মোহাম্মদ বদরুজ্জামান
চলার পথ শেষ হচ্ছে না। দলের অনেকের বুকে দুরুদুরু কাঁপুনি। বিশেষ করে আবু শামা আর সোহাগ দ্বিধান্বিত। গন্তব্য আর চলার মধ্যে কোথাও যেন একটা টানাপোড়েন চলছে তাদের মাঝে। সে টানাপোড়েন শেষ পর্যন্ত আমাদের চলার গতিতে কোনো ব্যত্যয় ঘটাতে পারেনি। জঙ্গলের গভীরে আমাদের যে বিচরণ, সেটা কয়েক ঘণ্টার পথ অতিক্রম করার পর। এখানে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ বলে কিছু নেই। দিগ্ভ্রান্ত জঙ্গলের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার যেন দারুণ এক উপলক্ষ আমাদের জন্য প্রস্তুত। ইচ্ছা করলেই অবশ্য কেউ হারিয়ে যেতে পারে না। তবে হারিয়ে যাওয়ার যাবতীয় অনুষঙ্গ বিদ্যমান কালেঙ্গার এ জঙ্গলে!
রাত তিনটায় শায়েস্তাগঞ্জে নেমে ভোরের প্রতীক্ষায় মুহূর্তগুলো মন্দ ছিল না। এত রাতে এখানে নামতে হবে, সেটা অনুমিতই ছিল। তানভীর ভাইকে নিয়ে কালেঙ্গা বনে ঘোরার পরিকল্পনা করতে গিয়ে হোঁচট খেতে হলো কীভাবে সেখানে যাওয়া যায় তার তথ্য পাওয়া নিয়ে। অবশেষে ফেসবুকে ট্রাভেলারস অব বাংলাদেশ গ্রুপের দ্বারস্থ হতে হয়। পাঁচ বছর আগে রেমা-কালেঙ্গা ঘুরে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এক ভাই আমাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন। সূর্য ওঠার আগেই চুনারুঘাটের উদ্দেশে ধরলাম অটোরিকশা। চুনারুঘাট ছাড়ার পর গ্রামবাংলার চিরায়ত হেমন্তের সকাল। সূর্যের কোমল কিরণ পড়ছে ধানখেতের ওপর মোহনীয় রূপ ধারণ করে।
খুব সকালেই শুরু হলো আমাদের সাফারি ভ্রমণ। বন বিভাগের গেট দিয়ে প্রবেশ করে ক্রমেই গভীর থেকে বনের আরও গভীরে। এদিকে মানব বসতি নেই। আছে কেবল ঘন গাছপালা ভরা জঙ্গল। কোথাও কোথাও পাখির কিচিরমিচির। এমন গহিনে এসে জঙ্গল থেকে বের হতে পারব কি না ভেবে আমাদের অনেকেরই মনে ভীতি চেপে বসল। শুরুতেই কিছু আদিবাসী লোকের দেখা মিলেছিল। জাল ঘাড়ে করে বনের কোনো খালে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে জঙ্গলের পথ ধরেছিল তারা। নিসর্গের আবদুর রহমানের ঠিক করা গাইড সঙ্গে নিয়ে চলছে আমাদের বন-বাদাড়ে ঘোরার পালা। গাইড ছাড়া এ বনে ঘোরা মানে পথ হারিয়ে কোনো বনে গিয়ে শুধু শুধু ছুটে বেড়ানো।
একটা জায়গায় বানরের বাঁদরামিতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হলো। বানরই একমাত্র প্রাণী, যা মানুষকে আনন্দ দিতে পারে বিভিন্ন কৌশলে। এমনকি উন্মুক্ত বনেও। হনুমান আর কাঠবিড়ালির পাশাপাশি বানর কালেঙ্গা বনের প্রধান বন্য প্রাণী। হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার ভারতীয় সীমান্ত বরাবর বিস্তৃত কালেঙ্গা বন। রেমা নামের আরেকটি বন ঠিক এর পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে বিস্তৃত। একসঙ্গে রেমা-কালেঙ্গা নামে পরিচিত এ বনের আয়তন ১ হাজার ৭৯৫ হেক্টর। ১৯৯৬ সালে বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষিত এ বনে আছে নানা প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি ও সরীসৃপ। বৈচিত্র্যময় গাছপালা আর উদ্ভিদ এই অভয়ারণ্যকে করেছে অনন্য।
ঘন জঙ্গল, লতাপাতা আর পানির কয়েকটি খাল মাড়িয়ে আমরা পৌঁছলাম এমন এক জায়গায়, যেখান থেকে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত শুরু। ১৯৫৪ সালের একটি পিলার বসানো আছে সীমান্ত এলাকায়, যার গায়ের একদিকে লেখা বাংলা, অন্যদিকে ইংরেজিতে ভারত। অদূরেই কাঁটাতারের বেড়া। বনের মধ্য থেকে ভারত দর্শন শেষে ধরতে হলো আরেকটি পথ। এ পথ আরও বৈচিত্র্যময় এবং বন্ধুরও। এখান দিয়ে চলতে চলতে মনে পড়ে গেল বিহারের সেই বিখ্যাত ভাগলপুর বনের কথা। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় আরণ্যক উপন্যাসে লিখেছিলেন সত্যচরণের সেই বন ও তার অধিবাসীদের গল্প। সত্যচরণ গিয়েছিলেন ভাগলপুর বনে চাকরি করতে। আর আমরা কালেঙ্গায় এসেছি বেড়াতে, এখানকার বন্য প্রাণী দেখতে।
মুখপোড়া হনুমান, চশমা হনুমান রেমা-কালেঙ্গার প্রধান আকর্ষণ। সাধারণত মানুষ চলাচল করে এমন এলাকার কাছাকাছি এদের বসবাস। হনুমান দেখার জন্যই মূলত আমরা উন্মুখ হয়ে ছিলাম বলা যেতে পারে। দেখাও পেয়ে গেলাম এক জায়গায়। কিন্তু মানুষ দেখা মাত্রই এরা সেগুনগাছের মগডালে উঠে পড়ে। অতএব এদের ছবি তোলাও এক দুরূহ কাজ। বাংলাদেশে রেমা-কালেঙ্গা বাদে হনুমান দেখা যায় কেবল কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া বনে।
এদিকে, বানরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ বনের কৃষকেরা। দল বেঁধে আসা বানরের কবল থেকে নিজেদের ধানখেত রক্ষার জন্য দিনমান বসে থাকতে হয় এখানকার কৃষকদের। বনের মধ্যে এমনি এক ধানখেতের পাশে কয়েকজন ত্রিপুরা কৃষককে পেয়ে কিছুক্ষণ আড্ডা জমিয়ে তুললাম তাঁদের সঙ্গে। জিরোবার ফুরসতও পেয়ে গেলাম সেখানে কিছুক্ষণ।
নিসর্গ রিসোর্টে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে বের হতেই বেলা গড়িয়ে গেল। এবার আমরা বনের পশ্চিমাংশে শুরু করলাম অভিযান। এ দিকটায় বনের ঘনত্ব আরও বেশি। ঘন জঙ্গলের মাঝে সরু পথ ধরে হাঁটার সময় কয়েক জায়গায় হনুমান আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠল। এদের চতুরতা মুগ্ধ করে পর্যটকদের। ক্রমেই বেলা গেল পড়ে। সূর্যের আলো অদৃশ্য হয়ে যায় কোথাও কোথাও। নীরব এমন এক জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ চলাও দারুণ এক ব্যাপার! মাঝেমধ্যেই মনে হলো, আমাদের এ সাফারি আফ্রিকার কোনো জঙ্গলে হচ্ছে কি না। বন পেরিয়ে হুগলি টি এস্টেট। সেখানে আমাদের পৌঁছে দিয়ে গাইড নিলেন বিদায়। কিন্তু এ বনকে বিদায় জানাতে মন চাইল না কিছুতেই। এখানে একটা রাত কাটাতে পারলে হয়তো জম্পেশ হতো ভ্রমণের ক্ষণ। হোক না সেটা জোছনায় ভরা কোনো রাত কিংবা আঁধারের অমানিশায়। কিন্তু সেটা আর হলো না এ সফরে। ফিরে যেতে হলো শ্রীমঙ্গল চা-বাগানের মাঝ দিয়ে কাঁচা-পাকা পথ ধরে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সিলেটগামী যেকোনো বাস বা ট্রেনে চেপে নামতে হবে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে। বাসে যেতে চাইলে ইউনিক আর এনা পরিবহনে যাওয়া ভালো। সেখান থেকে রিজার্ভ সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চুনারুঘাট হয়ে যাওয়া যায় কালেঙ্গা বনের প্রবেশগেট পর্যন্ত।
জেনে নিন
রেমা-কালেঙ্গা বনে ঘোরার জন্য কয়েকটি ট্রেইল আছে। ভালো হয় পুরো এক দিনের ট্রেইল বেছে নিলে। থাকার জন্য বন বিভাগের বাংলো আছে কালেঙ্গা বনের ভেতরে। আর বনের বাইরে নিসর্গ রিসোর্ট। বন বিভাগের বাংলোতে থাকতে হলে সিলেট বন বিভাগের অনুমতি নিতে হয়। আর বনে ঘোরার সময় শুকনা খাবার এবং পানি সঙ্গে নিতে ভুলবেন না। মনে রাখবেন, এ বন আমাদের অমূল্য সম্পদ। তাই, বন ও বনের প্রাণীর কোনো ক্ষতি হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকুন। সৌজন্যে : প্রথম আলো