Skip to content

খাগড়াছড়ির চিঠি

মাসুম সায়ীদ
রাজু বডিং, খাগড়াছড়ি
১৩.০৬.২০১৫
নদী একটু পড়ে সন্ধ্যা নামবে। বাইরে ঝুমবৃষ্টি। অন্যরা ঘুমোচ্ছে। আর আমি বসে আছি বারান্দায়। বৃষ্টি দেখছি আর তোমাকে লিখছি-
সকালে চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পড়েছিলাম জিপে। আলুটিলা বাদুর গুহার মুখে এসে জিপ থামল। তার আগে টিকেট আর সাথে দুটো মশাল কিনতে হলো। নদী, তোমাকে বলি- এ মশাল কিন্তু শুভঙ্করের ফাঁকি! গুহার মাঝপথেই বেশিরভাগ নিভে যায়। নুমান ভাই আর আমার হেড ল্যাম্প আছে। মাসুদ ভাই আর রেজুয়ান ভাইয়ের জন্য মশাল। আমরা সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেলাম গুহার মুখে। প্রবেশ পথে ঝিরঝিরি পানির ধারা। ভেতরে অন্ধকার। দেখা যায় না কিছুই। মশাল আর হেডল্যাম্প জ্বালানো হলো। আল্লাহর নাম নিয়ে পা বাড়ালাম সামনে। পানিতে পা পড়তেই একটা শিহরণ খেলে গেল শরীরে। শতীল পানির, না গুহার অন্ধকারের স্পর্শে তা বোঝা গেল না। ভেতর গিয়ে হতবাক হয়ে গেলাম। ভেজা পাথর দেখে নয়, অদ্ভুত এ স্থাপত্যের কারিগরকে স্মরণ করে। কী তাঁর কৌশল! গুহাটা সরলভাবে এগিয়ে যায়নি। এর ডালপালা আছে। মাঝ বরাবর এসে গুহার একটা শাখা উঠে গেছে হাতের ডানে। আমি কৌতূহলে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। খানিকটা যেতে না যেতেই পাখা ঝাপটানোর শব্দ। বুঝে গেলাম ব্যাপারটা কী। ল্যাম্পের ফোকাস ফেলতেই স্পষ্ট হয়ে গেল ব্যাপারটা। কলার মোচার মতো ঝুলে আছে অসংখ্য বাদুর। সঙ্গীদের তাগাদায় ফিরে এলাম। এরই মধ্যে একটা মশাল নিভে গেল। বাকিটাও নিভু নিভু। গুহার ভেতর ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার। সুনসান নীরব। পায়ের নিচে ভেজা পিচ্ছিল পাথর। এবড়োখেবড়ো। আর আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ।

Khagrachari

কয়েক মিনিটের মধ্যে আলোর দেখা মিলল। আমরা বেরিয়ে এলাম গুহা থেকে। গুহাটার দৌর্ঘ্য ২৮২ ফুট। নদী, বড় অসচেতন জাতি আমরা; মশালের স্তুপ জমে গেছে গুহার মুখে। সাথে বোতল আর প্লাস্টিকের মোড়ক। ঘুরতে আসা মানুষগুলো সবাই দযদি পরিবেশ সম্পর্কে একটু সচেতন থাকত!

সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ উঠতে না উঠতেই ছোট্ট একটা মেঘ খানিকটা রসিকতা করল। এদিকে সামনের উপত্যকা আর দূর পাহাড়ের চিত্র ভিন্ন। নিচের সমতলটা ঢেকে আছে মেঘের ছায়ায় আর দূরের পাহাড়ে পাহাড়ে সোনা রোদ ঝলমল করছে। আলোছায়ার এমন সমান্তরাল উপস্থিতি প্রথম দেখলাম। বুঝলাম চিত্রশিল্পীরা কেন এত আলোছায়া, আলোছায়া করেন! নুমান ভাই ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে গেলেন মূর্তির মতো। আমি জিপের বনেটের ওপর বসে। দেখছিলাম আলোছায়ার খেলা। বেশ মুক্তভাবেই। ক্যামেরা হাতে থাকলে একটা ভালো ছবির জন্য মনে যে চাপটা থাকে তা নেই এবার। বৃষ্টির ফোঁটা ক্রমশ ঘন হয়ে নামল। নুমান ভাই ক্ষান্ত দিয়ে গাড়িতে উঠলেন। জিপ মূল রাস্তায় উঠে এলো আর সাথে সাথে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। হঠাৎ যেন শুনলাম তুমি ডেকে বললে, ‘এই চলে আস ছাদে ভিজব।’ স্পষ্টই শুনলাম তোমার গলা। খোলা জিপ, দরজা জানালার বালাই নেই। আমি উঠে গেলাম ছাদে। সবাই মানা করছিল কিন্তু কে শোনে কার কথা? প্রচণ্ড বৃষ্টি। তাও সামনের দিক থেকে। বৃষ্টি আর বাতাসে তোমার স্কার্ফ বেসামাল হয়ে যাচ্ছে দেখে তুমি চলে এলে আমার পেছনে। একহাতে ছাদের রেলিং অন্য হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছ আমাকে। তোমার চিবুক আমার কাঁধে। তোমার প্রশ্বাস গিয়ে পড়ছিল আমার কানের লতিতে। আর আমি প্রবল বৃষ্টি-বাতাসের ঝাপটা বুক পেতে নিয়ে তোমাকে আগলে রাখছিলাম। কি যে উচ্ছ¡সিত ছিলে তুমি! বৃষ্টির ফোঁটার চেয়েও বেশি যেন। নদী, এ সব তো কল্পনা কিন্তু আমার মন বলছিল, তুমিও ভিজছ। ছুতোর তো অভাব নেই তোমার। কাপড় আনার নাম করে খানিকটা ভিজে আসা।

এমনিতেই যে পথটুকু যাওয়া যায় আধঘণ্টায়; বৃষ্টির কারণে তাতে লেগে গেল প্রায় পৌনে একঘণ্টা। অবশেষে একটা পাহাড় চূড়ায় গিয়ে গাড়ি থামল। এখান থেকে হাঁটতে হবে। আমরা হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটা মানে নিচে নামা। তখনও বৃষ্টি হচ্ছে সমান তালে। একটা ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হচ্ছিল আমাদের। সেটা হলো জোঁক। বৃষ্টিতে এরা বেরিয়ে আসে ঝাঁকে-ঝাঁকে। তবে আশার কথা আমরা যাচ্ছি ইট বিছানো পথে। একসময় ঢাল বেয়ে নেমে এলাম পর্বতের কোমর বরাবর। এখান থেকে আবার সিঁড়ি শুরু। খানিকটা নামতেই কানে এল পানি পড়ার ঝিরঝির শব্দ। পানির শব্দে আর তর সয় না; যেন অনন্তকাল ধরে নামছি!

অবশেষে চোখে পড়ল জলের ধারা। রিছাং মারমা শব্দ। মারমা ভাষায় রি মানে পানি আর ছাং মানে গড়িয়ে পড়া। লোকমুখে ঝর্ণা বলে পরিচিতি পেলেও এটা আসলে ঝর্ণা নয় জলপ্রপাত। উচ্চতায় মাধবকুণ্ড কিংবা যাদিপাই জলপ্রপাতের চেয়ে কম হলেও বিশেষত্ব অন্য জায়গায়। রিছাং-এর ধারা যেখানে পড়ে সেখানে কোনো জলাধার নেই। আছে কাত হয়ে থাকা পাথরের একটা বিশাল চাতাল। পানির ধারাটা আছড়ে পড়ে এ চাতালের ওপর। তারপর পিছলে নেমে যায় নিচে। নামটা যে সার্থক তা বলাবাহুল্য। চাতালের শেষ প্রান্তে অবশ্য ছোটখাটো জলাধার সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি হচ্ছে বলে জলের প্রবাহ বেশি, পানিও ঘোলা। পানির পতনের জায়গাটা ঢালু আর পিচ্ছিল বলে জলের ধারার ঠিক নিচে যাওয়া যায় না। ছোট্ট খালটা পার হয়ে আমি চাতালে গিয়ে দাঁড়ালাম। পানির প্রবাহের পথটুকু ছাড়া চাতালের বাকিটা পিচ্ছিল নয়। একটা পায়ে চলার রেখা চলে গেছে ওপরে। লতাপাতা আর ঝোপঝাড়ে পথটা প্রায় বন্ধ। ওটা ধরেই চললাম উপরের দিকে। জোঁকের ভয় মনে রেখেই।

Khagrachari2

নদী, আরও একবার প্রমাণ পেলাম- মনের ঝোঁক দিব্যি কষ্ট সয়ে নেয়। আর সাহসও জোগায়। আমি উঠছি তো উঠছিই। শেষ পর্যন্ত বনের আঁকা-বাঁকা সীমন্তের রেখাটা আমাকে নিয়ে গেল জলের ধারার কাছে। উপরের দৃশ্য যারপরনাই সাদামাটা। দুই পাহাড়ের মাঝে একটা সাধারণ খালমাত্র। তবে পতন মুখের এক দেড়শ ফিট নিরেট পাথরের। রুমার বেথেল পাড়ার ঝিরিতে পিছলে পড়ার স্মৃতি মনেই ছিল, তাই সাবধানে পা ফেলে চলে এলাম একবারে কিনারে। নিচে দেখলাম নুমান ভাই ছাতা মাথায় একের পর এক ক্লিক করে যাচ্ছেন বৃষ্টি বাদলা উপেক্ষা করেই।

আমি নেমে এলাম নিচে। এর মধ্যে একটা হিন্দু পরিবার এল। চিনলাম কি করে? ওদের মধ্যে নতুন দম্পতি ছিল। মেয়েটির বয়স কত হবে বিশ কি একুশ? নদী, সত্যি সত্যি মেয়েটাকে দেখে তোমার কথাই মনে পড়ল। আর মনে পড়ল বিজয়পুর চিনামাটির পাহাড়ের দেখা সেই মেয়েটির কথা! যে পাহাড় দেখে অভিভূত হয়ে হিলজুতো পরেই উপরে ওঠা শুরু করে দিয়েছিল। পরে যখন সমস্যাটা বুঝল তখন পায়ে থেকে জুতা ছুড়ে ফেলে উঠে গিয়েছিল চূড়ায়। এই মেয়েটিও কিন্তু তরতর করে চাতাল পেরিয়ে এলো। সাথে ক্যামেরা নেই। তাতে কী, মোইল ফোন আছে, না?

লোকারণ্যের মাঝেও খুব কাছাকাছি হয়ে ছবি তুলল নির্দ্বিধায়। আমি ভাবছিলাম আমরা পারতাম কিনা এতটা কাছাকাছি হয়ে ছবি তুলতে এতো লোকের ভিড়ে? মেয়েটা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছিল বিপজ্জনক জায়গায়। আমি মেয়েটির খুব কাছেই ছিলাম। তাই ভাবছিলাম বিপদ আসলে আমি কি করব- দ্বিধা ঝেরে ধরে ফেলব মেয়েটিকে? না, মেয়েটি নয় বিপদে পড়ল তার এক সঙ্গী। আমরা কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই। দেখলাম লোকটা স্লিপার থেকে নেমে যাওয়ার মতো দুপা সামনে দিয়ে নেমে যাচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম ইচ্ছাকৃত। খানিকটা যেতেই বুঝলাম দুর্ঘটনা এটা। প্রথমে দু হাতে একটা কিছু ধরার চেষ্টা করলেও পড়ে হাল ছেড়ে দিল। মাঝপথে ড্রেনটা একটু বাঁক খেয়েছে। এখানে পাথরের দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল, এটা কাটিয়ে যেতে পারল। তারপর পা উপরে মাথা নিচের দিকে যাওয়ার উপক্রম হলো একবার, সেটাও কেমন করে যেন রক্ষা হলো। শেষ পর্যন্ত নিরাপদেই গিয়ে আছড়ে পড়ল পানিতে। কতসময়- এক থেকে দেড় মিনিট? আমার কাছে মনে হলো অনন্তকাল! আমি তাকিয়ে ছিলাম চোখের পলক না ফেলে। নদী, শুনে তোমার ভয় লাগেনি? তাকে বিপন্মুক্তভাবে পানিতে পড়তে দেখে হাততালি দিলাম। যাতে সাহস ফিরে পায়। আমার সাথে অন্যরাও। সত্যি কাজ হলো এতে। লোকটি ভয় কাটিয়ে হাসি মুখে উঠে এল। জানাল এটা দুর্ঘটনা ছিল, পড়ার সময় মাথাটা বেঁচে গেছে অল্পের জন্য। আমার আবার বেথেল পাড়ার কথা মনে পড়ল। দয়াময় প্রভু যে সবার মাথার উপর আছেন দয়া নিয়ে তা উপলব্ধি করলাম আর একবার। দলটা চলে গেল কিছুক্ষণ পর। আমরা বসে থাকলাম আনেকক্ষণ। আমাদের মাসুদ ভাই ইচ্ছা করেই নেমে গেল একবার। ঘোলা পানিতে আমার নামার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু সাহসী কাজটা করতেও মন চাইছিল। আমি যখন মনে মনে দ্বিধাদ্ব›দ্ব নিয়ে আছি তখন অন্য একটি ছেলে নেমে গেল। আর বসে থাকা যায় না; গামছা দিয়ে মাথা ভালো করে বেঁধে প্রস্তুত হলাম আমি। বলা তো যায় না, বাঁক নেয়ার সময় যদি মাথা ঠুকে যায় দেয়ালে! না, তা হলো না। ভালোভাবেই নামলাম।

বৃষ্টি থেমে গেছে কখন- টের পাইনি। পেতামও না যদি ঘড়ির দিকে না তাকাতাম। বারোটায় আমরা জলপ্রপাতের দিকে রওনা হই। আর এখন ২টা। ওঠার সময় টের পাওয়া গেল কতটা নেমে ছিলাম। মনে পড়ে গেল মেধা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে দেবব্রত সিংহের ত্যাজ কবিতার একটা লাইন- ‘খাড়া পাহাড়ে ওঠা যে কী জিনিস! বহুত দম লাগে, বহুত ত্যাজ লাগে!’

নদী, এই দেখো কাগজ শেষ হয়ে গেল ! আজ তবে এখানেই শেষ করি- রাগ করো না ক্ষ্মীটি? ভালো থেকো।

ইতি, তোমারই …

পুনশ্চ : বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল লেখার কাগজ। আমি গায়ে মাখিনি। তুমি তো বৃষ্টি পছন্দই কর। চিঠিতে না হয় একটু বৃষ্টি মাখা থাকল- কী বল?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *