নজরুল ইসলাম
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মালিয়াট ইউনিয়নের বেথুলী গ্রামের উত্তর-পশ্চিম কোণে এশিয়া মহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহত্তম বটবৃটি অবস্থিত। কালীগঞ্জ সদর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার পূর্ব দিকে কালীগঞ্জ-আড়পাড়া-খাজুরা সড়কের ত্রিমোহনী সংলগ্ন স্থানে এ প্রাচীন গাছটি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। গাছটি দেখার জন্য প্রতিদিন দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক কালীগঞ্জের বেথুলী গ্রামে ভিড় করেন।
বটগাছটিকে কেন্দ্র করে পাশেই গড়ে উঠেছে একটি বাজার। বর্তমানে অনেক দোকান আছে এখানে। প্রতি শনি ও বুধবার সাপ্তাহিক হাট বসে। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসে। অনেকের মতে, দিনের বেলায়ও গভীর ছায়ায় প্রায় ঢাকা থাকত বটতলা। বটগাছটির বয়স কমপক্ষে ৩০০ বছর হয়েছে বলে স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়।
মূল বৃক্ষটি সময়ের পরিবর্তনে অনেক ছোট বৃক্ষে বিভক্ত হয়েছে। মোট ৪৫টি উপবৃক্ষ ও ১২ দাগে প্রায় ১১ একর (২.৩৩ হেক্টর) জমি দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণ-পূর্ব পাশের বৃক্ষগুলো জমাটবদ্ধ এবং উত্তর-পশ্চিম পাশে কিছুটা ফাঁকা ছাউনি দিয়ে বেষ্টিত। বৃক্ষটির ৩৪৫টি ঝুরি মাটির সাথে সংযুক্ত এবং ৩৮টি ঝুরি ঝুলন্ত রয়েছে। মূলগাছটি এখন আর নেই।
মাঝখানে কিছু অংশ ফাঁকা এবং চার পাশে শাখা-প্রশাখায় ঘেরা। গাছের নিচে রোদ-বৃষ্টি কিছুই পড়ত না। মাঘের শীতের রাতেও গাছতলায় আবহাওয়া অন্য রকম থাকত। গাছতলায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিত পথিকের দল। এলাকার প্রবীণরা জানান, বর্তমানে সুইতলা নামে কোনো জায়গার অস্তিত্ব না থাকলেও ধারণা করা হয় পথিকেরা এ মনোরম স্থানে শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিত। তখন থেকেই অনেকের কাছে বিশাল বৃটি সুইতলা বটগাছ হিসেবে পরিচিতি পায়। আর সেখান থেকেই এর নামকরণ হয় সুইতলা বটগাছ। বিশাল এ বটগাছটির জন্ম যে কুয়ার পাড়ে, সেটি কোথায় এবং কে খনন করেন তার সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও অনেকের মতে, যে স্থানে কুয়া ছিল ওই জায়গাটি ১৯২৬ সালে রেকর্ডের আগে বেথুলী গ্রামের স্থানীয় ভূষণ সাহা পরিবারের কারো নামে রেকর্ড ছিল। বর্তমানে পুরোটাই সরকারের খাসজমির অন্তর্ভুক্ত।
হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অনেক লোক রোগমুক্তির আশায় এ গাছের নামে মান্নত করে। পাখিদের অন্যতম একটি আবাসস্থল এ বটবৃক্ষটি। কিচিরমিচির শব্দ লেগেই থাকে। অথচ গাছে কোনো পাখি বাসা বাঁধে না। গাছের নিচে পশুপাখি বা প্রাণীর মল-মূত্র দেখা যায় না। বটতলায় কালীপূজার একটি স্থায়ী পাকা বেদি নির্মিত হয়েছে। চাপরাইল গ্রামের গৌরপদ অধিকারী ও হাজারী লাল অধিকারীর আর্থিক সহায়তায় এ বেদি নির্মিত হয়। এ বেদিতে সাড়ম্বরে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। আগে এ গাছতলায় ১৫ দিনব্যাপী রাসপূজা অনুষ্ঠিত হতো এবং এ উপলে মেলা বসত। ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বটবৃ হিসেবে পরিচিত ছিল কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনে সংরতি একটি বটগাছ। এ গাছটি ২.২২ একর জমিজুড়ে বিস্তৃত। পরে ১৯৮২ সালে বিবিসির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রচারিত হয়, কালীগঞ্জ উপজেলার বেথুলী মৌজায় অবস্থিত সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছটি কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনের (শিবপুর) সেই বটগাছটি অপো বড় এবং এটি এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বটগাছ।
সুইতলা বটবৃক্ষটির অবস্থান ও নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। কারো কাছে সুইতলার বটগাছ, আবার কারো কাছে বেথুলী বটগাছ বলে পরিচিত এটি। প্রকৃতপক্ষে এর অবস্থান বেথুলী মৌজায়। প্রায় ৩০০ বছর আগে এই গাছের উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায়নি। তবে অযত্ন, অবহেলা, রণাবেণের অভাব এবং নানামুখী অত্যাচারের কারণে এ ঐতিহ্যবাহী বটগাছের অস্তিত্ব আজ প্রায় বিলিন হতে চলেছে।
বেথুলী গ্রামের বেলায়েত হোসেন মিয়া জীবিত থাকাকালে এ গাছ দেখাশোনা করতেন স্বেচ্ছায়। তিনিই সর্বপ্রথম এখানে একটি দোকান দেন এবং বাজার প্রতিষ্ঠিত করেন। এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বৃহৎ এ বটগাছটির ঐতিহাসিক দিক বিবেচনা করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন দর্শনার্থী আসেন এখানে। গাছটির গুরুত্ব বিবেচনা করে ঝিনাইদহ জেলা পরিষদ বটবৃটির পাশে একটি রেস্ট হাউজ নির্মাণ করে ১৯৯০ সালে। দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পাখির কলরব, ছায়াঘেরা শীতল পরিবেশ মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের। এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারলে বেথুলী গ্রামের এ বটগাছকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠতে পারে পর্যটন কেন্দ্র। সেই সাথে এই বটগাছকে কেন্দ্র করে যে ঐহিত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা আগামীতে আরো সম্প্রসারিত হবে এটাই প্রত্যাশা সবার। আর গাছটিকে দীর্ঘ দিন বাঁচিয়ে রাখার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে সরকারকে। সূত্র : নয়া দিগন্ত