতে সংস্কার চলছে তাই বেবাক ফাঁকা। কোনও পাখিরই দেখা নেই জলে। বরং সামনের সুবিশাল জলার মাঝখানে উঁচু জমিতে এক ঝাঁক পেলিকান আর স্পুন বিলকে রোদ পোয়াতে দেখা যাচ্ছে।
ক্যান্টিনের এলাকায় ঢুকে বেঞ্চির ওপর ক্যামেরা ও ব্যাগ নামিয়ে চায়ের অর্ডার দিয়ে হোটেল থেকে প্যাক করা প্রাতরাশের সদ্ব্যবহার করলাম। ক্যান্টিনের বাগান আর ঘাসজমিতে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে একদল টিকিধারী ব্রাহ্মণী ময়না। মানুষের সান্নিধ্যে তারা বেশ অভ্যস্ত দেখলাম। আমাদের বেশ কাছাকাছি চলে আসছিল তারা। কিছু ক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সামনের দিকটা ঘুরে দেখতে বেরলাম। রিকশা এখানেই অপেক্ষা করবে। দরকারমতো ব্যবহার করলে হবে। এর পর ঘণ্টা দুই প্রকৃতি, জলাশয়, গাছপালা, পাখপাখালির মধ্যে আত্মহারা হয়ে কাটালাম। এত অল্প সময়ে এত অল্প জায়গার মধ্যে এত বিভিন্ন ধরনের পাখি ও জীববৈচিত্র্য দেখে হতবাক হওয়াই স্বাভাবিক। ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছলাম ক্যান্টিনের পাশের পথ ধরে জলার পাশে ওয়াচ টাওয়ারে। এখানে পনির গভীরতা কম, হলুদ ও লালচে রঙের পানা জাতীয় জলজ উদ্ভিদ পর্যাপ্ত। সেই রঙিন পানির মধ্যে ডুব দিয়ে ঘুরছে দুটো ডারটার পাখি। পাড়ে বাঁধা রয়েছে একটা নীল রঙের নৌকা যার ওপর থেকে একমনে জলে ঝাঁপিয়ে শিকার ধরছে একটা ততোধিক উজ্জ্বল নীল রঙের মাছরাঙা।

সঙ্গীর সঙ্গে খুনসুটিতে মগ্ন প্যারাকিট
প্রায় ২৫০ বছরের পুরনো এই উদ্যান প্রস্তুত হয় ভরতপুরের মহারাজের উদ্যোগে। পরে ১৮৫০ থেকে এটি ছিল রাজা-মহারাজাদের পাখি শিকারের জায়গা। ১৯৩৮ সালে একসঙ্গে ৪,২৭৩টি পাখি শিকার করেন তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত শিকারের অধিকার বজায় ছিল। ১৯৭৬ সালে এটি পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। ১৯৮২ তে জাতীয় উদ্যান ও পরে ১৯৮৫ সালে এটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়।
এই অনিন্দ্যসুন্দর জায়গায় দুপুরের খাবার নিয়ে এলেন আমাদের রিকশাচালক হোটেল থেকে। ভাত, রুটি, ডাল, তরকারি, স্যালাড, ফল, পায়েস— সে এক এলাহি বন্দোবস্ত। খেতে খেতেই ফস্কে গেল মাছরাঙার শিকারের আর ডারটার-এর শিকার ফস্কানোর দৃশ্য। এই সময় দূরে শন শন করে উড়ে এসে বসল এক সঙ্গে দুটি পেলিকান। তারপর দুপুর বিকেল কেটে গেল এক স্বপ্নময় পরিস্থিতিতে প্রকৃতির সান্নিধ্যে। কখনও মেতে থাকলাম ডারটার এর মাছ ধরার চেষ্টার ছবি তোলায় কখনও বা ক্যামেরাবন্দি করলাম অপূর্ব নিসর্গের টুকরো টাকরা। ফিরে এলাম সন্ধ্যের মুখে হোটেলে।

রোদ পোয়াচ্ছে ইয়েলো পিজিয়ন
এর পর আরও দু’দিন কাটালাম ভরতপুরে। ভোর থেকে সন্ধ্যা একই রুটিন। কখনও বা পায়ে চলে পৌঁছে গেলাম জলাভূমির খুব কাছে, প্রকৃতিও উজাড় করে ঝুলি ভরে দিল। পেলাম স্পুনবিলদের ঝাঁক দ্বীপের মধ্যে, দেখলাম প্যারাকিটদের খুনসুটি। এক বিকেলে স্পটেড আউলেটের গোটা পরিবার যেন জরিপ করছিল আমাদের। মানস সরোবরের পাশের পথ দিয়ে এগিয়ে দেখলাম খান তিনেক কচ্ছপ রোদ পোয়াচ্ছে একটা আধডোবা গাছের ডালে বসে। আরও এগিয়ে পানির ওপারের জমিতে দেখলাম এক ঝাঁক বার হেডেড গুজ-কে। সাদা মাথার ওপর কালো সরল রেখার মত দাগ বলে এদের এই নাম। এরা নাকি এভারেস্ট পেরিয়ে ভারতবর্ষে এসে পৌঁছয়। সত্যি তাদের চলন বলন শক্তি দেখে সে রকমই মনে হয়। আরও এগিয়ে সাক্ষাৎ পেলাম একটা বেশ বড় গোসাপের, জলের পাশে বেশ কায়দা করে বসে, সামান্য এগিয়ে আরও একটা।

