মুহাম্মাদ তানভীর হোসেন
উমরাহ শব্দের আভিধানিক অর্থ পরিদর্শন বা সাক্ষাত্। হজের কয়েকটি দিন ব্যতীত বছরের যেকোন সময়ে নির্ধারিত নিয়মে কাবা পরিদর্শন করাকে উমরাহ বলে। তামাত্তু ও কিরান হজ পালনকারীর জন্য প্রথমে উমরাহ সম্পন্ন করতে হবে। উমরাহ’র ফরজ ২টি:১.ইহরাম (মীকাত হতে), ২. ক্বাবা তাওয়াফ করা। পক্ষান্তরে উমরাহ’র ওয়াজিব ২টি:৩.সাফা-মারওয়া সাঈ করা ও ৪. মাথা মুণ্ডন বা চুল কাটা।
উমরাহ’র জন্য ফরজ ও ওয়াজিবগুলো ধারাবাহিকভাবে পালন করতে হবে। এখানে তা সম্যক আলোচনার দাবি রাখে। যেমন— ১. ইহরাম বাঁধা (মীকাত হতে): ইহরাম এর আভিধানিক অর্থ হারাম অথবা নিষিদ্ধ করা। ইসলামের পরিভাষায়, নির্দিষ্ট পোশাক পরিধান করে, নিয়ত ও তালবিয়া সহকারে কিছু কিছু হালাল বিষয়কে নিষিদ্ধ করে হজ ও উমরাহতে প্রবেশ করাই হল ইহরাম। ইহরামের মাধ্যমেই ধাপে ধাপে নিম্নের প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করে হজ ও উমরাহ সম্পন্ন করতে হবে: ক. ইহরামের পূর্বে শারীরিক পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা (যেমন: গোঁফ, চুল, হাত ও পায়ের নখ কাটা, নাভির নিচের ও বগলের লোম পরিষ্কার করা)। খ.ইহরামের পূর্বে পুরুষ ও মহিলা সবার জন্যই গোসল করা সুন্নাত। ওজু/গোসলের পর পুরুষদের সেলাইবিহীন কাপড় পরিধান করতে হবে। মহিলাদের যে কোন পবিত্র এবং যথোপযুক্ত পোশাকে ইহরাম করতে হবে। ওজু/গোসল করার পর ২ রাকাত নফল নামাজ পড়াও দরকার। গ.মীক্বাত বা তার পূর্ব থেকে উমরাহ’র নিয়ত করতে হবে। তামাত্তু হজ পালনকারীর নিয়ত:‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা উমরাতান’(হে আল্লাহ! আমি হাজির, উমরাহ পালনের জন্য)। কিরান হজ পালনকারীর নিয়ত:‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা হাজ্জান ওয়া উমরাতান’(হে আল্লাহ! আমি হাজির হজ ও উমরাহ পালনের জন্য)। ঘ. তারপর তালবিয়া পড়া: ‘‘লাব্বাইকা আল্লাহম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারীকা লাক’’। পুরুষের উচ্চৈঃস্বরে এবং মহিলাদের ক্ষীণস্বরে তালবিয়া পড়তে হবে। বায়তুল্লাহয় পৌঁছে ক্বাবার দর্শন লাভ না করা পর্যন্ত তালবিয়া পড়তে হবে। ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ বিষয়গুলো পালন করতে হবে। পবিত্রতার সাথে দো’আ পড়ে মসজিদুল হারামে প্রথমে ডান পা রেখে প্রবেশ করতে হবে।
২. ক্বাবা তাওয়াফ: ইসলামের পরিভাষায় ক্বাবার চতুর্দিকে পবিত্র অবস্থায় নির্দেশিত নিয়মে প্রদক্ষিণ করার নাম তাওয়াফ। ক্বাবা তাওয়াফের জন্য যা প্রয়োজন তা হলো- ক. তাওয়াফের নিয়ত করা, খ. ক্বাবা সাত বার বিরতীহীনভাবে প্রদক্ষিণ করা, গ. পবিত্র হওয়া (ওজু/গোসল করা), ঘ.সতর ঢাকা, ঙ. সক্ষম ব্যক্তির পদদলে তাওয়াফ করা, চ. ক্বাবাকে বামে রেখে তাওয়াফ করা, ছ.হাতিমের বাহির দিয়ে তাওয়াফ করা, জ. তাওয়াফ শেষে দুই রাকাত সালাত আদায় করা, ঝ. হজরে আসওয়াদ হতে তাওয়াফের প্রত্যেক চক্কর আরম্ভ করা, ঞ. হজরে আসওয়াদে চুমু প্রদান, স্পর্শ করা কিংবা হাত দিয়ে ইশারা করা, ট. উমরা পালনকারীর তাওয়াফে ইজতিবা ও রমল করা, ঠ. প্রতিচক্করে রুকুনে ইয়ামেনী স্পর্শ করা, সম্ভব না হলে, ইঙ্গিত না করা এবং দো’আ পাঠ করা।
হজরে আসওয়াদকে চুমু দিয়ে বা হাতে স্পর্শ করে হাতে চুমু দিয়ে, সম্ভব না হলে হজরে আসওয়াদের দিকে ইশারা করে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’বলে তাওয়াফ আরম্ভ করতে হয়। রুকুনে ইয়ামেনী হতে হজরে আসওয়াদ পর্যন্ত পাঠ করতে হবে- ‘রব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাঁও ওয়া ফিল আখিরাতে হাসানাতাঁও ওয়া কিনা আজাবান্নার’। হজরে আসওয়াদ বরাবর হলে পুনরায় আগের নিয়মে ডান হাত তুলে ইশারা করে তাকবীর পড়তে হবে ও ২য় প্রদক্ষিণ আরম্ভ করতে হবে। এভাবে একই নিয়মে পূর্ণ করতে হবে সাত চক্কর। তাওয়াফ শেষ, এখন ডান কাঁধ ঢেকে দিতে হবে। তাওয়াফ শেষে মাকামে ইব্রাহীমের পিছনে দুই রাকাত সালাত আদায় করতে হবে। জমজমের পানি পানের সময় বিসমিল্লাহ বলতে হবে, দাঁড়িয়ে পান করার সময় এই দো’আটি পড়তে হবে—‘আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকা ইলমান নাফি’আ, ওয়ারিযক্বাও ওয়াসি’আ, ওয়াশিফাআম মিন কুল্লি দা’ঈ’(হে আল্লাহ! আমাকে উপকারী জ্ঞান দান করুন! পর্যাপ্ত রিজিক দান করুন! সকল রোগের শেফা দান করুন)।
৩. সাঈ (সাফা-মারওয়া দ্রুত হাঁটা): সাফা পাহাড়ের কাছে এসে নিয়ত করতে হবে এবং পবিত্র কুরআন মজিদ হতে পাঠ করতে হবে- “ইন্নাস সাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন শা’আয়িরিল্লাহ…”(নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া মহান আল্লাহ’র নিদর্শনগুলোর অন্যতম…) (সূরা বাক্বারা: ১৫৮)। সাফা পাহাড়ের উপর ক্বাবামুখী হয়ে মহান আল্লাহর বড়ত্ব, মহিমা ও তাওহীদের বাণী পড়তে হবে। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শরীকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুম হামদু, ইয়ূহয়ী ওয়া ইয়ূমীত ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়্যিন ক্বাদীর’। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু, আনজাযা ওয়া’দাহু, ওয়া নাসারা আবদাহু, ওয়া হাজামাল আহজাবা ওয়াহদাহু’।
এটা দো’আ কবুলের অন্যতম স্থান। সাফা পাহাড় থেকে নেমে মারওয়ার দিকে কিছুদূর যেতেই দুই সবুজ বাতির মাঝে দ্রুতগতিতে চলতে থাকতে হবে (মহিলাদের জন্য প্রযোজ্য নয়) এবং এই দো’আ পড়তে হবে- ‘রাব্বিগফির ওয়ারহাম ওয়া আনতাল আ’আজ্জুল আকরাম’। সাঈ’র জন্য কোন দো’আ নির্দিষ্ট নেই। মারওয়া পাহাড়ে পৌঁছে, সাফা পাহাড়ে যেভাবে তাসবীহ পড়া হয়েছে ঠিক একইভাবে দো’আ, তাসবীহ পড়তে হবে। এরপর মারওয়া হতে নেমে এসে আবার সাফায় পৌঁছার পূর্বে সবুজ বাতিদ্বয়ের মাঝামাঝি দ্রুতপদে চলতে হবে এবং পড়তে হবে পূর্বের দো’আটি। এভাবে সাত নম্বর হাঁটা বা সাঈ শেষ হবে মারওয়া পাহাড়ে।
৪. মাথা মুণ্ডানো (হলক) বা চুল ছাঁটা (কছর): সাঈ শেষ করে পুরুষের মাথা মুণ্ডনো বা চুল ছাঁটতে হবে। মহিলাদের চুলের অগ্রভাগ থেকে অর্ধাঙ্গুলী পরিমাপ কাটতে হবে। চুল কাটার পর উমরাহ’র ফরজ ও ওয়াজিব সম্পূর্ণ হবে এবং উমরাহ সম্পন্ন হবে। এখন স্বাভাবিক পোশাক পরিধান করা যাবে। এরপর ৮ জিলহজ হজের জন্য পুনরায় ইহরাম বাঁধতে হবে।
লেখক : হজ প্রশিক্ষক, কুরআন শিক্ষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
সূত্র : ইত্তেফাক