Skip to content

কার্জন হল : জ্ঞান সাধনার প্রতীক

শফিকুল ইসলাম
টকটকে লাল রঙের সুরম্য ভবন। সামনে সাজানো বাগান। মাঠে সবুজ ঘাসের সমারোহ। দূর থেকে দেখলে যে কারো মনে হবে এ যেন রাজপ্রাসাদ! কাছে না গেলে কেউ বুঝবে না যে শতাব্দী প্রাচীন এই ভবন নানা সাক্ষী। ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন উপাদান। কালের আবর্তে ভাষা আন্দোলনের অনেক স্মৃতি আমরা হারিয়ে ফেললেও আজো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই ভবনটি। যে ভবনকে ঘিরে বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার অবতারণা। সেই ভবনটি হচ্ছেÑ ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী কার্জন হল। নেই সেই আমগাছ, নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কলাভবন; কিন্তু কার্জন হল যেন স্বমহিমায় জানান দিচ্ছে তার প্রতিবাদের কথা। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছিল ঐতিহাসিক কার্জন হল থেকেই। লাল ইটের আকর্ষণীয় এই অট্টালিকা শুধু শতাব্দীর এই প্রাচীন স্থাপনা নয় এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান সাধনার প্রতীক।

Karjon-Hallকার্জন হল প্রতিষ্ঠার কথা
জানা যায়, ১৯০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রখ্যাত ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড জর্জ নাথানিয়েল কার্জন এই ইমারতের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ১৯০৮ সালে শেষ হয় নির্মাণকাজ। তার নামেই ভবনটির নাম রাখা হয় কার্জন হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রেজিস্ট্রার বিল্ডিং’-এর নথিতে ভবনটির নির্মাণকাল উল্লেখ করা হয়েছে ১৯১২ সাল এবং নির্মাণ ব্যয় মোট দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা। সূত্র (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : স্মৃতি নিদর্শন, ড. আয়শা বেগম- পৃষ্ঠা ৭৭)।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে ঢাকা হয়ে ওঠে নবপ্রতিষ্ঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী। প্রাদেশিক রাজধানীর দফতর বানানো হয় কার্জন হলকে। মূলত টাউন হল হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই কার্জন হল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে এখানে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে ভবনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদে পরিণত হয়। বিজ্ঞানের বেশির ভাগ বিভাগ এ ভবনে রয়েছে। এখনও বিজ্ঞান অনুষদের একাডেমিক ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কার্জন হল।

১৯২১ সালে ভবনের নিচতলায় প্রতিষ্ঠিত হয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ। ডব্লিউ এ জেনকিন্স ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪) বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯২৪ সালে ‘প্লাস্কস অ্যান্ড দি লাইট কোয়ান্টাম হাইপোথিসিস’ নামে তার গবেষণা প্রবন্ধ বিজ্ঞান জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং অচিরেই তা ‘বোস-আইনস্টাইন থিওরি’ নামে সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়। কার্জন হলের পদার্থ বিভাগের ল্যাবরেটরি কক্ষে বসে একনিষ্ঠভাবে সত্যেন বসু গবেষণা করে গেছেন। বিজ্ঞানচর্চার এই পথিকৃৎকে স্মরণীয় করতে তার সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ‘বোস চেয়ার’ স্থাপন করা হয়েছে।

১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান। পাকিস্তানের জনক প্রথম গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। কার্জন হলে আয়োজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ সমবেত শিার্থী তাৎক্ষণিকভাকে ‘না, না’ বলে জিন্নাহর বক্তব্যে ঘোর প্রতিবাদ জানান। আর তখনই ভাষা আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায় কার্জন হলের নাম।

Karjon-Hall2কার্জন হলের অবস্থান
বর্তমানে কার্জন হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। হাইকোর্ট ভবনের দণি দিকে এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটি অবস্থিত। ভবনটির পশ্চিমে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, দেিণ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল। কারুকার্যখচিত বিশাল এ ভবনে রয়েছে একটি বিশাল কেন্দ্রীয় মিলনায়তন। ভবনটির সামনে রয়েছে একটি প্রশস্ত বাগান (বোটানিক্যাল), যেখানে সবুজের বুক চিরে পশ্চিম থেকে পূর্বে চলে গেছে একটি রাস্তা। এর পেছনে রয়েছে একটি বিশাল পুকুর, যার পশ্চিম পাড়ে শেরেবাংলা ফজলুল হক হলের মূল ভবন। এই পুকুর পাড়েই বসে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্বে ১৪৪ ধারা ভাঙার।

কালক্রমে বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পাওয়ায় কার্জন হলের অবয়বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পাশে আরো পাঁচটি একাডেমিক ভবন, ছাত্রদের আবাসিক হল ছাড়াও তিনটি অনুষদের বিভিন্ন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। একাধিক ভবন নির্মাণের ফলে এখানকার ফাঁকা জায়গা কিছুটা কমেছে। তবুও এ ক্যাম্পাসে মূল আকর্ষণ কার্জন হল।

শৈল্পিক স্থাপত্য
দ্বিতলবিশিষ্ট কার্জন হলের প্রধান কক্ষটি তিনতলা বিশিষ্ট। এটি ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য হিসেবে বিবেচিত। ভবনের ভেতরে রয়েছে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা। ভবনটির চারদিকে রয়েছে টানা বারান্দা।

Karjon-Hall3স্থাপত্যবিদদে মতে, উত্তর ভারতে মোগল সম্রাট আকবরের ফতেহপুর সিক্রির নির্মাণে লালচে চুনাপাথর পরিলক্ষিত হয়; তার সাথে সাদৃশ্য রক্ষা করে কার্জন হল নির্মাণে লাল ইটের সাথে রেড-অক্সাইড ব্যবহার করা হয়েছে। ইউরোপ ও মোগল স্থাপত্য রীতির অপূর্ব সংমিশ্রণ। এটি বিশেষ করে পরিলতি হয় অভিপ্তি উত্তর দিকের সম্মুখভাগের অশ্বখুরাকৃতির খাঁজকাটা খিলানের মাঝে। আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যা এবং মোগল কাঠামোর সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে এর খিলান ও গম্বুজগুলো। শুধু তাই নয় গম্বুজগুলো আবার আধুনিক ইসলামি স্থাপত্যবিদ্যারও নিদর্শন। শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও এক বা দুইবার সংস্কার এবং কয়েক বছর অন্তর অন্তর রং করা হয় মাত্র।

বর্তমান কার্জন হল ভবনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাজে ব্যবহার করা হলেও এটি ছাত্রছাত্রীসহ দেশ-বিদেশের পর্যটকদেরও বিনোদনের অন্যতম কেন্দ্র। প্রতিদিন বিকেলে এখানে জমে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী ও দেশ-বিদেশের বিনোদনপ্রিয় হাজারো মানুষদের আড্ডা। রাজধানী শহরের কোলাহলের মধ্যেও সবুজের সমারোহে পূর্ণ কার্জন হল খুব সহজেই পৌঁছে দিতে পারে প্রকৃতির কাছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *