:: মনু ইসলাম ::
১৩ বছর বয়স থেকে দ্রুত বাড়তে থাকেন জিন্নাত আলী। ১৯ বছর বয়সে এখন ৭ ফুট ১০ ইঞ্চিতে দাঁড়িয়েছেন।
তবে তাঁর বাবা-মা এবং ভাই-বোনদের উচ্চতা ৫ ফুটের কাছাকাছি। জিন্নাত আলীর বাড়ি কক্সবাজারের রামুতে। জায়গাটি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারির গর্জনিয়া বড় বিল এলাকার কাছে। এই এলাকার সব যোগাযোগও বান্দরবানের সঙ্গে। বাইশারিতেই জিন্নাতের স্কুল, খেলাধুলা, বেড়ে ওঠা। জিন্নাত বলেন, ‘১৩ বছর বয়সে ছিলাম ৪ ফুট। তখন বুঝতে পারি, প্রতিদিনই আমার উচ্চতা বাড়ছে। ১৪ বছর নাগাদ ৫ ফুট, ১৫ বছরে ৬ ফুট হয়ে যাই। এর পর শুধু বাড়ছি আর বাড়ছি। এ সময় খিদে বেড়ে যায়। প্রচুর খাই। কাজও করি। গরু চরাই। ক্ষেতে কাজ করি। ধান কাটি। বড় বড় বোঝা কাঁধে করে বাড়ি নিয়ে আসি। সবাই তাকিয়ে থাকে। সমীহ করে। এর মধ্যে তিন বছর আগে হঠাৎ মাথায় ব্যথা অনুভব করতে থাকি। দুর্বল দুর্বল মনে হয়। শুয়ে শুয়ে থাকি। পায়ের পাতায় ফাটল দেখা দেয়। শক্তি কমতে থাকে। এখন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি না। কোমর ও হাঁটুতে ব্যথা করে। শরীর কাঁপে। মাথা ঘোরায়। কোনো কাজ করতে পারি না। বিনা কাজে মা-বাবার ভাত ধ্বংস করছি। ’
উচ্চতা এখন দুঃখের কারণ
জিন্নাতের উচ্চতার খবর অন্য সবার জন্য রোমাঞ্চকর হলেও এখন আর তাঁকে আনন্দ দেয় না। প্রায়ই লোকজন আসে তাঁকে দেখতে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। দাঁড়াতে হয়। ছবি তুলতে হয়। হাঁটতে হয়। এসব করতে এখন আর ভালো লাগে না, অথচ কেউ অনুরোধ করলে না করেও পারেন না। কিন্তু দাঁড়াতে-হাঁটতে তাঁর অনেক কষ্ট।
বেশি লম্বা হওয়ায় পরনের লুঙ্গি, পায়ের জুতা নিয়েও সমস্যা। দর্জির দোকান থেকে লম্বা জামা বানানো গেলেও সাড়ে ৫ ফুট প্রস্থের লুঙ্গি কিংবা ১৪ ইঞ্চি পায়ের মাপে জুতা মিলে না। তাই থাকতে হয় খালি পায়ে।
শারীরিক শক্তির কারণে একসময় ফুটবল খেলার মাঠ, বলীখেলাসহ সব প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে পুরস্কার জিতে নিতেন। কিন্তু এখন তিনি ক্লান্ত, অবসন্ন। বয়ে বেড়াতে পারছেন না বিশাল এই দেহের ভার। কাজ করতে অক্ষম মানুষটি এখন পরিবারের বোঝা। জিন্নাত আলীর বাবা আমির হামজা জানান, ‘এমন একটা সময় ছিল, ৭ কানি (প্রায় ৩ একর) ধানের জমি জিন্নাত একাই চাষ করে ফেলত। এখন শুয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না। ’ মা সাফুরা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে দেশের সবচেয়ে লম্বা। কিন্তু এটি এখন আমাদের আর সুখ দেয় না। দিনের পর দিন ছেলের কষ্ট দেখে চিন্তায় থাকি। চাহিদা অনুযায়ী খাবার দিতে পারি না। তার শরীর অটুট থাকবে কী করে?’
জিন্নাত বললেন, ‘আর পারি নারে ভাই। দাঁড়াইতে পারি না। খাইতেও পারি না কোনো কিছু। তাই শক্তি পাই না। শরীরে রোগ। ডাক্তার বলেছেন, আমার মাথায় টিউমার। ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। মা-বাবা দুইবেলা খাবার জোগাতে পারেন না। চিকিৎসা করাবেন কী করে?’
লম্বা মানুষটা সামর্থ্যে কত খাটো!
তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে জিন্নাত তৃতীয়। বোনটি সবার ছোট। বছর দশেক আগে বড় ভাই মারা যায়। দ্বিতীয় ভাই বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। তাঁর ছোট্ট মেয়েটিই এখন জিন্নাতের সব সময়ের সঙ্গী। কেউ জিন্নাতের সঙ্গে দেখা করতে এলে সঙ্গে সঙ্গে থাকে। দেশের দীর্ঘতম মানুষের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ওদের বাড়ির উঠানে। একচিলতে উঠানের ৩ দিকে নানা গাছের সারি। একদিকে টিনের চালা এবং চিরাই কাঠের বেড়ার লম্বা ঘর। সবাই এ ঘরেই থাকেন।
সাংসারিক অবস্থা বুঝতে ঘরের ভেতর ঢোকার দরকার নেই। বাইরে থেকেই বোঝা যায়, দেশের সবচেয়ে লম্বা মানুষটির পরিবার সামর্থ্যের দিক থেকে কতটা খাটো। কিন্তু অনেক দিন বাঁচতে চান জিন্নাত। তাঁর সুচিকিৎসা দরকার। দরকার মাথার টিউমার অপারেশন। শরীর অনুযায়ী খাবার পেতে চান তিনি। জিন্নাত বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতা পেলে আবার সুস্থ জীবনযাপন করতে পারব। ’
জিন্নাতের শরীরের অতি বাড়ার কারণ নিয়ে কথা হয় কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে। তাঁরা জানান, তাঁর দেহের গ্রোথ হরমোনটি অতি মাত্রায় থাকায় দ্রুত লম্বা হয়ে যাচ্ছেন তিনি। এ ছাড়া টিউমারের কারণেও এমনটি ঘটতে পারে। চিকিৎসকরা বলেছেন, টিউমার থাকার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ পৃথিবীর অন্য দীর্ঘকায় মানুষগুলোর অনেকেরই মাথায় টিউমার ছিল।
বাংলার অতি-মানবেরা
৭ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার ইউনুস মিয়াকে একসময় বাংলাদেশের দীর্ঘতম মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার হালিরা গ্রামে ১৯৪৭ সালে ইউনুস মিয়ার জন্ম। ১৯৯৯ সালের ২ আগস্ট মারা যান। রেকর্ডপত্রে তাঁর মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কারণ না থাকলেও স্থানীয়রা বলেছেন, তাঁরও হয়েছে অস্বাভাবিক মৃত্যু। উচ্চতার প্রতিযোগিতায় তাঁকে ছাপিয়ে শীর্ষে উঠে আসেন পরিমলচন্দ্র বর্মণ নামের আরেক বাংলাদেশি। তাঁর উচ্চতা ছিল ৮ ফুট ৩ ইঞ্চি। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের সবচেয়ে লম্বা মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পান তিনি। ১৯৬২ সালে জন্ম নেওয়া পরিমলচন্দ্র বর্মণ মারা যান ১৯৯১ সালে। রেকর্ডপত্র থেকে জানা যায় তাঁর পিটুইটারি গ্রন্থিতে একটি টিউমার ছিল এবং অস্বাভাবিক বৃদ্ধির সময় থেকে তিনিও অপুষ্টিতে ভুগছিলেন। লন্ডনের বার্থলমিউ হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়েও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। সৌজন্যে : কালের কন্ঠ