এ রিয়াজ
স্বচ্ছ নীল সমুদ্র। যার কাছে এসে দাঁড়ালে একেবারে নিচ পর্যন্ত দেখা যায়। আর সেখানেই বাস করে বর্ণিল এক ধরনের জীব। সূর্যের আলো ঠিকরে পড়লে আরও সুন্দর, আরও রহস্যময় হয়ে ওঠে এসব ‘সাগর রত্ন’।
আমাদের এ পৃথিবীপৃষ্ঠে অহরহ ঘটে চলেছে নানা ঘটনা। তাদের নিয়েই ব্যস্ত আমরা। অথচ ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক নিচে, সাগর-মহাসাগরের তলায় যে একটা আশ্চর্য রহস্যময় জগত আছে- তার কথা আমরা যেন ভুলেই গেছি। এখানে মানুষ বসবাস না করলেও আছে বিচিত্র সব প্রাণী, হরেকরকম জীব। আর তাদেরই অন্যতম ‘কোরাল’ বা প্রবাল- এক ধরনের অমেরুদণ্ডী প্রাণী।
মজার ব্যাপার, বিশ্বে যখন মানুষে-মানুষে দ্বন্দ্ব, মারামারি, হিংসা- তখন বর্ণিল এ প্রাণীগুলো শুধু সারাটা জীবন নয়, মরণের পরও সংঘবদ্ধ হিসেবে বাস করে। সমাজের একটা অংশ হিসেবেই থেকে যায়। তবে এখানেই শেষ নয়, মৃত কোরালের দেহ স্তূপাকারে জমা হয়ে নানা আকৃতির কাঠামো তৈরি করে। আমরা যাকে বলি ‘কোরাল রিফ’ বা প্রবাল দ্বীপ। অবশ্য কোরাল রিফ গঠন নির্ভর করে সাগরতলের পরিবেশের ওপর। বিশেষ করে তাপমাত্রা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবের উপস্থিতিই জানান দেয় সেখানে এই ‘সাগর রত্ন’ আদৌ তৈরি হবে কিনা।
কোরাল নিয়ে অনেক বিজ্ঞানী গবেষণা করছেন। এমনই একজন গবেষক জার্মান প্রফেসর মিশায়েল শুলৎস। তিনি বলেন, ‘কোরাল কার্বোনেট অফ লাইম দিয়ে তৈরি। এছাড়া অন্যান্য প্রাণীর অংশ, এমনকি শৈবালও দেখা যায় কোরালে।’
প্রফেসর শুলৎস জানান, ‘কোরাল রিফ মৃত কোরালের একটি আকৃতি। যা সাধারণত গঠিত হয় ট্রপিক্যাল সাগরে। ২২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে ২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা কোরাল রিফ গঠনে সবচেয়ে সহায়ক। যেহেতু অগভীর অঞ্চলেই এমন তাপমাত্রা বজায় থাকে সেহেতু ১১ মিটার থেকে ৪০ মিটার গভীর সমুদ্রে কোরাল রিফের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। সাগরের পানিতে এমন তাপমাত্রা থাকলে প্রচুর ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন জন্মায়। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভিদ। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন খেয়ে জুপ্ল্যাঙ্কটন নামের এক ধরনের অতি ক্ষুদ্র প্রাণী বেঁচে থাকে। আর কোরালের প্রধান খাদ্যই হচ্ছে জুপ্ল্যাঙ্কটন।’
কোরাল লাইম অফ কার্বোনেট দিয়ে তৈরি হলেও, রিফে কিন্তু ম্যাগনেসিয়াম, স্ট্রনসিয়ামের মতো ধাতুও থাকে। অবাক করার বিষয়, প্রশান্ত মহাসাগরের কোরালে নাকি ২.১৭ পিপিএম ইউরেনিয়ামও পাওয়া যায়। তবে কোরাল রিফ ছাড়াও সমুদ্র গভীরে অন্য আরেক ধরনের কোরাল বা ‘সাগর রত্ন’ জন্মায়। একে বলা হয় কোরাল ব্যাংক। সাগরের ৬০ মিটার থেকে ২০০ মিটার গভীর অঞ্চলে এরা বাস করে।
প্রফেসর শুলৎসের কথায়, ‘চার ডিগ্রি থেকে ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা এ কোরাল ব্যাংকগুলোর জন্য খুবই উপযোগী। নরওয়ে থেকে কেপ ভার্দের উপকূল বরাবর পূর্ব আটলান্টিক হল এদের উৎপত্তিস্থল। এছাড়া নাইজার নদীর বদ্বীপ অঞ্চল, মেক্সিকো উপসাগর এবং নিউজিল্যান্ডের ক্যাম্পবেল মালভূমি এলাকায় এদের দেখা যায়। পাওয়া যায় জাপানের অদূরে উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরেও। অবশ্য আরও গভীর ও শীতল পরিবেশ, যেমন আন্টার্কটিকা, পাতাগোনিয়া, ফকল্যান্ড দ্বীপেও দেখা যায় এদের।’
কোরাল রিফ গঠনে সমুদ্রে দ্রবীভূত অক্সিজেনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ প্রবাল দ্বীপ সাধারণত বেশি গভীরতায় তৈরি হয় না। প্রফেসর মিশায়েল শুলৎস জানান, ‘সাগরের গভীরতা বৃদ্ধি পেলে আলোর স্থায়িত্ব কমে যায়। তার ফলে মারা যায় সাগরতলের সবচেয়ে সুন্দর, মনমুগ্ধকর এই জীব।’ এ কথা সত্য, সাগরের সৌন্দর্যের জন্য কোরালের ভূমিকা অপরিসীম। অথচ জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূষণের কারণে ধীরে ধীরে এই ‘সাগর রত্ন’ হারিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের বুক থেকে। তাই একে রক্ষা করা না গেলে সেটা হবে প্রকৃতির জন্য মারাত্মক এক ক্ষতি। সৌজন্যে : যুগান্তর