Skip to content

গা ছম ছম করা বাদুড় গুহা

:: আব্বাস হোসেন ::

গুহার মুখ দেখলেই গা ছম ছম করে ওঠে। ভেতরে ঘুটঘুট অন্ধকার। মনে হবে যেন অচিন কোনো এক রাজ্য। মশাল জ্বালিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই রোমাঞ্চকর পরিবেশ। গুহার মুখটা একটু সরু হলেও ভেতরে খোলামেলা। গুহার ভেতরে প্রবেশ করতেই সামান্য পানি মাড়িয়ে যেতে হয়। সামনে যতই পা চালাবেন, ততই গা শিউরে উঠবে। তবে মন চাইবে আরও ভেতরে যেতে।

গুহায় প্রবেশ করতে পাহাড় বেয়ে উঠতে ঝুঁকি রয়েছে। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের পটিয়ার সীমান্তবর্তী গহিন অরণ্যে দুর্গম পাহাড়ি এলাকার নতুন আবিষ্কৃত সুড়ঙ্গের কথা বলা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনের কাছে এটি ‘বাদুড় গুহা’ নামে পরিচিত।

আধা কিলোমিটারের এই সুড়ঙ্গের শেষ মাথাটা খুবই সরু। বের হওয়ার তেমন পরিবেশ নেই। ফিরতে হবে একই পথে। মূল এই গুহা ছাড়াও পাহাড়ে ছোট ছোট তিন স্তরের আরও তিনটি গুহা (সুড়ঙ্গ) রয়েছে। তবে এই গুহায় প্রবেশ করতে পাহাড় বেয়ে উঠতে ঝুঁকি রয়েছে। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের পটিয়ার সীমান্তবর্তী গহিন অরণ্যে দুর্গম পাহাড়ি এলাকার নতুন আবিষ্কৃত সুড়ঙ্গের কথা বলা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনের কাছে এটি ‘বাদুড় গুহা’ নামে পরিচিত।

চট্টগ্রাম শহর থেকে কাপ্তাই সড়কপথে ৪৫ কিলোমিটার পাড়ি দিলেই পৌঁছা যাবে এই জায়গায়। আর রাঙ্গুনিয়া উপজেলা সদর থেকে গোডাউন সরফভাটা কালিন্দি রানি সড়ক হয়ে যেতে ২০ কিলোমিটার পথ পেরোতে হবে। লোকালয় থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে গুহাটি।

পদুয়া ইউনিয়নের রাজার হাটের আগে সড়ক দিয়ে পেকুয়াপাড়া পর্যন্ত যানবাহনে যাওয়া যায়। পেকুয়াপাড়া থেকে ‘ভান্ডালজুড়ি ছড়া’ দিয়ে হেঁটে পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ বেয়ে গুহায় পৌঁছতে হয়। পেকুয়াপাড়া থেকে বাদুড় গুহার দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। এই দূরত্বের পরতে পরতে রয়েছে রোমাঞ্চ, আছে ঝুঁকিও। গুহায় প্রবেশের আগ মুহূর্তে পাহাড়ের খাদ বেয়ে নামতে হয়। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই স্থানটি পেরোতে পারলেই বাদুড় গুহা জয় করা সম্ভব।

আগেই বলে রাখি, শারীরিকভাবে সক্ষম কিংবা যাঁরা অ্যাডভেঞ্চার করেন, তাঁদের জন্য এই জায়গা। বর্ষাকালে এই স্থান ভ্রমণের উপযোগী হবে না। ওখানে যেতে অবশ্যই আগে প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে। জনমানবশূন্য এই এলাকায় যেতে স্থানীয় লোকজন কিংবা গাইডের সহায়তা নিতে হবে। সঙ্গে নিতে হবে পর্যাপ্ত পানি, শুকনো খাবার, আলাদা পোশাক, রশি, হাঁটার জন্য সহায়ক লাঠি বানাতে কিংবা কোনো কিছু কাটার প্রয়োজনে দা অথবা ছুরি। পাহাড়ি ছড়ার পানিতে হাঁটার উপযোগী জুতা। স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলে হাঁটা যায়। প্রয়োজনে নেওয়া যেতে পারে প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জামাদি।

সম্প্রতি এক সকালে সুড়ঙ্গের সন্ধানে যেতে যেতে পদুয়া ইউনিয়নের পেকুয়াপাড়ায় পৌঁছাই। স্থানীয় একটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা অধ্যুষিত জনগোষ্ঠীর পাড়ায় সাইমন মারমা নামে এক ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া যায়, যিনি পর্যটকেরা গেলে গাইড হিসেবে সহযোগিতা করেন। সে সময় আল হাসান নামের চট্টগ্রাম নগরের একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক আল হাসান মঞ্জু ৩০ জনের একটি দল নিয়ে সুড়ঙ্গের উদ্দেশে যেতে পেকুয়াপাড়ায় প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

