Skip to content

ক্যাপ্টেন কুক-এর মনুমেন্ট

:: সৈয়দ আশিক রহমান ::

সেপ্টেম্বর মাসে চারদিনের জন্য অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে যেতে হলো প্রবাসী ‘আরটিভি আলোকিত নারী ২০১৭’-এর অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করেছিল আরটিভি এবং সুর ইভেন্টস, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। অনুষ্ঠান শেষে পরদিন একটু ভ্রমণের সুযোগ পাওয়া গেল। সিডনির একজন বন্ধুর সাথে দুপুরের দিকে বেড়িয়ে পড়লাম অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলবর্তী বোটানি উপসাগরের তীরে যেখানে ক্যাপ্টেন কুক প্রথম অস্ট্রেলিয়ার বুকে পা রেখেছিলেন।

শহরের রাস্তায় প্রচুর গাড়ি চলছে, কিন্তু কোনো যানজট নেই, নেই হর্নের অযাচিত চিৎকার। এভাবে প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট চলার পর শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে আমরা একটি নির্জন রাস্তায় এসে পড়লাম। এদিকটায় সবুজ গাছপালায় পূর্ণ। এসবের মাঝে একাকী দাঁড়িয়ে আছে দু-একটা কটেজ আকৃতির ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়ল একটি সাইনবোর্ড। বুঝলাম আমরা এসে পড়েছি। পার্কিংয়ে গাড়ি রেখে এগিয়ে গেলাম অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলবর্তী বোটানি উপসাগরের দিকে।

মেঘমুক্ত দিন। চারদিকে উজ্জ্বল সোনালি রোদের বাঁধভাঙা বন্যা। কিন্তু উপসাগরের বুক বেয়ে শীতের হিমেল হাওয়া বইছিল প্রবল বেগে। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ঘাসের উন্মুক্ত মাঠ, মাঝে মাঝে পাথরের ধূসর টিলা আর উপত্যকার নীল জলরাশি দিগন্তে মিশেছে নীলাকাশের সঙ্গে। চারিদিকে সবুজ ঘাসের কার্পেট। এসবের মাঝে উঁচু উঁচু ঝাউবন স্থানটিকে ছায়াময় করে রেখেছে।

তার মাঝ বরাবর আঁকাবাঁকা কনক্রিটের পায়ে হাঁটা পথ। মাথার ওপরে গাঙচিল আর মাছ খেকো পাখিদের উড়াউড়ি আর তাদের কূজন নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিচ্ছিল। কিছু দূরে কঠিন শিলাখণ্ডকে দেখে মনে হলো, কোনো ভাস্করের তৈরি ভাস্কর্য।

তার পাশেই প্রবাল শৈলীগুলো সূর্যের আলোয় মোহময় রঙ ছড়াচ্ছে। পথের পাশে ফলকটি দেখে বুঝলাম আমরা গন্তব্যে এসে গেছি।

ইতিহাস বলে ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ এপ্রিল এক ইংরেজ ক্যাপ্টেন জেমস কুক ‘এনডেভর’ জাহাজে চেপে অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলবর্তী বোটানি উপসাগরের বর্তমান সিডনি উপকূলে প্রথম পা ফেলেন। অনেকে বলেন, সেদিন থেকেই অস্ট্রেলিয়ায় সভ্যতার শুরু হয়েছিল।

ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালাম ক্যাপ্টেন কুকের অবতরণ স্থলের মনুমেন্টের সামনে। আহামরি তেমন কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নয় এটা। তবে ইতিহাসের নিরিখে এটার মূল্য অপরিসীম। স্মৃতিস্তম্ভের ফলকে সংক্ষেপে লেখা রয়েছে ইতিহাসের কথাগুলো। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ আবিষ্কারের মাধ্যমে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন ক্যাপ্টেন জেমস কুক। ঐতিহাসিক এই বোটানি বে-এর উপকূলে দাঁড়িয়ে স্মৃতিতে ভেসে উঠল অনেক আগে পাঠ করা ইতিহাসের কিছু অংশ।

১৭৬৯ সালের কথা। সাম্রাজ্য বিস্তারের নেশায় মত্ত ব্রিটিশরাজ। তারা লেফটেন্যান্ট কুক-কে গোপনে পাঠালেন অজানা ভূমির সন্ধানে। কিন্তু রটনা করা হলো লেফটেন্যান্ট কুক তাহিতি দ্বীপে যাচ্ছেন একটি বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রায়। ব্যাপারটা ছিল আংশিক সত্যি। রনো দেবার আগে কুককে দেয়া হলো ব্রিটিশ রাজের সিল করা এক গোপনীয় খাম। তাকে বলা হলো, তাহিতি দ্বীপে পৌঁছে এবং তার বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের কাজটি শেষ করে তবে খুলতে হবে খামটি।

লেফটেন্যান্ট কুক দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে পালতোলা জাহাজে ভাসতে ভাসতে আট মাস পর হাজির হলেন পলিনেশিয়ান দ্বীপ তাহিতিতে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা শেষ করে একদিন কুক ভয়ে ভয়ে পড়লেন সেই রাজকীয় ফরমান। তাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আরো পশ্চিমে এগিয়ে যেতে এবং খুঁজে বের করতে দক্ষিণের অজানা সেই ভূমি-টেরা অস্ট্রালিস ইনকগনিটাকে।

আবার জাহাজে পাল তুলে পশ্চিম দিকে যাত্রা করলেন লেফটেন্যান্ট কুক। ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সাগরে ভেসে চললেন অজানা ভূমির উদ্দেশে। মাসের পর মাস ক্লান্তিকর সমুদ্রযাত্রায় তার নাবিকদের অনেকেই তখন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কিন্তু সেই অজানা ভূমির দেখা নেই। এমনি সময় একদিন সকালে হঠাৎ করেই দূর-দিগন্তে দেখা দিল তটরেখা। ‘ল্যান্ড হো’ ‘ল্যান্ড হো’ বলে চিৎকার করে উঠলো তার জাহাজের নাবিকরা। ম্যাপের ওপর চোখ রাখলেন কুক। যেখানে খালি চোখে তিনি ভূমি দেখতে পাচ্ছেন, ম্যাপে সেখানে শুধুই অথৈ জল। তবে তিনি কি আরেকটি নতুন দ্বীপের সন্ধান পেলেন?

দিনটি ছিল ১৭৭০ সালের ১৯ এপ্রিল। সুজলা-সুফলা এক অপরূপ সুন্দর দ্বীপে নামলেন লেফটেন্যান্ট কুক এবং তার সাথীরা। দ্বীপে নেমেই এর গাছপালার বৈচিত্র দেখে তিনি অবাক হলেন। তার জাহাজে একজন বোটানিস্টও ছিল। সে গাছপালার নমুনা সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এ ধরনের গাছপালা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। কুক জায়গাটার নাম দিলেন ‘বোটানি বে’। সে সময় স্থানীয় আদিবাসীদের সাথেও তাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল। স্থানীয় আদিবাসীরা সাদা মানুষদের দেখে খুবই অবাক হয়েছিল। আদিবাসীরা কুক এবং তার সাথীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেছিল। কিন্তু তারা ধারণাও করতে পারেনি যে কদিন পরই এই সাদা মানুষগুলো দলে দলে এসে তাদের মেরে তাদের দেশটি দখল করে নেবে।

এবারে আসি কুকের ক্যাঙ্গারু দেখার গল্পে। কুক একটি অদ্ভুত প্রাণীকে দেখে খুবই অবাক হলেন। প্রাণীটি দুই পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে আর তার বাচ্চাকে রাখে পেটের থলির ভেতর। কুক এক আদিবাসীকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন এই অদ্ভুত প্রাণীটির নাম কি? আদিবাসী লোকটি মাথা নাড়িয়ে বললো, ক্যাঙ্গারু, ক্যাঙ্গারু। কুক ভাবলেন প্রাণীটির নাম বোধ হয় ক্যাঙ্গারু। সেই থেকে প্রাণীটির নাম ক্যাঙ্গারু হয়ে গেল। আসলে আদিবাসী মানুষটি ক্যাঙ্গারু মানে, ‘আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না’, সেটাই বোঝাচ্ছিল।

এবারে, কুকের দেশ ফেরার পালা। তিনি দেশে ফিরে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের বিবরণ দিলেন। লেফটেন্যান্ট কুক এই মিশনের সাফল্যের জন্য ক্যাপ্টেন কুক হিসেবে পদন্নোতি পেলেন।

তারপর ধীরে ধীরে এই মহাদেশটি একটি ব্রিটিশ কলোনিতে পরিণত হলো, যার স্থায়িত্ব ছিল বিংশ শতাব্দীর সূচনা পর্যন্ত।

আসলে ক্যাপ্টেন কুক অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার করেছিলেন এই কথাটি ঠিক নয়। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশটি আদিবাসী মানুষের বাসভূমি ছিল পঞ্চাশ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। ক্যাপ্টেন কুক অস্ট্রেলিয়াতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের পথটি তৈরি করেছিলে মাত্র। এই স্তম্ভটি আসলে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের পরাধীনতার স্তম্ভ।

ক্যাপ্টেন কুক নিহত হয়েছিলেন ১৭৭৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের উপজাতিদের বর্ষা নিক্ষেপে। তখন তার বয়স মাত্র ৫০ বছর।

এসব চিন্তা করছিলাম আর ঘুরছিলাম। কখন যে দিনের উজ্জ্বল আলোয় সোনালী রঙ ধরেছে খেয়াল করিনি। এবারে ফেরার পালা। মনোমুগ্ধকর এই ভ্রমণ আমার অনেক দিন মনে থাকবে। অনুলিখন : সৈয়দ সাবাব আলী আরজু। সৌজন্যে : আরটিভি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *