Skip to content

এবার গন্তব্য কাঁঠালবাড়ী

:: সুমন্ত গুপ্ত ::

নাগরিক জীবনে বেঁধে দেয়া ছকে আমাদের চলতে হয়। এই ছকে চলতে চলতে কখন মন অশান্ত হয়ে ওঠে। এই অশান্ত মনকে শান্ত করতে ভ্রমণের বিকল্প কিছু নেই।

গত কয়েক মাস ধরে অফিসের কাজের চাপ গেছে খুব তাই মনে মনে নতুন জায়গার সন্ধান করছিলাম। আর আমার সব সময়ের ভ্রমণসঙ্গী মাও বলছিলেন বেশ কিছু দিন হয় বাইরে ঘুরতে যাওয়া হয় না চল আশপাশে কোথাও ঘুরে আসি। আমার আবার অফিস থেকে ছুটি নেয়া মানে যুদ্ধ জয় করা। তাই অফিসের দুই দিন বন্ধ শুক্র আর শনিবারই ভরসা।

যাই হোক, একদিন আলাপ হচ্ছিল আমার চার চাকার পাইলট ফরহাদের সঙ্গে। কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়, ফরহাদ বলল ওর বাড়ির পাশে একটা জায়গা আছে নাম কাঁঠালবাড়ী, সেখানকার সৌন্দর্য দেখতে এলাকার অনেকেই যান ঘুরতে। তবে এখন জায়গাটি পর্যটকদের কাছে অচেনাই রয়ে গেছে।

ফরহাদের সঙ্গে কথা বলেই মনে মনে প্ল্যান করে ফেলি আসছে শুক্রবারই বেড়িয়ে পড়ব। মা-কে বললাম তোমার জন্য নতুন জায়গার সন্ধান পেয়েছি। মা জায়গার নাম জানতে চাইলে আমি বললাম বলা যাবে না। আগে যাই পরে দেখে নেবে। আমাদের যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো।

সকাল হতে মা ঘুম থেকে উঠেই তৈরি হয়ে আমার কানের সামনে ঘেন ঘেন করতে লাগল। এই ঘুম থেকে উঠো। যাবি না ঘুরতে, যত আগে বের হব তত আগে ফিরতে পারব। বাসায় কাজ আছে অনেক, আর তাছাড়া রাস্তায় সকাল বেলা ঝামেলা কম থাকবে। আমার প্ল্যান ছিল যেহেতু দূরত্ব কম আর গত সপ্তাহে কাজের চাপ গিয়েছে খুব তাই কিছু সময় বেশি ঘুমালে মন্দ হয় না। শেষ পর্যন্ত মা’র ডাকাডাকিতে ঘুম থেকে উঠতেই হল।

ঘড়ির কাঁটাতে তখন দশটা বাজি বাজি আমাদের চার চাকার সহযোগীকে নিয়ে বের হলাম। শুক্রবার তাই রাস্তায় গাড়ির আনাগোনা কম। সূর্যদেবের আভা তখন মহাসড়কে তির্যকভাবে পড়েনি। আমরা এগিয়ে চলছি, পথের ধারের প্রাকৃতিক দৃশ্য আমরা অবলোকন করতে লাগলাম।

আমরা মহাসড়ক পেড়িয়ে এগিয়ে চলছি কথা হচ্ছিল পাইলট ফরহাদের সঙ্গে। ও বলছিল সিলেটের রাতারগুল আর মায়াবনের পর ‘কাঁঠালবাড়ী হাওর দ্বীপ’ হতে পারে দারুণ উপভোগ্য এক পর্যটন স্পট।

হরিপুর থেকে মাত্র ৩/৪ কিলোমিটার দূরে কানাইঘাট উপজেলার ৯নং রাজাগঞ্জ ইউনিয়নে হাওরের মাঝখানে গাছপালায় ভরপুর অনেক টিলার উপরের এই ছোট্ট গ্রামটির-ই নাম ‘কাঁঠালবাড়ী’। সেখানকার প্রকৃতির মোহনীয় শোভা যে কারোর ক্লান্তি দূর করে দিতে পারে। সময়ের পালা বদলে আমরা এসে পৌঁছলাম কানাইঘাট বাজারে। সেখানে ফরহাদ বলল আগে কিছু খেয়ে নিন পরে ভেতরে ঘুরতে গেলে সময় লাগবে।

আমি মনে মনে ভাবলাম পেটে খিদাও লেগেছে আর খালি পেটে কোথায় ঘুরে মজা পাওয়া যায় না। তাই আর না বললাম না সোজা হোটেলে গিয়ে বসলাম। আমাদের মাঝে গরম গরম পরটা আর সবজি পরিবেশন করা হল। স্বাদও বেশ, তাই দেরি না করে খাওয়া শুরু করে দিলাম। ভোজন পর্ব শেষ করে যাত্রা শুরু করলাম আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। গাজী বোরহান উদ্দিন রোড হয়ে রাজাগঞ্জ দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।

রাজাগঞ্জ এসে গ্রামীণ পথ তাই গাড়ি রেখে পদব্রজে এগিয়ে গেলাম। ফরহাদ বলল সামনেই নৌকার ঘাট সেখান থেকে নৌকা করে কাঁঠালবাড়ীতে যেতে হবে। আমরা ঘাটে এসে পৌঁছলাম ফরহাদের পরিচিত মাঝি ছিল তাকে নিয়েই আমরা যাত্রা শুরু করলাম কাঁঠালবাড়ির দিকে।

ডিঙ্গি নৌকা করে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম। বৈঠার ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল শব্দ এক অপূর্ব পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। লালমাটি, গাছগাছালি, পাখপাখালি, খালবিল, পাল তুলা নৌকায় মানুষের যাতায়াত, জেলেদের মাছ ধরা, সারি-সারি হাঁসের অবাধ বিচরণ, স্বচ্ছ সাদা পানি, পানিতে শাপলা ফুল, পানির ওপরে নীল আসমান।

আর এর মাঝ দিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। চারদিকে থৈ থৈ পানি, তার মাঝে হিজল গাছ, কনচ গাছ, চতুর্দিকে উঁচু নিচু টিলা, টিলার বুকে ছোট-বড় বাড়ি, আছে টিলার মাঝে কাঁঠাল গাছ, পেয়ারা গাছ, আম গাছ এসব মিলিয়ে এক একটা টিলা যেন একেকটা আলাদা আলাদা রাজ্য।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যেন এক অপরূপ লীলাভূমি। ফরহাদ বলছিল সিলেটের রাতারগুল আর কাঁঠালবাড়ীর মধ্যে রয়েছে অনেকটা মিল। মিল রয়েছে উপজেলার নামের মাঝেও। রাতারগুলের অবস্থান সিলেটের গোয়াইঘাট আর কাঁঠালবাড়ীর অবস্থান সিলেটের কানাইঘাট। শুধু যে ঘাটে ঘাটেই মিল তা নয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেও রাতারগুল থেকে কম নয় কানাইঘাটের কাঁঠালবাড়ীর সৌন্দর্য।

যে কাঁঠালবাড়ীতে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা ভূমি সেই কাঁঠালবাড়ীর প্রত্যকটি টিলা সত্যিই যেন আলাদা আলাদা একটি রাজ্য, একেকটি যেন আলাদা আলাদা দ্বীপ। যেখানে নেই কোনো যাতায়াত ব্যবস্থা, নেই কোনো শিক্ষাব্যবস্থা, নেই কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা। আছে শুধু ভ্রমণকারীদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মিটানোর অপরূপ দৃশ্য। অনিন্দ্যসুন্দর বিশাল এ কাঁঠালবাড়ীর সঙ্গে অবশ্যই তুলনা চলে সিলেটের রাতারগুলের।

কোনো অংশেই যেন কম নয় কাঁঠালবাড়ী। কোনো গাছের কোমর পর্যন্ত ডুবে আছে পানিতে। একটু ছোট যেগুলো, সেগুলো আবার শরীরের অর্ধেকই ডুবিয়ে আছে জলে। কোথাও চোখে পড়বে মাছ ধরার জাল পেতেছে জেলেরা। ঘন হয়ে জন্মানো গাছপালার কারণে কেমন যেন অন্ধকার লাগবে টিলাগুলো। মাঝেমধ্যেই গাছের ডালপালা আটকে দেবে পথ। হাত দিয়ে ওগুলো সরিয়ে পথ চলতে হয়। জলের নিচের অপূর্ব জগৎ।

যাত্রা পথের ঠিকানা

প্রথমে আপনাকে ট্রেন/বাস এ করে সিলেট শহরে আসতে হবে। ভাড়া নেবে ৩০০ থেকে ১২০০ টাকা। সেখান থেকে বাস অথবা প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে যেতে হবে কাঁঠালবাড়ীতে। সিলেট নগরী থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে কানাইঘাট গাজী বোরহান উদ্দিন রোড হয়ে রাজাগঞ্জ যেতে হয়।

রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের বোরহান উদ্দিন রোড সংলগ্ন রাজাগঞ্জ বাজার থেকে গাজীপুর রাস্তা অথবা পারকুল রাস্তা হয়ে নৌকা যোগে পাড়ি দিতে হয় কাঁঠালবাড়ীতে। রাজাগঞ্জ থেকে গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে প্রায় ৩০ মিনিট হেঁটে ইঞ্জিন নৌকা অথবা ডিঙ্গি নৌকায় পাড়ি দিতে হয় কাঁঠালবাড়ীতে। অথবা সিলেট নগরী থেকে হরিপুর হয়ে যাওয়া যায় কাঁঠালবাড়ী।

এছাড়াও কানাইঘাট সদর থেকে গাছবাড়ী হয়ে বিভিন্ন পথে সেখানে যাওয়া যায়। গাছবাড়ী নারাইনপুর গ্রাম থেকে নৌকা যোগে, বাঁশবাড়ী থেকে নৌকা যোগে, শহরউল্লাহ হয়ে কাপ্তানপুর গ্রাম থেকে নৌকা যোগে যেতে পারবেন কাঁঠালবাড়ী। তবে বর্ষাকালে নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ছাড়া নৌকা পাওয়া যায় না। সেখানে যেতে হলে স্থানীয়দের সঙ্গে আগেই কথা বলে নৌকার ব্যবস্থা করতে হবে।

কিছু সতর্কতা

কাঁঠালবাড়ী বা তার আশপাশে খাবারের হোটেল বা থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই খাবার রাজাগঞ্জ বা সিলেট থেকে নিয়ে যেতে পারেন। আরেকটা বিষয়, নৌকায় করে বেড়ানোর সময় পানিতে হাত না দেয়াই ভালো। জোঁকসহ বিভিন্ন পোকামাকড় তো আছেই, মাঝে মাঝে বিষাক্ত সাপও পানিতে দেখতে পাওয়া যায়।

সাঁতার না জানলে সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট রাখা জরুরি। এ ছাড়া ছাতা, বর্ষাতি কিংবা রোদ টুপিও সঙ্গে নিতে হবে। আরেকটি কথা- পলিথিন, বোতল, চিপসের খোসা, বিস্কুটের খোসা ইত্যাদি জিনিস পানিতে ফেলবেন না দয়া করে। আমাদের নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। সৌজন্যে : যুগান্তর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *