Skip to content

কমলগঞ্জে হামহাম জলপ্রপাত

Hamham দিগন্ত সৌরভ
নির্যাস সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক ও নির্মাতা ইসলাম জাভেদের পরিকল্পনায় ঠিক হয়েছে হামহাম অভিযানের দিন তারিখ। তিনিই এ ভ্রমণের কো-অর্ডিনেটর ও টিম লিডার। তাই সকাল থেকে একজন একজন করে সবাইকে ফোন করে জাগিয়ে দিচ্ছেন। তাড়াতাড়ি বের হয়ে নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত থাকার জন্য। সকাল ছয়টার মধ্যেই আমি রতুলী বাজারে হাজির হয়ে দেখি, টিম লিডারসহ আরও তিনজন বসে আছেন। এ তিনজনের মধ্যে দু’জন এসেছেন সিলেটের গোলাপগঞ্জ থেকে। বাকি একজন আজিমগঞ্জ থেকে। সব মিলিয়ে এখন আমরা চারজন বসে অপেক্ষা করছি। মাইক্রোবাস ঠিক করে নিয়ে আসার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে প্রিন্স ভাইকে। তিনি বড়লেখা থেকে বাকি সফরসঙ্গীদের সঙ্গে করে আমাদের এখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা। অপেক্ষা করার বেশ কিছুক্ষণ পর মাইক্রো রতুলী বাজারে এসে থামে। সবাই যার যার সিটে বসে পড়ি।
Hamham2চলতে থাকে আমাদের মাইক্রোবাস। এই টিমে আরও কয়েকজন সদস্য যুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও হামহাম পাহাড়ের জোঁক, সাপ, দুর্গম ও বিপদ সংকুল রাস্তা, দীর্ঘ পথ হাঁটার ভয় ইত্যাদি কারণ শেষ পর্যন্ত তারা তাদের যাত্রা বাতিল করে দেন। এরপরও সদস্য সংখা ১০ জনে এসে ঠেকল। ড্রাইভার বাদে গাড়িতে আছেন টিম লিডার ইসলাম জাভেদ, শহীদ উল-ইসলাম প্রিন্স, এমএ জব্বার, জাকির বিন হাফিজ, মীর মনিরুজ্জামান এবং আমি। বাকি দু’জন হলেন রিদওয়ান ভাই ও ফাহাদ। তারা সিলেট থেকে ট্রেনে রওনা দিয়েছেন। শ্রীমঙ্গল নেমে কমলগঞ্জ এসে তারা আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন। ইতোমধ্যে আমরা কমলগঞ্জের আদমপুর চলে এসেছি। সেখানে গাড়ি থামিয়ে সকালের নাশতা করার জন্য খাবারের দোকান খোঁজা হয়। অবশেষে ছোটখাটো একটি খাবারের দোকান পেয়ে যাই। গরম পরোটা আর ভাজি দিয়ে নাশতা সারি। তারপর গরম গরম চা খেয়ে আবার রওনা হই। বেশ কয়েক কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পেরিয়ে চম্পা রায় চা বাগানে পৌঁছি। সেখানটা সাপ্তাহিক ছোট বাজার। তার পাশেই একটি শিবমন্দির। মণ্ডপের সামনে গাড়ি থামিয়ে সবাই নেমে পড়ি।
টিম লিডার ৪০ মিনিটের বিরতি দেন। তার কারণ হল রিদওয়ান ভাই ও তার বন্ধু আসতে দেরি হচ্ছে। তারা এখানে আসা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এখানে গাড়ি রেখে হামহাম পর্যন্ত আমাদের সম্পূর্ণ হেঁটে যেতে হবে। হাঁটা রাস্তার জন্য কিছু শুকনো খাবার যেমন বিস্কুট, চানাচুর, চিপস, চকোলেট ইত্যাদি কিনে কয়েকজনের ব্যাগে রাখি। এরই মধ্যে একজন গাইড ঠিক করা হয়। হামহামকে কেন্দ্র করে এখানে অনেকে পর্যটকদের গাইড দেয়াকে ফুল টাইম পেশা হিসেবে নিয়েছে। আমাদের টিমে যে গাইড ঠিক করা হয়েছে তার নাম বিধান।
Hamham3আমাদের গাইড বিধান জানাল, দীর্ঘ হাঁটার পথ। শুধু বিস্কিট চানাচুরে হবে না। কিছু কলা নিতে পারলে খুব ভালো হতো। আমরাও ভাবলাম আইডিয়াটা খুব ভালো। বিধানের সঙ্গে দু’জনকে দিয়ে কলা কেনার জন্য পাঠানো হল। রাস্তার পার্শ্ববর্তী একটি বাড়ি থেকে সে বাগানের বেশ কিছু তাজা পাকা কলা কিনে নিয়ে অসে। প্রথমে চা বাগান ঘেরা কলাতলী ফাঁড়ি এলাকা দিয়ে আমরা প্রবেশ করি। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি কয়েকটি কিশোর ভ্রমণকারীদের কাছে বিক্রির জন্য বাঁশের তৈরি লাঠি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। এ লাঠিতে ভর করে উঁচু নিচু পাহাড়ি পথে হাঁটতে বেশ সুবিধা হয়। এরই মধ্যে হঠাৎ করে একটি সিএনজি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। হুড়মুড় করে রিদওয়ান ভাই ও তার বন্ধু নেমে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। বেশ কয়েকটি লাঠি কেনা হয়। যে কেউ দেখলে ভাববে চর দখলকারী একটি লাঠিয়াল বাহিনী। পাহাড়ি গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি। রাস্তার দুই পাশে ধান খেত। তার বুক চিরে চলে গেছে মেঠো পথ।
আরও বেশ কিছু পথ হেঁটে যাওয়ার পর গহীন বনের ভেতরে প্রবেশ করি। সেখানে একটা পাথরের বোর্ডে খোদাই করে লেখা দেখতে পেলাম। এ পাহাড়ের কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য। সারি বেঁধে আমরা এগিয়ে যেতে থাকি। জালি বেতের ঝোপ এতই গা ছমছমে যে, ভয়ে যে কারোরই রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার ঝাপের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে। আমাদের দলের আরেক সাহসী বীর পুরুষ প্রিন্স ভাই। বনের ভেতর যে এত অন্ধকার হবে তিনি ভাবতেই পারেননি। তাইতো ভয় পেয়ে হাতের লাঠি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রলাপ বকছেন। শুধু স্থির ছবি ও ভিডিও ধারণের জন্য আমি আর জব্বার ভাই হাঁটছি সবার পেছনে। দু’জনে পালাক্রমে ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও এবং স্টিল শুট করি। তাই প্রায় দেখা যায় আমরা সবার পেছনে পড়ে যাই। এ অরণ্যের চারপাশে ছড়িয়ে আছে, বিচিত্র প্রজাতির সব গাছ, গুল্ম, তরু-লতা, অর্কিড, বিশাল জালিবেতের ঝোপ। পুরো বনের ভেতর এলাকা এতই অন্ধকার যে হঠাৎ মনে হবে সন্ধ্যা বুঝি ঘনিয়ে এলো।
এখানে জোঁক এবং সাপের বেশ উৎপাত। বিশেষ করে গরমকালে। তবে আমাদের ভাগ্য ভালো এজন্য যে, শরৎকালে এসেছি। তাই জোঁক বা সাপ আমাদের কাউকেই আক্রমণ করতে পারেনি। আরও কিছু পথ হাঁটার পর একটা লেকের দেখা পাই। বাঁশ ও লম্বা গাছ ফেলে তার ওপর দিয়ে সাঁকো করে পথ তৈরি করা হয়েছে। পারাপারের জন্য। লেকের টলটলে পানির আকার-অবস্থা দেখে বোঝা গেল এখানে বেশ ভালো জিওল মাছ থাকতে পারে। সত্যিই আমার আইডিয়া সঠিক বলে জানলাম গাইড বিধানের কাছে থেকে। এভাবে আরও কয়েক কিলোমিটার গিয়ে খাবারের বিরতি নেয়া হয়। কলা, বিস্কিট, রুটি দিয়ে নাশতা সারি। সময় তখন সাড়ে বারোটা।