ওই দলসহ স্থানীয় সাইমন মারমাকে নিয়ে আমরা পেকুয়াপাড়া থেকে যাত্রা করি। তখন বেলা সাড়ে ১১টা। সামান্য বিলের আল পেরিয়ে পাহাড়ি ছড়ার পানিতে নেমেই হাঁটা শুরু করি। দেড় কিলোমিটার পথ পেরোতেই উঁচু পাহাড় বেয়ে আবার ছড়া পেরোতে হবে। এভাবেই ছড়া আর পাহাড় বেয়ে পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বেলা দুইটার দিকে পৌঁছাই গুহায়। লোকজনের আওয়াজ শুনে গুহায় প্রবেশের আগে গুহা থেকে প্রচুর বাদুড় বের হতে দেখা যায়।

যেতে যেতে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যে চোখে পড়ে। বেশ কয়েকজন লোককে দেখা যায় গহিন বন থেকে বাঁশ ও কাঠ কেটে বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা ও পথনির্দেশক সাইমন মারমার সঙ্গে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বন থেকে কাঠ কাটার জন্য লোকজন ওখানে গেলে ১৫০ বছর আগে স্থানীয় লোকজন গুহাটি দেখতে পান। একসময় গুহায় শত শত বাদুড়ের অবস্থান ছিল। যাওয়ার পথে ভয়ও ছিল হিংস্র জীবজন্তুর। এখন জীবজন্তু নেই, তেমন বাদুড়ও দেখা যায় না।’ তবে মাঝেমধ্যে বন্য হাতির উপদ্রব রয়েছে। কারও কারও ধারণা, গুহাগুলো কেউ তৈরি করেছেন। তবে স্থানীয় লোকজন বলছেন, এসব গুহা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে। শত বছর আগে বাদুড় শিকার করতে স্থানীয় একজন গুহায় প্রবেশ করলে আর ফেরেনি। কথাটি স্থানীয় লোকজনের সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। তবে কথাটি সঠিক কি না, নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় পাক্ষিক পত্রিকা ‘রূপালি রাঙ্গুনিয়া’র সম্পাদক ও ইতিহাস গবেষক এনায়েতুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক আগেই কয়েকজনকে নিয়ে বেশ কয়েকবার গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি। যাওয়ার পথে হিংস্র জন্তুর আবাস পেয়ে চলে আসা। সর্বশেষ গত মাসের মাঝামাঝি গুহায় যাওয়ার সুযোগ হয়।’ তাঁর ধারণা, আরকান রাজার যুদ্ধবিগ্রহের রহস্যজনক নিরাপত্তার সুড়ঙ্গ হতে পারে এটি। তবে এসব সুড়ঙ্গ নিয়ে আরও গবেষণা দরকার।

সুড়ঙ্গ দেখতে আসা শিক্ষক আল হাসান মঞ্জু বলেন, ‘ফেসবুকে একজনের স্ট্যাটাস ও ছবি দেখে মূলত এখানে আসার কৌতূহল সৃষ্টি হয়। ৩০ জনের একটি দল নিয়ে এখানে এসেছি। সুড়ঙ্গে পৌঁছার আগ পর্যন্ত রয়েছে মৃত্যুঝুঁকি। পাহাড়ের পাদদেশ বেয়ে গুহায় নামতে পা পিছলে গভীর খাদে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়া এখানে হাঁটা খুব বিপজ্জনক। এসে মনে হলো, এটি গুহা নয় যেন মৃত্যুকূপ। যাঁদের অ্যাডভেঞ্চারের শখ, তাঁরা আসতে পারেন।’

ওই দলের একজন মো. জয়নাল বারী। চট্টগ্রাম নগরীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তিনি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে এসে খারাপ লাগেনি। পথে যেতে ঝুঁকি রয়েছে। শারীরিকভাবে একটু কষ্ট হয়েছে। রোমাঞ্চ আর অ্যাডভেঞ্চার অভিযান এটি। ছাত্র হিসেবে অ্যাডভেঞ্চার দরকার মনে করি। তবে এখানে এলে শারীরিক সক্ষমতা থাকতে হবে। অবশ্যই আগে প্রস্তুতি নিয়ে না এলে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। নারী ও শিশুদের না আসা ভালো।’ সৌজন্যে: প্রথম আলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *