মো. জাভেদ হাকিম
রাঙামাটি জেলার দুর্গম পাহাড় ও গহীন অরণ্য পেরিয়ে গিয়েছিলাম সিজুক জলপ্রপাতে। আগের দিন রাতে রওনা দিয়ে পরের দিন সকাল ৭টায় দিঘিনালা পৌঁছাই। দিঘিনালা গেস্ট হাউসে ফ্রেস হতে হতেই চান্দের গাড়ি ও গাইড এসে হাজির। ওদের সঙ্গে আগে থেকেই কথা বলে রাখায় দরদাম নিয়ে সময় খুব একটা নষ্ট হয়নি। সকাল ৮টার মধ্যেই রাঙামাটির নন্দরাম গ্রামের উদ্দেশে বের হয়ে যাই। পার্বত্য জেলার পিচঢালা পাহাড়ি পথে লক্কর-ঝক্কর চান্দের গাড়ির ছাদে চড়ার যে কী আনন্দ তা লিখে বুঝানো সম্ভব না। কখনো গভীর গিরিখাদ, কখনো গগনচুম্বী বৃক্ষের গভীর অরণ্য, কখনোবা ঢেউ খেলানো সারি সারি পাহাড় পিছনে ফেলে জিপ এগিয়ে যায়। পাহাড়ি পথের বাঁক পেরোনো খুবই রোমাঞ্চকর। যতদূর চোখ যায় শুধু মেঘের ভেলা। বেশ কয়েকটি আর্মি চেক পোস্ট পার হয়ে ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই নন্দরাম গ্রামে এসে হাজির হই। বাজার থেকে আরও দুজন গাইড নিয়ে এবার সুশৃঙ্খলভাবে ট্র্যাকিং শুরু করি। এতটা সময় যা ছিল দৃষ্টির সীমানায়, সেই দিগন্ত ছোয়া পাহাড়ের বুকে হাঁটছি। চারপাশে চমত্কার ও দীর্ঘ দিন মনে রাখার মতো সব প্রাকৃতিক দৃশ্য! কখনো ওপরে কখনো নিচে, কখনোবা আবার জুমঘরে বা আকাশ ছোঁয়া গাছের ছায়ায় বসে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে দে-ছুট বাহিনী সিজুক পানে এগিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় জুমের ফরমালিনমুক্ত মারফা, বাঙ্গি দেহ-মনের শক্তি জুগিয়েছে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা হাঁটার পর সিজুক জলপ্রপাতের প্রথমটার দেখা পাই। বাহ্ কী সুন্দর! বিশাল বিশাল গাছের নিচে পাহাড়ের গা গলে অবিরাম জলের ধারা বইছে। নিঃশব্দ চারপাশ। ঝরনার রিমঝিম শব্দে বন্ধুরা উচ্ছ্বসিত। সবাই গা ভিজাতে চায়, আমি বারণ করি; কারণ আমাদের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে প্রকৃতির আরেক বিস্ময়।
আরও প্রায় এক ঘণ্টা হাইকিং-ট্র্যাকিং করার পর সিজুক ঝরনা থেকে সৃষ্ট ঝিরির দেখা পাই। আশ্চর্য! অন্যান্য ঝিরিপথের চেয়ে এই পথটা যেন খুব বেশি রোমাঞ্চকর। লতাগুল্ম পানিতে আছড়ে পড়েছে। প্রয়োজনীয় রসদ কাঁধে-মাথায় নিয়ে নেমে পড়ি অজানা ঘোলা জলে। পানির নিচে নরম কাদা, হাঁটু-কোমর পানিতে কোথাওবা পা প্রায় ১০ থেকে ১৫ ইঞ্চি পর্যন্ত দেবে যায়। ভয় হয় পুরো দেহটা না আবার দেবে যায়! প্রায় ত্রিশ মিনিট হাঁটার পর সিজুক জলপ্রপাতের দ্বিতীয়টির দেখা পাই।
ওয়াও! সিজুক সত্যিই তুমি রূপের পসরা সাজিয়ে রেখেছ এই গহীন বন-জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ে! প্রায় সত্বর ফিট ওপর থেকে অবারিত পানির ধারা গড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের পাদ দেশে। ঝরনার পানির প্রবল চাপে চমত্কার বেসিন সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে সাঁতার কাটলেও মন ভরবে না, সে এক অপার্থিব সুখ। সুনসান নীরবতা ভরিয়ে তুলেছে ঝরনার রিমঝিম গান। শিকারি জোঁকগুলো যেন পালিয়েছিল আমাদের উদ্দীপনার কাছে হার মেনে। আনন্দের জোয়ারে ভেসে নির্ভয়ে ব্যাগট্যাগ রেখে সবাই নেমে যাই অবগাহনে। দীর্ঘক্ষণ জলকেলিতে মেতে থাকি। এরই মধ্যে দে-ছুটের নতুন বন্ধু ফারুক নুডলস রেঁধে ফেলেছে। মায়াবী প্রকৃতি দিয়ে ঘেরা ঝরনার পাশে কলাপাতায় করে নুডলস খাওয়ার অতুলনীয় স্বাদ মনে থাকবে বহুদিন। এবার ফেরার পালা। শুধু ওপর দিকেই উঠতে হবে। বারবার পিছন ফিরে তাকাই আর আপন মনে বিড় বিড় করে বলি—প্রকৃতি তুমি কত সুন্দর করে সাজিয়েছ আমাদের দেশটাকে। আমরা সত্যিই ভাগ্যবান!
যোগাযোগ
সিজুক ঝরনার অবস্থান রাঙামাটি জেলায় হলেও খাগড়াছড়ি দিয়ে যাতায়াতে সুবিধা বেশি। ঢাকা থেকে বিভিন্ন পরিবহনের বাস খাগড়াছড়ি যায়, তবে শান্তি পরিবহনে দিঘিনালা পর্যন্ত যেতে পারবেন। থাকার মতো বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল আছে, তার মধ্যে দিঘিনালা গেস্ট হাউসের মান তুলনামূলকভাবে ভালো। দিঘিনালা থেকে নন্দরাম চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করে যাওয়া-আসার ভাড়া নেবে ৩,০০০ থেকে ৩,২০০ টাকা পর্যন্ত। গেস্ট হাউস রুম ভাড়া কাপল বেড ৬০০ টাকা, গাইড বাবদ খরচ হবে ১,৫০০ থেকে ২,০০০ টাকা। ঢাকা থেকে নন-এসি পরিবহনে দিঘিনালা পর্যন্ত ভাড়া ৫৮০ টাকা।
টিপস
সিজুক জলপ্রপাতে এখনো পর্যটকদের পদচারণা খুব বেশি হয়নি, সুতরাং ভ্রমণকালীন দলবদ্ধ থাকুন। পর্যাপ্ত পরিমান শুকনো খাবার, পানি, টর্চ, মশা ও জোঁক প্রতিরোধের ক্রিম এবং শক্ত লাঠি রাখুন। আদিবাসীদের সাথে বিনয়ের সহিত কথা বলুন। দশ নং আর্মি ক্যাম্পে নাম-ঠিকানা খাতায় লেখার সময় গাইডের সাথে কথা বলে নিন। প্রয়োজনে দায়িত্বরত আর্মিদের সাথে গাইডকে দিয়ে কথা সেরে নিন। সৌজন্যে: ইত্তেফাক