Skip to content

কর্ণফুলী, কাপ্তাই আর ঝুলন্ত সেতুর দিন

:: এ এস এম শাহীন ::

চট্টগ্রাম থেকে সকালের নাশতা সেরে মাইক্রোবাসে যাত্রা শুরু করলাম কাপ্তাইয়ের পথে। উদ্দেশ্য, সারা দিন ঘোরাঘুরি করে রাঙামাটিতে রাত্রিযাপন ও পরের দুই দিন শীতকালে কাপ্তাই লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করা। আধা ঘণ্টায় শহরের সীমানা ছাড়িয়ে হালদা নদীর ওপর মদুনাঘাট সেতু পেরিয়ে আমাদের প্রথম গন্তব্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পরিচালিত প্যানোরমা জুম রেস্তোরাঁ ও কায়াক ক্লাব। খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় থেকে কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে মিলে যাওয়া ৮১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই হালদা নদী আমাদের দেশের কার্পজাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননকেন্দ্র।

জুম রেস্তোরাঁয়

কুয়াশাঘেরা সুন্দর প্রকৃতির বুক চিরে মসৃণ সড়কে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) পার হয়ে আরও এক ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম জুম রেস্তোরাঁয়। অনেকক্ষণ ধরেই কর্ণফুলী নদীর পাশাপাশি পাহাড়ি পথে চলছিল আমাদের গাড়ি। কিন্তু রেস্তোরাঁ থেকে দিক পরিবর্তন করা নদীর দৃশ্য এককথায় অসাধারণ। দর্শনার্থীদের জন্য নির্ধারিত টিকিট কেটে যে কেউ এখানে এসে কর্ণফুলী নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন, নিতে পারেন নির্ধারিত মূল্যে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও কায়াক ভ্রমণের সুযোগ। রাতযাপনের জন্য কয়েকটি কটেজও আছে এখানে, আছে সুলভে আহারের ব্যবস্থা।

বৃহস্পতিবার সকালে এই রেস্তোরাঁয় আমরাসহ হাতে গোনা কিছু দর্শনার্থী থাকায় অনেকক্ষণ নিরিবিলিতে বসে থাকলাম। পাহাড়ি পরিবেশে নানা ধরনের পাখির ওড়াউড়ি, প্রবহমান নদী আর রঙিন সব কায়াক নিয়ে কিছু মানুষের অ্যাডভেঞ্চার দেখা, আমাদের মতো শহুরে মানুষদের খুব বেশি সুযোগ আসে না, তাই প্রাণভরে উপভোগের চেষ্টা করলাম। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান নদী কর্ণফুলী ভারতের মিজোরামে উৎপন্ন হয়ে ২৭০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। আমাদের প্রধান বন্দরের প্রাণ এই নদী।

এই কায়াক ক্লাবে পর্যটকদের জন্য ঘণ্টাভিত্তিক নির্ধারিত মূল্যে স্বচালিত কায়াকসহ বিভিন্ন আসনের ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া নিয়ে কর্ণফুলী নদীতে নৌভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। আমরা এমন একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক কুয়াশাঘেরা কর্ণফুলীতে ঘুরে বেড়ালাম। রংবেরঙের কায়াক নিয়ে অনেককেই ঘুরতে দেখে আমার মেয়ের ইচ্ছা সেটায় ওঠার। তাকে আশ্বস্ত করলাম, আমরাও কায়াকিং করব তবে আজকে কর্ণফুলী নদীতে নয়, আগামীকাল কাপ্তাই লেকে।

স্থানীয় খাবারের সন্ধান

প্যানোরমা জুম থেকে বের হয়ে একটু সামনে এগিয়ে আমাদের ড্রাইভার মোস্তাক ভাইয়ের পরামর্শমতো স্থানীয় খাবারের খোঁজে ফ্লোটিং প্যারাডাইস হোটেলে ঢুকে চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার জোগাড়। হোটেলের একদিকে সড়ক কিন্তু অন্যদিকে খাবার টেবিল ও সংলগ্ন বারান্দা থেকে প্রবহমান নদীর অসাধারণ ভিউ। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, সঙ্গে নানা পদের ভর্তা দিয়ে শুরু করে, চাপিলা ও রুই মাছ ভাজি, কাঁচকি মাছের পাকোড়া, দেশি মুরগি আর ডাল দিয়ে মনে রাখার মতো মধ্যাহ্নভোজ, তারপর মগভর্তি চা নিয়ে আবার বারান্দায়, কুয়াশাঘেরা নদী দেখা।

ঝুলন্ত সেতুর রাঙামাটি

এরপর গাড়িতে উঠে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান পার হয়ে ২০ মিনিটে কাপ্তাই জেটিঘাটে পৌঁছালাম। জাতীয় উদ্যানঘেঁষা এই রাস্তা আমার দেখা বাংলাদেশের অন্যতম সেরা। জেটিঘাটে অনেক নৌকা পাওয়া যায়, যারা আপনাকে কাপ্তাই বাঁধের কাছাকাছি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। বলে রাখা দরকার যে কাপ্তাই বাঁধ সংরক্ষিত এলাকা, তাই বেশি কাছে যেতে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়।

১৬টি ফটক নিয়ে ৬৭০ দশমিক ৮ মিটার দীর্ঘ, ৫৮ দশমিক ৭ মিটার উচ্চতা ও ৪৫ দশমিক ৭ মিটার প্রস্থের এই বাঁধ পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের উদ্দেশ্যে কাপ্তাই লেকের পানি সংরক্ষণের জন্য তৈরি। ব্রিটিশ ভারতের সময় থেকে বিভিন্ন সমীক্ষা শেষে ১৯৫১ সালে কাপ্তাইয়ের এই স্থান চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয় এবং ১৯৫৭ সালে কাজ আরম্ভ হয়ে ১৯৬২ সালে এর উদ্বোধন করা হয়। প্রাথমিকভাবে ৪০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে শুরু হলেও তিন দফায় বেড়ে ১৯৮৮ সালে তা ২৩০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। এই বাঁধের মাধ্যমে ২২০ বর্গকিলোমিটার জায়গা নিয়ে কাপ্তাই লেকের সৃষ্টি, যা আমাদের দেশের মিঠাপানির মাছের একটি বড় উৎস। গড় ৩০ মিটার ও সর্বোচ্চ ১৫০ মিটার গভীরতার এই বিপুল জলরাশি রাঙামাটি জেলার সাতটি উপজেলার মধ্যে পাঁচটির সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায়।

আমাদের ইচ্ছা ছিল কাপ্তাই থেকে লেকসংলগ্ন রাস্তা ধরে আসাম বস্তি ব্রিজ হয়ে রাঙামাটি যাওয়ার। কিন্তু কোনো একটা ব্রিজ মেরামতের জন্য রাস্তা বন্ধ থাকায় আমাদের আবার জুম রেস্তোরাঁ অতিক্রম করে বড়ইছড়ি হয়ে চট্টগ্রাম রাঙামাটি সড়কে উঠতে হলো। এই আপাত ভোগান্তি শাপেবর হয়ে উঠল বড়ইছড়ির শান্ত পাহাড়ি পরিবেশের আঁকাবাঁকা অথচ খুবই সুন্দর রাস্তা আর প্রকৃতি দেখে। কাপ্তাই উপজেলা কমপ্লেক্স থেকে ঘাগড়া বাজার পর্যন্ত খুবই অল্প জনবসতির এই এলাকা সময় থাকলে অবশ্যই ঘুরে আসতে পারেন।

রাঙামাটি ঐতিহাসিকভাবে পার্বত্য অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক এলাকা, ব্রিটিশ শাসনামলেও কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনা ছিল প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। স্বাধীনতার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো এই রাঙামাটি থেকেই। রাঙামাটিতে চাকমা রাজার রাজবাড়ি, উপজাতীয় জাদুঘর, রাজবন বিহার, ঝুলন্ত ব্রিজ, কাপ্তাই লেকসহ অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। সন্ধ্যার আগেই আমরা ঢাকা থেকে বুক করে রাখা পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সের রুমে উঠে গেলাম। পর্যটনের এখন দুটো বিল্ডিং, একটা রাঙামাটির আইকনিক ঝুলন্ত সেতুর সঙ্গেই পুরোনো দুই তলা ভবন আর নতুনটি পাহাড়ের একটু নিচে নতুন চার তলা ভবন। নতুন ভবনের প্রধান আকর্ষণ, পেছনের বারান্দা, যেখান থেকে কাপ্তাই লেকের অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায়। সেখানে চা খেতে খেতে শীতল বাতাসে সন্ধ্যা নেমে এল। রাতে পর্যটনের রেস্তোরাঁতে রুই মাছ আর ডাল–ভাত খেয়ে ১০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় জবুথবু হয়ে লম্বা ঘুম দিলাম।

কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল

সকালে উঠেই জানালায় চোখ পড়ল। চকচকে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের আভাস, যদিও আগের দিনই ভীষণ কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল। পর্যটন কমপ্লেক্স শহর থেকে দূরে হওয়ার কারণে সকাল ও রাতে একেবারেই নির্জন, যদিও ঝুলন্ত ব্রিজের দর্শনার্থীদের জন্য দিনের বেলা জমজমাট থাকে। বারান্দা থেকে নানা ধরনের পাখির আনাগোনার মাঝে সূর্য প্রখর হতে লাগল। আমরাও নাশতা শেষ করে পুরো কমপ্লেক্স ঘুরে বেড়ালাম, ঝুলন্ত ব্রিজে ফটোসেশন করে কমপ্লেক্সের অপর পাশে ফ্যামিলি কটেজের লাগোয়া লেকের পাড়ে বেঞ্চে বসে নির্জনতা উপভোগ করলাম।

বেলা বাড়তেই ঝুলন্ত ব্রিজের নিচে থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকার বিনিময়ে একটা ইঞ্জিনচালিত নৌকা ঠিক করলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরব আর দুপুরে ‘বেড়ান্যে ক্যাফে’তে লাঞ্চ করব। প্রথমেই আমরা গেলাম পলওয়েল পার্কের উদ্দেশে। সম্প্রতি এই পর্যটন স্পটটি আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। রাতের বেলা আলোকসজ্জিত এই পার্ক আমাদের হোটেলের বারান্দা থেকেও মোহনীয় লাগে। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি শেষে আবার নৌকায় উঠে উল্টো দিকে বেড়ান্যে ক্যাফের দিকে চলতে শুরু করলাম। শীতকালে কাপ্তাইয়ের পানিতে অনেক পাখির আনাগোনা। একেকটা পাখির দল নৌকার ইঞ্জিনের শব্দে বিরক্ত হয়ে স্থান পরিবর্তন করছিল। আমরাও সুযোগ পেয়ে নৌকা আস্তে চালাতে বলে তাদের মন ভরে দেখছিলাম। প্রায় এক ঘণ্টা পর কায়াকে ভ্রমণরত মানুষ দেখে বুঝতে পারলাম আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেছি।

এই ক্যাফে জল ও স্থল উভয় পথেই রাঙামাটি থেকে আসা যায়। সুন্দর পরিবেশ, কায়াকিং সুবিধা এবং লোভনীয় বাঙালি ও পাহাড়ি খাবারের জন্য এটি অনেক জনপ্রিয়। বলে রাখা দরকার যে এখানে খাবারের জন্য প্রি বুকিং দরকার হয়। তিন দিকে পানিবেষ্টিত এই ক্যাফেতে আপনি চাইলে সারা দিনও কাটিয়ে দিতে পারবেন। খুব তাড়াতাড়ি এখানে রাতযাপনের সুবিধাও চালু হবে বলে জানা গেল। খাবার শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা কায়াকিং শুরু করলাম। বেশির ভাগ কায়াক দুই আসনবিশিষ্ট হওয়ার কারণে আমাদের তিন আসনের কায়াকের জন্য কিছুটা অপেক্ষা করতে হয়েছিল। শান্ত গাঢ় নীল কাপ্তাইয়ের পানিতে কায়াকিং উপভোগের তুলনা হয় না। ক্যাফে থেকে সূর্যাস্তের আগেই আমরা ঝুলন্ত ব্রিজে ফেরত এলাম। রাতে তারা ভরা খোলা ছাদে পর্যটন রেস্তোরাঁর বার-বি-কিউ দিয়ে ডিনার সারলাম।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পর্যটনের মজাদার নাশতা সেরে ১২০ টাকায় আগের রাতে ঠিক করে রাখা সিএনজি দিয়ে সোজা রিজার্ভ বাজারের হানিফ কাউন্টারে এলাম। সকাল সাড়ে আটটায় ছেড়ে হানিফের নন–এসি বাস বিকেল চারটার কিছুক্ষণ আগে আমাদের ঢাকায় নামিয়ে দিল। সৌজন্যে: প্রথম আলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *