
জীবনযাপন ও চিন্তাধারায় ভিন্নতাই ভ্রমণপিপাসুদের মেক্সিকো নিয়ে আগ্রহ বাড়ায়।
‘ভাই, আর কতক্ষণ?’ ‘আরে আর মাত্র এক মিনিট!’
এক মিনিট মানে আসলে কয় মিনিট? সব দেশের সংস্কৃতিতে এক মিনিট মানে কিন্তু এক মিনিটই নয়। সেটাই যেন নতুন করে জানলেন সুজানা রিগ। সুজানা ফ্রিল্যান্স ভ্রমণলেখক। বিবিসিতে তাঁর নতুন ভ্রমণকাহিনিতে লিখেছেন, মেক্সিকানদের সময়বোধের সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিজের সময়জ্ঞান পাল্টে ফেলতে হচ্ছে তাঁকে। কারণ, মেক্সিকোয় এক মিনিট মানে কখনো কখনো নাকি এক ঘণ্টাও। ‘এখনই’ মানে মোটেও এখনই নয়!
সুজানার লেখার শুরু হয়েছে একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে। একজন আইসক্রিম বিক্রেতার কাছে চকলেট আইসক্রিম চেয়েছিলেন। কিন্তু অর্ডার অনুযায়ী সেই আইসক্রিম আর আসে না। সুজানা জানতে চান, ভাই, আর কতক্ষণ? উত্তর আসে, ‘আহোরিতা’। স্প্যানিশ শব্দটার অর্থ—এখনই।
আধঘণ্টা পর আবার প্রশ্ন করলেন, আইসক্রিমটা কি আসছে? ‘আহোরিইইতা!’ বেশ জোর দিয়ে উত্তর দিল আইসক্রিম বিক্রেতা। এবার আইসক্রিম না এসে পারেই না। এল না! সুজানা ঠিক করলেন, ‘এখনই’ মানে কখন, সেটা তিনি দেখেই ছাড়বেন।
কিন্তু অপেক্ষা করতে করতে দিন পেরিয়ে যায় যায়। আকাশ কালো হলো, ঘন কালো মেঘ হুমকি দিতে শুরু করল। নাহ, আর থাকা যাচ্ছে না। রিগ উঠে পড়লেন।
লেখিকা তখন মনে করেছিলেন, স্প্যানিশ ভাষাটা ভালোভাবে শিখতে পারেননি বলেই হয়তো এমন কিছু হলো। কিন্তু সমস্যা লুকিয়ে ছিল অন্য জায়গায়, মেক্সিকোর ভাব-চালই যে বোঝা হয়নি তাঁর। সেটি বুঝেছেন পরে।
মেক্সিকোয় কেউ যখন ‘আহোরিতা’ বলে, তখন ভুলেও ‘এখনই’ ভেবে নিতে নেই। শব্দটার আক্ষরিক অর্থ ‘এখনই’, কিন্তু সেটার আসল মানে অনেক কিছুই হতে পারে। হতে পারে ‘আগামীকাল’, ‘এক ঘণ্টা’, ‘পাঁচ বছর’, কিংবা ‘কখনোই না!’ একজন মেক্সিকান যখন বলেন ‘আহোরিতা ইয়েগো’ (অনুবাদ: আমি এখনই আসছি), তিনি আসলে বোঝান—‘আমি আসব কখনো না কখনো।’ আর যদি বলেন, ‘আহোরিতা রিগ্রেসো’ (আমি এখনই ফিরব), তিনি আসলে বলতে চাচ্ছেন, ‘আমি হয়তো ফিরব, কিন্তু কে বলতে পারে কখন!’

সুজানা রিগ
এসব অভিজ্ঞতার কথা লিখে সুজানা লিখেছেন, মেক্সিকানরা আসলে এমনটা করে স্রেফ ভদ্রতা হিসেবে। ‘কখন আসছেন’-এর জবাবে ‘আসতে দেরি হবে’ বললে যদি অতিথি দুঃখ পায়!
এ অভ্যাসটাই পশ্চিমাদের থেকে আলাদা করেছে মেক্সিকানদের। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে কেউ বক্তব্য লম্বা করলে লোকজন আসন ছেড়েও চলে যায়। বক্তা কষ্ট পাবে কি না, তার পরোয়া করে না। আর মেক্সিকোয় ব্যাপারটা একেবারেই উল্টো। এখানে শ্রোতারাই লম্বা বক্তব্য শুনলে খুশি হয়। ভাবে, ‘বক্তা লম্বা বক্তব্য কি আর এমনি এমনি দিচ্ছে। এমন সমঝদার শ্রোতা পাবে কোথায়! বল বাবা, আরও ঘণ্টা পাঁচেকের একটা বক্তৃতা করে যা।’
মেক্সিকোয় সাতটায় দাওয়াত দেওয়া মানে সাড়ে আটটার আগে যেতে নেই। সাড়ে ৮টা মানে ১০টার আগে অতিথির চেহারা দেখার আশা নেই!
সুজানা ব্যাপারটা ধরে ফেলেছিলেন দ্রুতই। তাই নিজের ঘরের পানির কল নষ্ট হওয়ার পর খবর দিতে যখন জানলেন, পানির মিস্ত্রি এই এখনই আসছে, ধরে নিয়েছেন, দ্রুত হলেও আগামী চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর দেখা মিলতে পারে!
ঘড়ির কাঁটা মেনে চলা জীবনের বাইরে যে অন্য এক জীবন, যে জীবনের ব্যাপ্তি ৬০টি দাগকাটা ঘরের একই বৃত্তে ঘুরঘুর করার নয়…মেক্সিকো সেটাই শিখিয়েছে সুজানাকে।
বাংলাদেশে এলে সুজানা নিশ্চয়ই আরও আনন্দ পেতেন! সূত্র: বিবিসি, সৌজন্যে: প্রথম আলো।