Skip to content

গোখরার গ্রাম নন্দীপাড়া

Gokhra

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্, রাহাত খান ও সঞ্জয় দাস লিটু
দেশের সর্বদক্ষিণের উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর নন্দীপাড়া গ্রাম। এখানে গড়ে উঠেছে গোখরার খামার, যেখানে রয়েছে তিন প্রজাতির প্রায় আড়াইশ’ সাপ।

প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না থাকলেও সৌদি প্রবাসী আব্দুর রাজ্জাক নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন এ সাপের খামার।

রাজ্জাকের এই খামারে লালন করা সাপের বিষ প্রক্রিয়াজাত করে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একটু নজর দিলেই শিল্প হিসেবে অপার সম্ভাবনাময় এই সাপের খামার দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রতিবছর বিদেশ থেকে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার বিষ আমদানি করা হয়। কিন্তু দেশে সাপের খামার গড়ে তোলা হলে বিদেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। ফলে বছরে বেঁচে যাবে এই ৮ হাজার কোটি টাকা।

রাজ্জাকের এই খামার দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাশের গ্রামেও একটি সাপের খামার গড়ে তুলেছেন বিলাস দাস নামে এক ব্যক্তি।

সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পটুয়াখালী জেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণে নন্দীপাড়া গ্রামে ৫০ ফুট বাই ৩০ ফুটের একটি পাকা ভবনে চলছে রাজ্জাকের সাপ লালন-পালন। বিভিন্ন সাইজের নানা প্রজাতির সাপগুলো রাখা হয়েছে আলাদা আলাদাভাবে ছোট ছোট কক্ষে। সাপগুলো এমনভাবে গিজগিজ অবস্থায় পেঁচিয়ে মেঝেতে পড়ে আছে, যা দেখলে গা শিউরে ওঠে।

সংরক্ষিত বলে অনেক দর্শনার্থী উঁকি মেরে সাপ দেখে কৌতুহল মেটান।

ব্যতিক্রমী এই সাপের খামারের উদ্যোক্তা আবদুর রাজ্জাক বলেন, সৌদি আরবে দীর্ঘ প্রবাসজীবনে থাকাকালে তিনি নিকটাত্মীয় বেকারদের বিদেশে নিতে চাইতেন। কিন্তু নানা জটিতলায় কাউকে নিতে পারেননি। ঘনিষ্ঠ বেকারদের জন্য কিছু একটা করার চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এ অবস্থায় ইন্টারনেটে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি সাপের খামারের সন্ধান পান তিনি। এরপর অনলাইনে যোগাযোগ শুরু করেন সেই খামারমালিকের সঙ্গে। সাপের খামারে লাভ-লোকসানের বিষয়টি জানতে চান তার কাছে রাজ্জাক। ক্যালিফোর্নিয়ার ওই উদ্যোক্তা তাকে সাপের বিষ থেকে ব্যাপক আয়ের সম্ভাবনার কথা জানান। এতে উৎসাহিত বোধ করেন তিনি। সৌদি আরবে বসেই পরিকল্পনা আঁটেন সাপের খামার করার। ওই সময়ই বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে সহযোগিতা চান। কিন্তু মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অবগত নয় এবং তাদের পক্ষে কোনো সহযোগিতা করা সম্ভব নয় বলে লিখিতভাবে তাকে জানায়।

তবে এতে দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না রাজ্জাক। ২০০০ সালে ছয় মাসের ছুটি নিয়ে দেশে এসে সাপের খামারের সম্ভাবতা যাচাই করেন এবং মনস্থ করেন সাপের খামার করার। কিন্তু সাপ পাবেন কোথায়!

ইতিমধ্যে একই এলাকার একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে একটি গোখরা সাপের সন্ধান পান তিনি। স্থানীয়দের নিয়ে সেই পরিত্যক্ত ঘর থেকে মা-গোখড়া সাপটি ধরেন রাজ্জাক। সঙ্গে পান ২৪টি ডিম। ডিমগুলো বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করে বাচ্চা ফোটান তিনি। কিন্তু শুরুর দিকে সাপ লালনের নিয়ম না জানায় একে একে মারা যায় সবগুলো বাচ্চা। এরই মধ্যে তার ছুটি শেষ হয়ে যায়। তখন তিনি মা-গোখরাটি রাখার জন্য একটি স্টিলের বাক্স তৈরি করে নিকটাত্মীদের কাছে দিয়ে যান। সৌদিতে বসে সাপ লালনের জন্য নিয়মিত অর্থও পাঠাতে থাকেন। এই সময়ে তার নিকটাত্মীয়রা আরও তিনটি গোখরা ধরে খামার সমৃদ্ধ করেন।

বছর তিনেক পর আবার ছয় মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসেন রাজ্জাক। এর কিছুদিন পরই নতুন সংগৃহীত তিন গোখরা ২৪টি করে ৭২টি ডিম পাড়ে। এর মধ্যে ৫০টি ডিমে বাচ্চা হয়। ধীরে ধীরে কলেবর বড় হয় রাজ্জাকের খামারের।

এদিকে পাশের ইটবাড়িয়া গ্রামের বিলাস দাস ওই সাপের খামারের সংবাদ সংগ্রহ করতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন এটি ব্যাপক লাভজনক ব্যবসা। পরে বিলাসও গড়ে তোলেন সাপের খামার। তার খামারে রয়েছে ৫০টি গোখরা সাপ।

বিলাস বলেন, ‘অপার সম্ভাবনাময় সাপের বিষ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিক্রি না করতে পারায় তেমন একটা লাভ হচ্ছে না। তবে সরকার এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সাপের বিষ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করা সম্ভব।’

রাজ্জাক বলেন, খামারের সাপের প্রধান খাবার ইঁদুর, ব্যাঙ, মুরগির বাচ্চা ও ডিম। এসব খাবার সংগ্রহ করতে লোকবল যেমন দরকার, তেমনি প্রয়োজন অর্থের। সাপগুলোকে যেভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন সেভাবে তিনি কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। ফলে সাপগুলো অপুষ্টিতে ভুগছে।

তিনি বলেন, হিংস্র এই প্রাণী যে কোনো সময় যে-কাউকে দংশন করতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে তিনি মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে সাপে কাটা ব্যক্তিকে সুস্থ করে তুলতে সক্ষম।

রাজ্জাকের এই ব্যতিক্রমী সাপের খামারের খবর জানাজানি হলে দেশের ৩৫ জেলার বিভিন্ন উদ্যোক্তা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে তাদের নিয়ে সাপ লালন-পালনের একটি কর্মশালা করেন তিনি। এদের মধ্যে বরগুনা, রাজশাহী, ঢাকার ধামরাই, যশোর, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলার ২৫ জন সাপের খামার গড়ে তুলেছেন।

খামারি রাজ্জাক বলেন, ‘সরকারের দুটি দফতর বন বিভাগ ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ এ বিষয়ে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসছে না। তবে সরকার যদি এ বিষয়ে নজর দেয়, তাহলে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।’

এক সময়কার পটুয়াখালী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (বর্তমানে বরিশাল) বাদল কৃষ্ণ হালদার বলেন, ‘আমি নিজে কয়েকবার রাজ্জাকের সাপের খামার পরিদর্শন করেছি। অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ আকারে প্রতিবেদনও দেওয়া হয়েছে। এখন অনুমোদনের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা।’

তিনি বলেন, ‘দেশে সাপের বিষের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। স্থানীয়ভাবে সাপের খামার করতে উৎসাহিত ও পৃষ্ঠপোষকতা করা হলে দেশের মুদ্রা সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে হাজার হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশ লাভবান হবে।’

বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের খুলনা বিভাগীয় কর্মকর্তা জাহিদুল কবীর বলেন, ‘সরকার পাখি ও সাপ লালন-পালনের জন্য নীতিমালা তৈরির কাজ করছে। শিগগিরই এ নীতিমালা অনুমোদিত হবে বলে আশা করছি। আর নীতিমালা থাকলে খামারিদের উৎসাহিত এবং সহায়তা করাও সম্ভব হবে।’ সৌজন্যে : বাংলাদেশ প্রতিদিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *