ফাহমিদা হক
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার এক বিখ্যাত জেলখানা আলকাট্রাজ। বিখ্যাত না বলে কুখ্যাত বলাটাই বোধ হয় বেশি যুক্তিসংগত হবে, কেননা একসময় বাঘা বাঘা সব কয়েদিকে বন্দী করা হতো এখানে। সানফ্রান্সিসকো উপসাগরের মাঝে ছোট্ট এক দ্বীপ ‘দ্য রক’। এখানেই রয়েছে সেই কয়েদখানা। সাগরের ভয়ংকর আর উত্তাল ঢেউ সাঁতরে কয়েদিদের পালিয়ে যাওয়াটা ছিল প্রায় অসম্ভব। ১৯৩৪ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যে মোট ১৪ বার এখান থেকে পালানোর ঘটনা ঘটেছে। পলাতকদের সবাই হয় ধরা পড়েছে, নয়তো প্রাণে মারা পড়েছে।
কিন্তু ১৯৬২ সালের ১১ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর আর রহস্যময় জেল পালানোর ঘটনা ঘটে। আলকাট্রাজের দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা বলয়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায় এর তিন বাসিন্দা। জন অ্যাংলিন, তার ভাই ক্ল্যারেন্স অ্যাংলিন আর তাদের আরেক সঙ্গী ফ্রাঙ্ক মরিস। ভীষণ চালাকি আর দক্ষতার সঙ্গে বোকা বানায় জেলখানার সব প্রহরী আর কর্মচারীদের।
জেল থেকে পালানোর পরিকল্পনা বোধ হয় শুরু হয় অনেক আগে থেকেই। নিজেদের কামরার বেসিনের নিচ দিয়ে পরিত্যক্ত এক পাইপ বরাবর সুড়ঙ্গ বানানোর কাজ শুরু করে, তাও আবার চামচ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে! বানানো হয় কাগজের তৈরি তিনটি মাথাও। পালানোর দিন সেগুলো এমনভাবে কম্বল মুড়ি দিয়ে রাখা হয়, যেন দেখলে মনে হয়, তারা নিজেরাই বিছানায় শুয়ে আছে। বিষয়টি আরো বেশি বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য তারা নিজেদের চুলও কাগজের মাথাগুলোতে লাগিয়ে দেয়। রাতে জেলখানার ভেতরের সব বাতি নিভে যাওয়ার পর পাইপ বেয়ে নিজেদের রুমের বাইরে আসে তিনজন। এরপর রান্নাঘরের চিমনি বেয়ে বেরিয়ে আসে কারাগারের বাইরে।
এর পরের অংশটিই ছিল সবচেয়ে কঠিন আর এখন পর্যন্ত রহস্যে ঢাকা এক ঘটনা। দ্বীপের উত্তর-পূর্ব দিকের তীর বেয়ে তারা নিজেদের বানানো ছোট্ট এক ভেলায় চেপে ভেসে যায় সাগরের বুকে। আর সেই ভেলা তারা বানিয়েছিল চুরি করা ৫০টিরও বেশি রেইনকোট দিয়ে। রেইনকোটে বানানো সেই ভেলা আবার পানিতে ভাসিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয় একটি বাদ্যযন্ত্র দিয়ে! জেল থেকে পালানোর জন্য তিনজনের এমন দারুণ বুদ্ধিকে খোদ এফবিআই পর্যন্ত ‘অনবদ্য এক পরিকল্পনা’ হিসেবে আখ্যা দিতে বাধ্য হয়।
কিন্তু ঘটনার এখানেই শেষ নয়, তিন কয়েদি পালানোর পর যেন বেমালুম হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। চলল টানা ১৭ বছর ধরে জোর তল্লাশি। এর পরেও যখন তিনজনের একজনেরও টিকিটির খোঁজ পাওয়া গেল না, তখন আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের মৃত বলেই ঘোষণা করে এফবিআই কর্তৃপক্ষ। সম্ভবত উত্তাল স্রোতে তারা ডুবে গেছে আর সাগরের ঢেউয়ে লাশ দূরে কোথাও ভেসে চলে গেছে-এমনটিই ধারণা তাদের।
তবে এফবিআই কর্তৃপক্ষের এমন ঘোষণায় মোটেই সন্তুষ্ট নয় অ্যাংলিন ভাইদের স্বজনরা। সম্প্রতি তাঁরা দাবি করেন, তাঁদের কাছে জোরালো প্রমাণ আছে, জেল থেকে পালানোর পর দুই ভাই এখনো জীবিতই আছে। প্রমাণ হিসেবে তাঁরা অ্যাংলিন ভাইদের নিজের মায়ের কাছে পাঠানো ক্রিসমাস কার্ড আর সত্তরের দশকের কোনো একসময়ে তোলা একটি ছবি থাকার কথা জানান। একজন হাতের লেখা বিশেষজ্ঞ কার্ডের লেখা পরীক্ষা করলেও সেটি ঠিক কবে লেখা হয়েছিল তা সঠিকভাবে বলতে পারছেন না। আর তাই অ্যাংলিন ভাইদের স্বজনদের দাবিও নিশ্চিতভাবে মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। অবশ্য তাদের স্বজনদের বদ্ধমূল ধারণা, জেল থেকে সফলভাবে পালানোর পর অ্যাংলিন ভ্রাতৃদ্বয় দক্ষিণ আমেরিকার কোনো এক জায়গায় গা-ঢাকা দেয়, আর সম্ভবত এখন পর্যন্ত তারা সেখানেই আছে।
এদিকে ১৯৬৩ সালে সানফ্রান্সিসকোর উপকূলে পানিতে ভেসে আসে মানুষের কিছু হাড়গোড়। সে সময় সেগুলোকে পালিয়ে যাওয়া তিন কয়েদির বলেই প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়। তবে অ্যাংলিন ভাইদের মৃত এক ভাইয়ের ডিএনএর সঙ্গে সেসব হাড়ের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। আর আরেক কয়েদি মরিসের জীবিত কোনো আত্মীয় না থাকায় সেগুলো তার কি না সে ব্যাপারেও নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি।
তিন কয়েদি পানির স্রোত বেয়ে নিরাপদে পালাতে পেরেছে, নাকি পারেনি-এ ব্যাপারে নিজেদের মত প্রকাশ করেন একজন ডাচ্ পানি বিশেষজ্ঞ। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি এ সিদ্ধান্তে আসেন, যদি তিন কয়েদি আলকাট্রাজ থেকে বেরিয়ে মোটামুটিভাবে রাত সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে ঘণ্টায় এক কিলোমিটার বেগে নৌকা চালাতে পারে, তবে নিরাপদে তীরে ভেড়ানোটা অসম্ভব কিছু নয়। তবে এত দ্রুতগতিতে নৌকা চালানো, তাও আবার রেইনকোট দিয়ে তৈরি, সেটা কতটা যুক্তিসংগত, তা নিয়েও কথা আছে। কম্পিউটারে মডেলের সাহায্যে করা পরীক্ষায় আরো দেখা যায়, যদি এ সময়ে তিনজন সাগর পাড়ি দেয়, তবে সম্ভবত গোল্ডেন গেট ব্রিজের উত্তর পাশে ঠেকেছিল তাদের নৌকা। আর জানা যায়, স্রোতের কারণে সেখান থেকে যেকোনো বস্তুই ভেসে আলকাট্রাজের উত্তরে অ্যাঞ্জেল আইল্যান্ডে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, ঠিক এ জায়গা থেকেই এফবিআই ভেলার কিছু অংশ আর পালানো কয়েদিদের কাপড় উদ্ধার করেছিল অনেক আগেই। আর তাই নতুন এ গবেষণার ফলে তিন কয়েদির বেঁচে পালানোর তত্ত্বটি আরো ভারী হলো বইকি। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