সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে স্বাধীন দুই দেশ এসতোনিয়া আর লিথুয়ানিয়ার পথে পথে এ এক অন্যরকম ভ্রমণ
রিগা থেকে তাল্লিন চলেছি। ছোট্ট বিমান। যাত্রীসংখ্যা সর্বসাকুল্যে জন্য পনেরো। এক ঘণ্টার পথ। আড়াইটায় তাল্লিন বিমানবন্দরে নামলাম। বন্দরে পা রেখেই বিস্ময়। পাসপোর্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই, শুল্ক দফতরের জিজ্ঞাসাবাদ নেই, নিষিদ্ধ জিনিস ঘোষণার দরকার নেই। বাইরে আসার জন্য লাল সবুজ পথ নেই।
ব্যাগেজ ক্লেইম থেকে সুটকেসটা নিয়ে সোজা বাইরে চলে এলাম। এ যেন একাই দেশের একটা শহর থেকে আর-একটা শহরে এলাম। সুতরাং টাকা ভাঙাবার দরকার নেই। বন্দরের গেটের বাইরে এসে আর এক বিস্ময়। গেরুয়া বসনে এক যুবক এগিয়ে এসে হাতজোড় করেন দাঁড়াল। জিজ্ঞাসা করি, আপনি ইস্কন থেকে এসেছেন? হ্যাঁ। আমাকে চিনলেন কী করে?
কিয়েভ থেকে খবর এসেছে ভারত থেকে এক অতিথি আসছেন। আপনার পোশাকই আপনার পরিচয়। এই পোশকে আর কেউ তো এখানে নেই। বোঝা গেল ইউক্রেনের সবেতলানা নোবোছাদ আমার আসার খবর এদের জানিয়েছে।
যুবক বলল, আসুন একটু দুরে গাড়ি রেখে এসেছি। সঙ্গে ইউথ হোস্টের কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলাম। ডরমিটরিতে আমার জন্য একটা বেড বুক করতে অযাচিত আশ্রয়স্থল যখন জুটেই গেল তাকে পায়ে ঠেলি কেন?
যুবকের সঙ্গে তার গাড়িতে উঠলাম। আধঘণ্টার মধ্যে একটি মন্দিরে পৌঁছে গেলাম। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে একটা ছোট্ট ঘরে আমার সুটকেসটা ঢুকিয়ে দিয়ে যুবক বলল, এই ঘরে আপনি থাকবেন। আটটায় খাওয়ার সময় নিচে নেমে যাবেন। যুবক চলে গেল।
ঘরে আছে একটি বিছানা, একটি কম্বল, একটি বই রাখার তাক আর একটি হিটার। ব্যাগ-সুটকেস ঘরে রেখে সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে পড়লাম। রাজপথের গায়ে লাগনো মন্দির। পথে বাস, ট্রলিবাস আর ট্রাম, তিনরকম পরিবহনের মধ্যে ট্রলিবাসের দাপটই লক্ষ করা যাচ্ছে। ভারতে ট্রলিবাস হলো ট্রাম আর বাসের মিশ্রণ। প্রথম দেখায় ট্রলিবাসকে ট্রাম বলেই মনে হবে।
বাস আর ট্রামের সংখ্যা ছাপিয়ে ছুটছে ট্রলিবাস। দেখতে অতি সুন্দর। পথ চলতে চলতে পথের ধারে অতি মনোরম একটা বাড়ি দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ওই দিকেই পা যেতে চায়। চলতে চলতে এলাম পথের চৌমাথায়। এখন সুন্দর বাড়িটা আমার সামনে, পথের ঠিক ওপারে। পথ পেরিয়ে গেলাম বাড়িটার সামনে।
এটা কীসের বাড়ি? জিজ্ঞাসা করি এক পথিককে। বললেন জাতীয় গ্রন্থাগার। ভিতরে যাওয়া যাবে? এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ওই গির্জাটার নাম কী? সেন্ট নিকোলাস চার্চ। ওখানে যেতে পারবেন। ধন্যবাদ।
এবার পথিকের জিজ্ঞাসা কোন দেশ, ইন্ডিয়া? হ্যাঁ। ওহ! খুব বড় দেশ, খুব সুন্দর। যেতে ইচ্ছে করে। বেশ তো, চলে আসুন। সে কি আর কোনো দিন পারব। আক্ষেপ করে চলে যান পথিক।
পথ পেরিয়ে এলাম সেন্ট নিকোলাস গির্জায়। আলোকসজ্জায় গির্জাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। ইউরোপের দেশে দেশে গির্জা প্রচুর দেখেছি নামগুলোও সব একরকম। তবু এর আর্কষণ যেন কমতে চায় না।
আর্কষণ মেরি যিশুতে নেই, আছে গির্জার অঙ্গসজ্জায়, তার স্থাপত্যে শিল্পে। বাইরে গথিক আর আধুনিক নকশার মিশ্রণ। ভিতরে দেয়ালে, ছাদের সিলিংয়ে, গোল থামগুলোতে, জানলায়, কাঁচের শার্সিতে বিচিত্র চিত্রকলায় অলঙ্করণ, কাঠের দরজা-জানলায় খোদাই করা নকশা- এসব কখনও পুরনো হয় না। বারবার হাতছানি দেয়। ভিতরে না গিয়ে থাকতে পারি না। নিষেধ অগ্রাহ্য করেও অনেক সময় সুযোগ পেলে ক্যামেরার শাটার টিপে দিই।
ভিতরে ঢুকলাম। সামনে র্প্রাথনা ঘরটিতে যিশুর মুর্তির সামনে সারি সারি বেঞ্চ পাতা। তার দু’পাশের দু’টি ঘরের কিছু কিছু ম্যুরাল চিত্র অভিনব। কোনো গির্জায় যা কখনও দেখা যায় না। নৃত্যরত কঙ্কালের চিত্র যার সঙ্গে বাইবেলের কোনো সর্ম্পক থাকা সম্ভব নয়।
এক দর্শকের কাছে জানতে চাই, এই ম্যুরাল শিল্পের ব্যাখ্যা কী জানেন? তিনি বললেন, এর নাম ড্যান্স ম্যাকাবর (ভুতুরে নাচ)। গির্জায় এ রকম শিল্প কেন? অনেক পুরনো কালের গির্জা। এখন এটাকে মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ধর্মীয় শিল্পকলা আর এই রকম ভুতুুরে নাচের জন্য এই মিউজিয়াম প্রসিদ্ধ। এই দেওয়ালচিত্রগুলো খ্যাতনামা শিল্পী বেরনেট নোটকের অত্যন্ত জনপ্রিয় শিল্প। আরও অনেক চিত্রকলা আছে ওপরে।
ভদ্রলোকের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখছি। এটা হলো কনসার্ট হল। বহু দু®প্রাপ্য বাদ্যযন্ত্রের জন্য এই কনসার্ট হলটি বিখ্যাত। রোববার বিকেলে চলে আসুন ওই দিন কনসার্ট বসবে। তাল্লিনকে বলে ইউরোপের সংস্কৃতির পীঠস্থান। গান তাদের প্রাণ। পাঁচ বছর অন্তর সারা দেশ জুড়ে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, তার নাম সং ফেস্টিভ্যাল। তাতে ৩৪ হাজার গায়ক-গায়িকা নর্তক নর্তকী অংশগ্রহণ করে।
বললাম রিগাতেও এই অনুষ্ঠানের কথা শুনে এসেছি। ভদ্রলোক বললেন আমরা গান গেয়ে একটা বিপ্লব করে ফেললাম। তার নাম সিংগিং রেভল্যুশন। কীরকম? সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনতা থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য আমরা দীর্ঘ পথ পার হয়ে এসেছি। আমরা চৌমাথার পথের ধারে এক মনোরম উদ্যানের গায়ে লাগানো বাস স্টপেজের আশ্রয় বসলাম। ব্যস্ত রাস্তা। পথচারীদের দৃষ্টিজালে জড়িয়ে বসে আছি। সবাই দেখছে আমাকে। কেউ সোজা সরল দৃষ্টিতে কেউ বক্রদৃষ্টিতে। কেউ কেউ মিটিমিটি হাসে কেউ বা কাছে এগিয়ে আসে।
‘ইনদিস্কি? দা’ (হ্যাঁ)। ওচেন ক্রাসিবাইয়া সত্রানা (খুব সুন্দর দেশ )। পুরনো সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত সব দেশেই রুশ ভাষা বেশ চলে। তাতেই আমার সুবিধা। চর্চা না থাকলেও একেবারে ভুলে যাইনি। বসে বসে যাত্রীদের ওঠানামা দেকতে দেখতে একসময় একটা ট্রলিবাসে উঠে পড়ি উদ্দেশ্যহীনভাবে। কতদুর যায় দেখি। এই পথেই তো আবার ফিরে আসবে।
উঠে, পরে বুঝলাম- বড় ভুল হয়েছে। লাটভিয়ার মতো এ দেশেও কার্ড প্রথা। আগে থেকে কার্ড কিনে গাড়িতো উঠতে হবে। কনডাক্টর নেই। পাশে বসা যাত্রীকে জিজ্ঞাস করি। ড্রাইভারকে কত ভাড়া দিতে হবে? বললেন আপনি তো সিনিয়র সিটিজেন। আপনার ভাড়া লাগবে না।
পথের দু’ধার দেখতে দেখতে চলছি। হঠাৎ দৃষ্টি আটকে গেল একটা দোকানের সাইনবোর্ডের ওপর Hrishy Ayurveda। কী ব্যাপার। যেন ইন্ডিয়ার গন্ধ পাচ্ছি। পরের স্টপেজে নেমে পড়লাম। জোরকদমে ফিরে এলাম সেই দোকানে। এক যুবক দোকানের সামনে দাড়িয়ে প্রচারপত্র বিলি করছে।
নমস্তে জি। কাঁহা সে? কলকাতা। যাইয়ে। ভিতরসে যাইয়ে।
ভিতরে ঢুকলাম। ভারতীয় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাকেন্দ্র। আয়ুর্বেদিক ওষুধ বিক্রি হয় যোগাসন শেখানো হয়। ওষুধের বিজ্ঞাপন যোগ ব্যায়ামের ছবি পোস্টার দিয়ে সাজানো হয়েছে। এক দক্ষিণ ভরতীয় চিকিৎসকের ইউরোপের দেশগুলোতে আয়ুবেদিক চিকিৎসার প্রচার এবং প্রসারের এই প্রথম উদ্যোগ।
সাবাস ভাই। চালিয়ে যাও। আসবেন আবার।
বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে।
হাঠতে হাটতে চৌমাথা। সেখান থেকে মন্দিরপাড়ায় ফিরে এলাম। ট্রলিবাসের শেষ প্রান্তে আর যাওয়া হলো না। পপাড়ার হরিপথগুলো অনেকটা আমাদের পাড়ার মতো কিন্তু পথে কোনো লোক নেই। গোটা পাড়াই যেন ঘুমিয়ে আছে। এমনটা আমরা দেখতে অভ্যস্ত নই। ভালো লাগে না। ঘরে ফিরে আসি।
খাওয়ার সময় অনেকের সঙ্গে পরিচয় হলো। জানা হলো এ শহরে কী কী দেখার আছে। সবাই বললেন, তাল্লিনকে দেখতে হলে আপনাকে ওল্ড তাল্লিন শহরে যেতে হবে। রিগাতেও তো তাই দেখে এলাম। যা কিছু দর্শনীয় সব ওল্ড রিগায়।
মিস্টার লেনা বললেন, চলুন কাল সকালে অফিস যাওয়ার পথে আপনাকে ওল্ড তাল্লিন নিয়ে যাব।
খাওয়া সেরে ঘরে এসে হিটার জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে যোগব্যায়াম প্রাতরাশের পর মিস্টার লেনার সঙ্গে বের হলাম। হাঁটতে হাঁটতে চলেছি গতকালেন পথ দিয়েই। সেন্ট নিকোলাস গির্জা পেরিয়ে আয়ুর্বেদিক ওষুধের দোকান ছাড়িয়ে চলেছি। অন্য এক পথে একটা বাড়ি দেখিয়ে লেনা বললেন ওই বাড়িটা হলো মিউজিয়াম অব অকুপেশন। অবশ্যই দেখবেন। মিউজিয়াম অব অকুপেশন রিগাতে দেখে এসেছি। এখানেও আছে?