খাবারের ৫-১০ মিনিটের পর আবার রওনা হই। কিছুদূর সামনে গিয়ে বেশ নিচু একটি ঢালুপথ পাড়ি দিয়ে হামহামের ছড়ায় নামি। এরপর ঝিরিপথ পথ দিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে থাকি। বড় বড় পাথরের ফাঁক গলে হিমশীতল জলরাশি বয়ে চলছে পাহাড়ি ছড়া দিয়ে অজানা পথে।
Hamham4ছড়ায় নামার পর লাঠি দিয়ে পানির গভীরতা পরিমাপ করে আমাদের এগোতে হয়। মধ্য পথে ছড়ার পানির গভীরতা অনেক বেশি ওপর দিয়ে বেশ কিছুপথ হেঁটে যাওয়ার পর হাতের লাঠি অনেক গভীর পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। তার মানে ছড়ায় হেঁটে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। পিচ্ছিল খাড়া পাহাড়ের কিনার ঘেঁষে চলতে থাকি সারিবদ্ধভাবে। একটু এদিক-ওদিক হলেই নিচে পড়ে যাওয়ার ভয়। তাই প্রতিটি কদম খুবই সাবধানে ফেলতে হচ্ছে। আমাদের টিমের একেকজন সদস্য এই ১০-১২ কিলোমিটার পহাড়ি উঁচু নিচু, গিরি, ঢালু পথে হাঁটার কারণে চোখমুখ গজার মাছের মতো লাল হয়ে গেছে। এভাবে আরও প্রায় চল্লিশ মিনিট এগোনোর পর হামহামের জলপ্রপাতের শাশা শব্দ কানে আসে। আর তখনই সবাই আনন্দে চিৎকার শুরু করি।
প্রায় দেড়শ’ ফুট ওপর থেকে জলধারা আছড়ে পড়ে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে হামহাম জলপ্রপাত। যেখানে জলের ধারা অবিরাম পড়ছে, সেই জায়গাটিতে মাধবকুণ্ডের মতো কোনো সুড়ঙ্গ নেই বলে ভয়েরও কারণ নেই। ইচ্ছা মতো গোসল করে জলকেলি করে দেহ-মন জুড়ানো যাবে। পাহাড়ের বুক দিয়ে একে বেকে ভেসে আসা হামহাম ঝর্ণার জল এতই ঠাণ্ডা যে, সারা দিন গোসল করতে ইচ্ছা করছিল।

হামহামের অবস্থান
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার কুরমা বন বিটের আওতাধীন বাংলাদেশের শেষ সীমান্ত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের লাগোয়া স্থানে হামহাম জলপ্রপাতের অবস্থান। এখানটায় সম্পূর্ণ হেঁটে যাতায়াত করতে হয়। তাই শিশু ও বয়ষ্ক কোনো ব্যক্তি নিয়ে ভ্রমণে আসা ঠিক হবে না।

যাতায়াত
ঢাকা থেকে হামহাম যেতে হলে ট্রেনে অথবা বাসে প্রথমে শ্রীমঙ্গলে নামতে হবে। ট্রেনে ভাড়া পড়বে প্রথম শ্রেণী এসি ৪০০ টাকা, শোভন চেয়ার ২৪০ টাকা, বাসে সাধারণ ৩০০ টাকা, এসি ৬০০ টাকা। সেখান থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরেই কমলগঞ্জ। কমলগঞ্জ থেকে সিএনজি অথবা জিপ গাড়িতে করে চম্পারায় চা বাগান যেতে হবে। সেখান থেকেই গাইডের সহযোগিতা নিয়ে হামহাম যেতে হবে। থাকার জন্য কমলগঞ্জে তেমন ভালো হোটেল নেই। তবে শ্রীমঙ্গল বিভিন্ন মানের হোটেল থেকে পাঁচতারকা হোটেল পর্যন্ত রয়েছে। সূত্র : যুগান্তর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *