শ্রীনগরের রিসেপশন সেন্টার থেকে আধা কি. মি. পূর্বে কাশ্মীর সুন্দরী ডাল। গাগরিবাল, লাকুতি ডাল, বড়া ডাল এই তিনের সমন্বয়ে ডাল লেক। নাগি লেক ডালের অংশ বিশেষ। ভাসমান উদ্যান পৃথক করেছে এদের। এই ডালকে ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটক বিনোদনের কাশ্মীর ব্যবস্থা। দৈর্ঘ্যে ৬ আর প্রস্থে ৩ কি.মি’র মতো। তবে পুরাতন শহর ডালের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে আর নতুন করে শহর বাড়ছে ঝিলামের দক্ষিণে। ডালের পাড় ধরে Baulevard জফ ঘাটের পর ঘাট, শিকারা যাচ্ছে যাত্রী নিয়ে হাউসবোটে। আর ডাইনে সারি দিয়ে মিছিল করে দাঁড়িয়ে নানান হোটেল শ্রীনগরের। ডালের দক্ষিণে শঙ্করাচার্য আর পূর্বে হরি পর্বত প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে। মোগল গার্ডেনগুলোও গড়ে উঠেছে এই ডালেরই পাড়ের উত্তর জুড়ে। আর পশ্চিমে হজরতবাল মসজিদ। এই ডালের জন্যই নাম হয়েছে কাশ্মীরের প্রাচ্যের ভেনিস। পর্যটকদের জন্য রয়েছে জলজ হোটেল। হাউসবোট এই ডাল লেকেরই জলে পশ্চিম জুড়ে। জলও এর স্বচ্ছ। তবে হাউসবোট এবং শহরের জঞ্জালও পড়ছে ডালের জলে। এর আর এক আকর্ষণ ভাসমান উদ্যান। দ্বীপাকার এই উদ্যানে চাষবাস হচ্ছে। বসতিও গড়ে উঠেছে দ্বীপ থেকে দ্বীপে। স্থানান্তরও ঘটে থাকে। এই ভাসন্ত দ্বীপের। জুন-জুলাই মাসে ডালের জলে পদ্মের সাথে ওয়াটার লিলির শোভা মনোহর করে পর্যটকদের। সংযোগ ঘটেছে ঘুরেফিরে ১ কি. মি. দীর্ঘ খালপথে ঝিলামের সাথে ডালের। আকার যেন দ্বীপের মতো। পসরা সাজিয়ে তর তর করে ছুটে চলেছে শিকারা বেয়ে দোকানি। এ দৃশ্যও ভুলবার নয়। শিকারা চেপে ডালে ভাসমান পর্যটকদের অনাবিল আনন্দ দেয়। এমনকি চাঁদের আলোও আগুন ধরায় ডালের জলে। সেও আর এক নয়নাভিরাম দৃশ্য।
নেহেরু পার্ক শঙ্করাচার্য পাহাড়ের পাদদেশে বুলেভার্ড শেষ হতে ডালেরই অংশ গাগরিবাল দ্বীপে জওহরলাল নেহেরুর স্মারক রূপে গড় তোলা হয়েছে নেহেরু পার্ক। সান্ধ্য ভ্রমণের রমণীয় পরিবেশ। রাতের আলোকসজ্জা দূর-দূরান্ত থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে পরিবেশের মাঝে কিছুটা বিসদৃশ যেন আলোর এই রোশনাই।
চার চীনার : ডালের বুকে আরও এক দ্বীপ। চারপাশে জল, মাঝে ৪টি রাজকীয় বৃ চীনার অর্থাত্ দরখতে ফজল গাছ। নাম তাই চার চীনার। রেস্টুরেন্টও হয়েছে দ্বীপে।
কবুতরখানা : পাশেই আর এক দ্বীপে মহারাজাদের গ্রীষ্মাবাসে কবুতর বা পায়রাদের খানা খেতে দেওয়া হতো। তাই এই নাম। দূর থেকে দেখতে হয়, পাড়ে ওঠার অনুমতি নেই।
হরি পর্বত : শহর থেকে ৫ কি. মি. উত্তরে ডালের পশ্চিমে সরিকা পাহাড়ের হরি পর্বতের শিরে ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে বাদশা আকবর দুর্গ গড়েন। দ্বিমতে দুর্গটি ১৮১২-এ কাশ্মীরের পাঠান শাসক আট্টাখানের তৈরি। শহর থেকেও ১২২ মি. উঁচুতে ৫ কি. মি. দীর্ঘ ১০ মি. উঁচু প্রাচীরে ঘেরা সঙ্কীর্ণ প্রবেশ দ্বার। দেওয়াল চিত্র, বিচিত্র ফারসি ভাষায় উদ্ধৃতি উত্কীর্ণ, তবে আজ বিধ্বস্ত। বেশ কয়েকটি হিন্দু মন্দিরও ছিল সেকালে। আজ হয়েছে ফলের খেতি বসন্তে ফুল ফোটে, চারপাশের পরিবেশ মধুময় হয়ে ওঠে। পুরাণ বলে জলোদ্ভব অসুরকে বধ করতে পার্বতীর ছোঁড়া পাথরখণ্ডই রূপ পেয়েছে পাহাড়ে। তবে আজ সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকায় অনুমতি লাগে রাজ্য পর্যটন থেকে দুর্গ দেখতে।
চাঁদনী রাতে বসে আছি ডাল লেকের তীরে। দু’নয়ন ভরে দেখছি কাশ্মীরের রূপ। হঠাত্ পিছন থেকে কে যেনো একজন দু’হাত দিয়ে চেপে ধরল আমারই দু’টি চোখ। দেখার কী উপায় আছে!
ভয়েতো অস্থির। এদিক ওদিক তাকাতেও পারছি না। মনে হয় হাত দুটি বড় মায়াময়। ভাবলাম, কাশ্মীরের এতো রূপ, এখানেও কী এতো কাঁটা! সেই কাঁটায়তো জড়িয়ে পড়লাম না আবার। কেন- গত ষাট বছর ধরে কত না লোক বলিদান দিলো, আমার ভাগ্য কী আবার এমনটি ঘটতে যাচ্ছে না তো।
তবুও তৃপ্ত এ জন্য যে, কাশ্মীর দেখেছি বার তিনেক। দূর দেশি একজন বাঙালির জীবনে এমনি ঘটনা হয়তো কদাচিত্ ঘটে। হাত দু’টি ছেড়ে দিয়ে মানুষটি বাংলা ভাষায় বলে উঠলো- কী আমাকে চিনতে পেরেছেন তো! আমি যে সাকিব চৌধুরী…।
চিনতে কী আর ভুল হয়। ও আরও বলল, সিলেটে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল… ভাদেশ্বরে যে বাড়ি। বলবো, হঠাত্ এ দেখা আশ্চর্যজনক ঘটনা ছাড়া কিছুই যে নয়।
শাকিব চৌধুরী আমাকে বুকে জড়িয়ে বলল, অনিন্দ্য সুন্দর পঞ্জাকৃতিক দৃশ্যের মাঝে যেন এক রূপকথার রাজ্য এই কাশ্মীর। এখানে দর্শনীয় স্থানের কী আর অভাব আছে—হাউজ বোটে বসে দেখা মেলে মেঘ পাহাড়ের খেলা…।
নিশাদবাগ, চশমাশাহী, পরীমহল, শালিমারবাগ, নাগিন লেক সবই মন ভুলায়। জানেন, এই চাঁদনী রাতে দু’চোখ কী যেনো মোহমায়ায় জড়িয়ে পড়ছে। বিকেল বেলায় এক নজর আপনাকে দেখেছিলাম। সেই থেকে ফলো করছি…। কথা গুলো শুনে মুগ্ধ না হয়ে যে পারিনি!
সাকিব চৌধুরী বললো, চলুন ওই যে হাউজবোট- সারারাত ধরে ওখানেই থাকব। ওই যে দেখছেন, তুষারের মুকুট পরা সবুজ উপত্যকার পাহাড়- আমাকে যে হাতছানি দেয়। চলুন ওখানে দু’জনে মিশে যাই…। বড্ড ভালো লাগছে যে !
কখন যে সকাল হয়ে গেল, তা বুঝতেই পারিনি। কাশ্মীরের রূপে দু’জন যে ছিলাম মাতোয়ারা। এক রাত হাউজ বোটে ডাল লেকে বেড়ানোর সেই স্মৃতি তো ভোলার নয়! কী করেই বা ভুলবো অপরূপ কাশ্মীরকে। এখনো যে দু’চোখের পাতায় ভাসে কাশ্মীরের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য।
শ্রীনগরের ডাললেক
আজকের শ্রীনগর শহর এক ঘনবসতিপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। শহরের হূিপন্ড হলো ডাললেক। প্রায় ২৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট লেকের ওপরে রয়েছে তিনটি ছোট ছোট দ্বীপ। এগুলো হলো চারচিনার, কবুতরখানা আর নেহরু পার্ক। শিকারায় চেপে ডাললেক দর্শন এক তৃপ্তিদায়ক এবং স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
সূত্র : ইত্তেফাক