জলাশয়ে দল বেধে পেন্টেট স্টর্ক
উল্টো পথে ফেরার সময় হটাৎ দেখলাম কমন কূট, জাকানাদের হুড়োহুড়ি আর পানি ছেড়ে তাদের ডাঙায় কোনও গাছের তলায় লুকনোর প্রয়াস। আন্দাজ করে ওপরে তাকিয়ে দেখি মাথার ওপরে চক্কর দিচ্ছে হ্যারিয়ার। আবর্তনপথ ধীরে ধীরে ছোট করে একসময় সে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে কোনও এক হতভাগ্য পাখিকে।
সূর্য ডোবার মুখে অনেকেই জমা হয়েছেন স্বপন মুরির কাছে। লাল সূর্যের পটভুমিকাতে পেন্টেড স্টর্ক বা অন্য পাখির ছবি তোলার চেষ্টায়। চারিদিক রাঙিয়ে সূর্য অস্ত গেল। ফেরার সময় পথের পাশেই দেখা হল এক সজারুর সঙ্গে। দেখালেন রিকশাচালকই, আর দেখলাম জলার ওপারে এক ঝাঁক হরিণের পাল, সঙ্গে তাদের শাবক।

শেষবেলায় ক্যামেরায় ধরা পড়ল হরিণের দল
শেষ দিন এক ঝাঁক পানকৌড়ির সমবেত মৎস্য শিকার আর একে অপরের মাছ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা বেশ চিত্তাকর্ষক লাগল। জঙ্গুলে পথে কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতেই মাথার ওপর দিয়ে হুস হুস শব্দে উড়ে গেল পেলিকান। গ্রেহেরন আর পেন্টেড স্টর্কের সাপ শিকার আর গলাদ্ধকরণের দৃশ্য দেখা গেল এই দিন। একটি পেন্টেড স্টর্কের শাবককে বেশ বিজ্ঞের মতো পায়ে হেঁটে মানুষের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম দুপুরের দিকটায়। বিকেলের দিকে স্বপনমুরি পার করে সরু পথে আরও গভীরে চললাম জঙ্গলের। বেশ অনেকটা যাওয়ার পর আর এগনোর নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত বোর্ড দেখলাম পথের ওপর। জঙ্গল এখানে বেশ নিবিড়, বিকেলের আলো এখানে আরও রঙিন। এখান থেকেই সন্ধের পড়ন্ত আলোতে বেশ দূরে দেখলাম এক নীলগাই যেন অবাক হয়ে দেখছে দু’টি লম্বা সারসের যুগলবন্দি। এ যাত্রায় আর তাদের কাছ থেকে পাওয়া হল না।
তথ্যপঞ্জী
দিল্লি , জয়পুর (৪ ঘণ্টা) এবং আগ্রা (১ /১.৫ ঘণ্টা) থেকে সড়ক এবং রেলপথে সহজেই ভরতপুর আসা যায়।
ভরতপুরে নানান দামের ও মানের প্রচুর হোটেল, গেস্ট হাউস আছে। জনপ্রিয় পোর্টাল এবং মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমেও সহজে ঘর সংরক্ষণ করা যায়। আগেই জেনে নেওয়া যায় তাদের গুনগত মান অন্য পর্যটকদের মতামত দেখে। ভরতপুরে উদ্যানের প্রধান ফটকের ভেতরে রয়েছে রাজস্থান পর্যটনের ভরতপুর ফরেস্ট লজ। (০৫৬৪৪২২২৭৬০ /৯৪১৪৮৭৭৭৪৭) ভাড়া ডবলবেড মরশুম অনুযায়ী ২৯৯৯ টাকা থেকে ৪৫০০ টাকা। উদ্যানের বাইরে রয়েছে রাজস্থান পর্যটনের হোটেল সারস (০৫৬৪৪২২৩৭৯০ /৯৮৭৫১২৬৩৩০) ভাড়া ডবলবেড মরশুম অনুযায়ী ৯০০ টাকা থেকে ২২০০ টাকা। সৌজন্যে: আনন্দবাজার পত্রিকা