ইকবাল রাশেদীন
রাত ১১টায় ট্রেন। ভেলর ছাড়ছি আমরা, মানে আমি আর রুপম। গন্তব্য বোম্বে। কাঠপাডি স্টেশনে এসে জানা গেল চার নম্বর প্লাটফরম থেকে বোম্বের ট্রেন ছাড়বে। চার নম্বর প্লাটফরম তো অনেক দূরে, দুই-দুইটা রেল ওভারপাস পার হয়ে যেতে হবে। আমি পায়ের অসুবিধায় আছি। বড়জোর দুই-চার কদম ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটতে পাড়ি। এত দূর। এমন সময় কুলি এসে বলল, ‘হুইল চেয়ার! হুইল চেয়ার!’ আমার হৃদয়ে শান্তি ফিরে এলো। তবে শখের পর্যটকের এত অসুবিধা থাকতে নেই।
মধ্য দুপুরে একটা স্টেশনে দাঁড়ালাম। নাম গঙ্গাসমুদ্র। সুন্দর নাম। এই রকম সুন্দর সুন্দর নামের স্টেশনে দাঁড়াচ্ছি। বিভিন্ন মানুষের ওঠানামা দেখছি।
ঘণ্টাখানেক চলার পর ট্রেন ঢুকে পড়ল একটি বনের মধ্যে। এটা মাধি ওয়াইল্ড লাইফ স্যাঙ্কচুয়ারির (Mhadei Wildlife Sanctuary) মধ্যে। গোয়ার কাছে, মানে গোয়া রাজ্যের মধ্যেই। অভয়ারণ্য। এই বনে বাঘ ছাড়াও রয়েছে চিতাবাঘ, হাতি, বনগাই, হরিণ ও কমপক্ষে ২৫৭ প্রজাতির প্রজাপতি ও ২৫৫ ধরনের পাখি। ছুটে চলা বনের অপরূপ দৃশ্য দেখছি। আমাদের দেশের শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া বনের মতো। এই লাউয়াছড়া বন আমাকে টেনে নিয়েছে বারবার শ্রীমঙ্গলে। নিজেকে ইবন বতুতার ছোট ভাই ছোট ভাই লাগছে।
ইবন বতুতার পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন বতুতা। জন্ম ১৩০৪ সালে, মৃত্যু ১৩৬৮। জন্ম মরক্কোর তাঞ্জিয়ারে। তিনি তার ২১ বছর বয়স থেকে পরবর্তী ৩০ বছর শুধু পৃথিবী পরিভ্রমণ করেছেন। প্রায় এক লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার অঞ্চল তিনি ভ্রমণ করেছেন। বেরিয়েছেন সব মুসলিম বিশ্বসহ ৪০টি দেশ। ৩০ বছর ভ্রমণ করে তিনি তার দেশে ফিরে ‘রিহলা’ নামে একটি ভ্রমণ কাহিনী লেখেন, যেটিতে তার এই বিশ্ব ভ্রমণের সব কিছু লিপিবদ্ধ হয়েছে। ১৪ শ’ শতকের পূর্ব, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সাম্রাজ্যের ইতিহাসের অন্যতম দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই রিহলা গ্রন্থকে। তিনি সেই সময়ে মিসর, সৌদি আরব, সিরিয়া, ইরান, ইরাক, কাজাকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীন ইত্যাদি দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। তার কিছুকাল আগে এমন দীর্ঘ ভ্রমণ করে বিখ্যাত হয়েছিলেন ভেনিসের ব্যবসায়ী ও পরিব্রাজক মার্কো পোলো। কিন্তু তিনি মার্কো পোলোর চেয়েও তিন গুণ বেশি পথ সফর করেছিলেন। ভ্রমণকালে তিনি এই উপমহাদেশের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, সুফি, সুলতান, কাজী ও আলেমদের সাক্ষাৎ লাভ করেন।
ভারতবর্ষসহ বাংলাদেশ তিনি ভ্রমণ করেন। যখন তিনি ভারতবর্ষে আসেন তখন দিল্লির বাদশা সুলতান মোহাম্মদ শাহ। সেটা ১৩৩৩ সাল। সুলতান তাকে দু’টি ছোট গ্রাম দিয়ে দেন যাতে করে এর থেকে সংগৃহীত রাজস্ব উত্তোলন করে তিনি তার খরচ চালাতে পারেন। এরপর তিনি মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা হয়ে চীন ভ্রমণের পথে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে আসেন। সেখান থেকে তিনি সিলেটে যান হজরত শাহ জালালের রহ:-এর সাথে দেখা করতে। হজরত শাহ জালাল রহ: তাকে একটি ছাগলের পশমের কোট উপহার দেন।
বর্তমান মুম্বাই অঞ্চলটি সাতটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এই সাতটি দ্বীপের নাম বোম্বাই, পারেল, মাহিম, মাজাগাঁও, কোলাবা, বরলি ও ওল্ড ওম্যানস আইল্যান্ড। শহরের জনসংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। আগে এর নাম বোম্বে বা বোম্বাই হলেও ১৯৯৫ সালে শহরের নাম পরিবর্তন করে মুম্বাই রাখা হয়।
মগধের বৌদ্ধ মৌর্যসম্রাট অশোক এই অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন। পর্তুগিজ ও ব্রিটিশরা শাসন করেছে মুম্বাই। মুসলিম শাসন আমলে ১৪৩১ সালে নির্মিত হয় বিখ্যাত হাজী আলীর দরগা।
মুম্বাইয়ের অধিবাসীরা নিজেদের মুম্বাইকর বা মুম্বাইট বা বম্বেইট নামে অভিহিত করেন। মুম্বাই ভারতের প্রধান বহুভাষিক শহর। ভারতের প্রধান ভাষাগুলোর মধ্যে ১৬টি এই শহরে কথিত হয়। সরকারি ভাষা মারাঠি। মুম্বাইয়ের ভাষাগত জনপরিসংখ্যা নিম্নরূপ: মহারাষ্ট্রীয় (৬০%), গুজরাটি (১৯%) এবং অবশিষ্টাংশ ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত। হিন্দির তেমন প্রভাব নেই। তারপরও সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা এই মুম্বাই থেকে তৈরি হয়!
২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে ফোর্বস পত্রিকার ‘টপ টেন সিটিজ ফর বিলিয়নেয়ারস’ তালিকায় সপ্তম এবং ওই সব বিলিয়নেয়ারদের গড় সম্পত্তির হিসাব অনুযায়ী প্রথম স্থান দখল করে মুম্বাই। এই শহর যেমন ধনীর নিবাস, তেমনি বস্তির শহর বললেও ভুল হবে না। এশিয়ার বৃহত্তম ‘ধারাভি’ বস্তি মুম্বাইতেই। ট্রাফিক জ্যামও কম নয় এই শহরে। নামকরা দুই ক্রিকেট তারকা- শচিন টেন্ডুলকার ও সুনীল গাভাস্কার এই শহরে থাকেন।
আমরা গেলাম হাজী আলীর মাজার। সাধক হাজী আলীর বিখ্যাত মসজিদটি আরব সাগরের বেশ কিছুটা ভেতরে অবস্থিত। মূল রাস্তা থেকে সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে একটি পথ চলে গেছে মাজার অবদি। জোয়ারের সময় শুভ্র এই মাজারটিকে মনে হয় পানির মধ্যে ফুটে থাকা একটি সাদা পদ্মফুল। শোনা যায় হাজী আলীর দরগায় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যান নিজেদের মনের ইচ্ছা পূরণ হওয়ার জন্য।
সি লিঙ্ক (Sea Link) দিয়ে আমরা এবার যাচ্ছি জুহু বিচে। এই সি লিঙ্ক হচ্ছে সমুদ্রের ওপর দিয়ে একটি বিশালাকার নান্দনিক ব্রিজ। নদীর ওপর ব্রিজ দেখেছি- তারা সমুদ্রের ওপর ব্রিজ বানিয়ে বসে আছে। ব্রিজটি ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর নামে।
জুহু বিচ থেকে ফেরার পথে ট্যাক্সি ড্রাইভার একটি বাড়ির সামনে এসে গাড়ি ভিড়িয়ে বললেন, ‘জনাব, ইয়ে জলসা’। জলসা অমিতাভ বচ্চনের বাড়ি। অভিষেক-ঐশ্বরিয়াও এখানে থাকেন। চারতলা বাড়ি। কিছু দর্শনার্থী আমাদের মতোই ভিড় করে আছে।
আরব সাগরের পাড়ে দরজার মতো নির্মিত গেটটি আকারে বিশাল। ব্রিটিশ রাজা জর্জ দ্য ফিফথ ১৯১১ সালে এই দরজা বা সমুদ্র বন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। তার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য এই বিশালাকৃতির গেট নির্মাণ।
আরো শুনলাম মহাত্মা গান্ধী যখন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরেছিলেন, তখন তিনিও এই পথেই এসেছিলেন। এই দরজার উল্টো দিকেই বিখ্যাত তাজ হোটেল। এই হোটেলটি ২০০৮ সালে জঙ্গি হামলার শিকার হয়েছিল। এই গেটের সামনেও প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সিনেমার শুটিং হয়ে থাকে। এখানে দূরবীনের ব্যবস্থা রয়েছে। টাকা দিয়ে আরব সাগরের দূরে আরো দূরে যতদূর চোখ যায়। সমুদ্রে ভাসছে শত শত ট্রলার, স্পিডবোট। তা দিয়ে ঘুরে আসা যায় সমুদ্রে।
আমি মুম্বাইতে হোটেলে থাকিনি। যারা থাকতে চান তারা পুরনো মুম্বাইতে সাধারণ মানের হোটেল বাজেটের মধ্যেই পেয়ে যাবেন (১৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা)। ভালো হোটেল এই এলাকায়ই আছে। হোটেলের আশেপাশেই পাবেন খাবার হোটেল। আর কলকাতা হয়ে মুম্বাই যেতে হলে কলকাতায় নিউ মার্কেটের আশপাশেই আছে রেল বা এয়ার বুকিংয়ের ব্যবস্থা। সূত্র : নয়া দিগন্ত