Skip to content

গাঙচষার খোঁজে দমারচরে

Damarchar

গাজী মুনছুর আজিজ
সাগরের কোলঘেঁষে মেঘনা নদীর মোহনায় দমারচরের অবস্থান। চরের কিছুটা অংশ জুড়ে ম্যানগ্রোভ বন। বাকিটা কাদা-বালু। নোয়াখালীর হাতিয়ার দক্ষিণে জাহাজমারা-মোক্তারিয়া চ্যানেলের পাশে এ চর। এর আগে একাধিকবার এসেছি এ চরে। একাধিক আসার কারণ চরের আকর্ষণ। আর আকর্ষণের কারণ- পাখি। বিপন্ন দেশি-গাঙচষাসহ নানা প্রজাতির পাখি এখানে দেখা যায়। মূলত বাংলাদেশে দেশী গাঙচষা পাখির একমাত্র আবাসস্থল এ চর। পাখি দেখতেই এ চরে বারবার আসা। প্রতিবার এ চরে আসি শীত মৌসুমে। এবার এসেছি বন্ধু ওমর শাহাদাতের সঙ্গে, শরতের শেষ দিকে। দলে আরও আছেন শুভ সাহা ও আবু তাহের। শাহাদাত এ চরে উপকূলীয় জলচর পাখি নিয়ে কাজ করেন। তিনি নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট নামক সংস্থার মনিটরিং কর্মকর্তা। এ সংস্থা উপকূলীয় অঞ্চলে বিশ্বব্যাপী বিপন্ন জলচর পাখি সংরক্ষণ উপ-প্রকল্পের হয়ে কাজ করছে।

শরতের এক বিকেলে সদরঘাট থেকে ফারহান-৪ লঞ্চে উঠি। সন্ধ্যায় লঞ্চের ছাদে কিছুক্ষণ আড্ডা দিই। তারপর রাতের খাবার। সকাল সাড়ে ৭টায় আসি হাতিয়ার তমরুদ্দিন ঘাটে। ঘাটে দুলাল সরকারের হোটেলে চা-নাশতা খেয়ে রিকশায় আসি বেকের বাজার। সেখান থেকে চান্দের গাড়িতে শরীফের দোকান। তারপর হেঁটে নতুন সুখচর গ্রামের কালামচর স্লুইস গেট বাজার। বাজারের পাশেই তাজুল ইসলামের বাসা। তাজুল পাখি সংরক্ষণ প্রকল্পের স্থানীয় পথপ্রদর্শক। আমরা তার বাসায় উঠি।

দুপুরে খাওয়ার পর ট্রলারে উঠি দমারচরের উদ্দেশে। পথে বনের গাছে দেখি ধলাপেট সিন্ধু ঈগল। ত্রিশ মিনিটের মাথায় নামি দমারচরে। অনেক প্রজাতির পাখি দেখি। এর মধ্যে ছিল কালা মাথা কাস্তেচরা, ইউরেশিও গুলিন্দা, নদীয়া পানচিল ইত্যাদি। টেলিস্কোপ ও দুরবিন দিয়ে পাখি গণনা করে তা খাতায় লিখিও। সন্ধ্যার আগে ফিরি বাসায়।

সন্ধ্যার পর কালামচর স্লুইস গেট বাজারে আসি চা খেতে। মূলত এ স্লুইস গেট মাছ ধরার নৌকার ঘাট। আর ঘাটেই মাছের আড়ত। এ ঘাট ও আড়ত ঘিরেই বাজার। এ ঘাট থেকেই জেলেরা নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে যান সাগরে। তারা ঘাটেই থাকেন, জাল বোনেন, জাল মেরামত করেন।

বাজারে দোকানের সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০টি। ফার্মসিও আছে দুই-একটি। বাজার জমে সন্ধ্যার পর। বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতারা অধিকাংশই জেলে। সারা দিন কাজ শেষে সন্ধ্যার পর তারা বাজারে আসেন প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে, আড্ডা মারতে। দোকানগুলোতে জেনারেটরে চলে টিভি, টর্চলাইট অথবা মোবাইলের ব্যাটারির চার্জের কাজ। কিছু দোকানে সৌরবিদ্যুৎ আছে। পরের দিন খুব সকালে যাওয়ার কথা চরে। কারণ সকালে বেশি পাখি দেখা যায়। কিন্তু বৃষ্টির কারণে দেরি হয়। পরে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই উঠলাম ট্রলারে। বৃষ্টির মধ্যে ভিজে পাখি দেখি কিছুটা সময়। বৃষ্টি কমল দুপুরের আগে। দেশি-গাঙচষাসহ আজও দেখি নানা প্রজাতির পাখি। অন্য পাখির মধ্যে দেখি নদীয়া পানচিল, পাকড়া উল্টোঠুঁটি, বাটান, পানকৌড়ি, বক ইত্যাদি।

এ চরের সবুজ ঘাস মনে হয় অন্য ঘাসের চেয়ে একটু বেশি সবুজ। যেন জমিনে বিছানো সবুজ গালিচা। দেখলেই বসে যেতে ইচ্ছে করে। তবে আমরা না বসলেও সবুজ এ গালিচায় বসে আছে ঝাঁকে-ঝাঁকে নানা প্রজাতির পাখি। চরের যেখানে কাদা-বালু সেখানেও বসে আছে অসংখ্য পাখি। অবশ্য সব পাখিই যে বসে আছে তা কিন্তু নয়, আমাদের চারপাশেই ঝাঁকে-ঝাঁকে পাখির ওড়াউড়ি চলছে। মনে হল পাখিগুলো তাদের ওড়াউড়ির নানা কসরত দেখাচ্ছে আমাদের।

তবে পাখির এ চরে ইদানীং দু’চার ঘর মানুষের বসতিও গড়ে উঠছে। যা এ চরের পাখিদের বেঁচে থাকার জন্য ক্ষতিকর। তার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর চরে গরু-মহিষের বিচরণ। এসব গরু-মহিষ যারা চরায় তাদের স্থানীয় ভাষায় বাথাইন্না বলে। অধিকাংশ বাথাইন্না বয়সে শিশু। মূলত বাথাইন্নারা এ চরে বেশি বসবাস করছে। বাথাইন্নারা চরে থেকেই গরু-মহিষ লালন-পালন করে, দুধ বিক্রি করে। আর গরু-মহিষের মালিকরা থাকেন লোকালয়ে। তারা মাঝেমধ্যে গরু-মহিষ ও বাথাইন্নাদের খোঁজ নিতে আসেন। বাথাইন্নাদের বেতন বছর হিসেবে। বেতনের পরিমাণ খুব বেশি নয়। এ বেতনের জন্যই বাথাইন্নারা লেখাপড়া বাদ দিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে এ চরে থাকে।

ট্রলারে আসতে আসতে শাহাদাত জানাল, বাংলাদেশে ১০ প্রজাতির ‘বিশ্বব্যাপী বিপন্ন’ সৈকত পাখি রয়েছে। এর সব কয়টি প্রজাতিই এ দমারচরে দেখা যায়। সেজন্য এ চরের গুরুত্ব অনেক। কিন্তু চরে গরু-মহিষের বিচরণ, পাখি শিকার, জেলেদের মাছধরা, মানুষের পদচারণাসহ নানা কারণে এ চরে পাখির বিচরণ কমছে। আর এসব পাখি রক্ষা ও স্থানীয়দের মাঝে পাখি বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যই তারা কাজ করছে। এজন্য দমারচরের আশপাশের লোকালয়ে তারা নানা অনুষ্ঠানের আয়োজনও করে থাকে।

প্রয়োজনীয় তথ্য : দমারচর গেলে কেবল পাখি দেখার ইচ্ছা নিয়েই যাওয়া উচিত। সদরঘাট থেকে প্রতিদিন বিকালে ফারহান লঞ্চ ছাড়ে তমরুদ্দিনের উদ্দেশে। লঞ্চ থেকে নেমে চান্দের গাড়ি বা অটোরিকশায় যাওয়া যাবে নতুন সুখচর। সেখান থেকে মাছ ধরার ট্রলারে দমারচর। খাওয়ার জন্য কালামচর স্লুইস গেট বাজারে হোটেল আছে। থাকার জন্য হোটেল পাবেন জাহাজমারা বাজারে।
ছবি : লেখক। সৌজন্যে : যুগান্তর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *