
৩ ডিসেম্বর ১৯৮৬: ঢাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে নোবেল বিজয়ী জার্মান লেখক গ্যুন্টার গ্রাস। সঙ্গে স্ত্রী উটে গ্রাস। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
নাসির আলী মামুন
নোবেল বিজয়ী জার্মান লেখক গ্যুন্টার গ্রাস এসেছিলেন ঢাকায়। সদ্য প্রয়াত এই বিশ্বখ্যাত লেখককে অনুসরণ করেছিল আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনের ক্যামেরা। কেমন ছিল গ্রাসের ঢাকা সফর?
গ্যুন্টার গ্রাস আমাদের আপনজনে পরিণত হয়েছেন বহু আগে। ১৩ এপ্রিল তিনি চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার পর খুব মনে পড়ছে গ্যুন্টার গ্রাসের ঢাকা সফরের সেই দিনগুলো। মনে পড়ে, প্রায় ২৯ বছর আগের সেই দিনের কথা। সাত দিনের ব্যক্তিগত সফরে গ্যুন্টার গ্রাস আসছেন ঢাকায়। ঢাকার জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং কলকাতার গ্যাটে ইনস্টিটিউট যৌথভাবে সফরের ব্যবস্থাটি করল। কিন্তু ঢাকায় আলোচিত এই লেখককে সাত দিন সঙ্গ দেবেন কে? সে সময়ের জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক পিটার জেভিত্স চিন্তা করে বের করলেন কবি বেলাল চৌধুরীকে। তিনি ঢাকায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী হবেন গ্যুন্টারের। মুশকিলটা হলো গ্যুন্টারের ঢাকায় অবস্থান গোপন রাখতে চায় জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আবার একই সঙ্গে তাঁর ঢাকা সফর স্মরণীয়ও করে রাখতে চায় ওরা।
গ্যুন্টারের বারণ সত্ত্বেও আমাকে সন্তর্পণে নির্বাচন করা হলো যেন মহতী ভ্রমণটিকে আলোকচিত্রে স্মরণীয় করে রাখা যায়। যখন জানলাম কাজটি আমাকে করতে হবে, ভেতর ভেতর খুব উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠা কাজ করছিল। যদিও তত দিনে আমি অনেক খ্যাতিমান এবং বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্বের পোর্ট্রেট ক্যামেরায় ধারণ করে কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। কাজেই বিশ্বাস ছিল, গ্রাসকে ঢাকায় সামলানো আমার জন্য দুরূহ কাজ হবে না।
বিমানবন্দরে প্রথম দেখা
১৯৮৬ সালের ২ ডিসেম্বর। ঢাকা বিমানবন্দরে কলকাতা থেকে আসা যাত্রীরা বের হয়ে আসছেন। আমরা চোখ রাখছি। ভিড়ের মধ্যে ট্রলি ঠেলে গ্যুন্টার গ্রাস স্যুটকেস ও ব্যাগ নিয়ে স্ত্রী উটের সঙ্গে চলে এলেন আমাদের সামনে। আমি একটু সাবধািন। শুরুতেই হুট করে ছবি তুলে বিরাগভাজন হতে চাই না। তাই ক্যামেরাটা প্রায় লুকিয়ে একটু দূর থেকে ক্লিক করলাম। তারপর কিছুটা কাছে চলে এলাম। ততক্ষণে বুঝে গেলাম আমাকে তিনি বাধা দেবেন না। ভরসা পেয়ে কয়েকটা ছবি তুললাম। গ্রাস আপত্তি করলেন না।
ধানমন্ডি ২৮ নম্বর রোডের ফোর্ড ফাউন্ডেশনের রেস্টহাউসে উঠেছিলেন গ্রাস দম্পতি। পরদিন সকালে ঠিক করা হলো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এক রিকশা। তাতে উঠে বসলেন গ্রাস ও তাঁর স্ত্রী। সামনের রিকশায় আমি ও বেলাল ভাই। প্রথমেই রিকশায় ওঁদের ছবি তুলে ফেললাম। গ্রাসের হাতে তাঁর চিরচেনা সেই পাইপ। ঠোঁটের ফাঁকে ঢুকছে আর ধোঁয়া ছড়িয়ে যাচ্ছে। ঘুরতে ঘুরতে আমরা ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লায় চলে আসি। ভেতরে অনেকটা সময় সবকিছু চোখে মেপে মেপে দেখলেন তিনি। দেয়ালে বাংলা লেখা প্রচুর ‘অমুক + অমুক’ জাতীয় প্রেম নিবেদন। গ্রাস জানতে চাইলেন এগুলো কী? বেলাল চৌধুরী অর্থ বুঝিয়ে দিলেন। গ্রাস মজা পেয়ে হাসলেন। হাসি দেখে আমার ক্যামেরা তাঁর আরও কাছে যেতে সাহস পায়। বিরল সব দৃশ্যের ছবি তুলে রাখছি। কেল্লা থেকে বেরিয়ে রাস্তার পাশে ছাপড়ার দোকানে চা খেতে চাইলেন, গরম বাকরখানির ব্যবস্থাও হলো।
পুরান ঢাকার অলিতে–গলিতে
ঢাকায় গ্রাসের ছবি তোলার সময় তাঁর রসিকতা, সঙ্গে থাকা ব্যাগ থেকে বের করে স্কেচবুকে ছবি আঁকা, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ধারণা খুব কাছে থেকে উপভোগ করার দুর্লভ সুযোগ হয়েছিল। কলকাতা ও ঢাকার তুলনা করে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা চাঁদ দেখতে পাও, ওরা পায় না!’ ঢাকার ব্যস্ত প্রায় সব জায়গায় ঘুরেছেন তিনি। একজন দক্ষ সাংবাদিকের মতো তিনি ঢুকে পড়লেন কুমোরদের ঘরের ভেতর। বিস্ময় ভরে দেখলেন ওঁদের হাতে তৈরি নিপুণ মাটির কাজ। তাঁদের সঙ্গে কথা বললেন। একজন মাটির হাঁড়ি তৈরি করছিলেন। বিদেশি খরিদ্দার মনে করে দ্রুত চাকা ঘুরিয়ে বানিয়ে দেখান সুন্দর দুটো হাঁড়ি। স্ত্রী উটে জানতে চাইলেন মাটির এই পট িকসে ব্যবহার হয়। শাঁখারীবাজারে শিল্পীদের কাজ দেখে বিস্ময়ে চোখ আটকে যায় গ্রাসের। অনেকক্ষণ থেকে কাঁধে রাখা ব্যাগের খাতাটা বের করে ছবি আঁকতে চাইছিলেন। কিন্তু বিদেশি মানুষ দেখে ভিড় লেগে যায়। তিনি খাতাটি আবার ব্যাগে ভরে ফেলেন। রাস্তার ধারে মানুষের চুল কাটার দৃশ্য বেশ উপভোগ করেছেন। দেখতে রাশভারি হলেও গ্রাস গল্প করতে ভালোবাসেন। ঢাকার অনেক কিছু তুলনা করতে ভোলেন না কলকাতার সঙ্গে। মজার কিছু দেখলে হো হো করে হাসেন। তখন কে বলবে এই লোকটি বিশ্বখ্যাত একজন মানুষ। পৃথিবীর শীর্ষ লেখকদের অন্যতম!
ঢাকায় প্রায় সব জায়গাতেই তাঁর সঙ্গে ঘুরছি, ধরে রাখছি সবকিছু ক্যামেরায়। ঘুরতে ঘুরতে যা-কিছু তাঁর মনে ধরে হয় তিনি থেমে গিয়ে খুব কাছে থেকে পরখ করেন। উটেকে অনুরোধ করতে দেখেছি সেসব ছবি তুলে রাখার জন্য। স্ত্রীর হাতে পেন্টাক্স ক্যামেরা। সবকিছু নয়, শুধু যেসব দৃশ্যে বিমোহিত হন গ্রাস, সেগুলো ক্যামেরাবন্দী করেন তিনি। বাংলাবাজার, সদরঘাট, ঢাকার নবাবদের আহসান মঞ্জিল, পুরান ঢাকার অলিগলি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দর্শনে বিমোহিত হয়েছিলেন তিনি। সোনারগাঁয়ের পানাম নগরে স্ত্রী উটের হাত থেকে ক্যামেরা চেয়ে ছবি তুলেছেন।
ব্যক্তিগত স্কেচবুকে এঁকেছেন পুরোনো দালান, দরজার নকশা, ক্ষয়ে যাওয়া নিঃসঙ্গ স্তম্ভ। আমি তাঁর সঙ্গে থেকে পরখ করছি কোনো কিছুই তিনি এড়িয়ে চলছেন না। পানামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছবি এঁকেছেন, রাস্তায় ভিড় জমেছে। তিনি নির্বিকার, তাঁর কাজ করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। শাহবাগের জাদুঘরে ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখেছেন মনভরে। বিস্মিত হয়েছেন আমাদের পুরোধা শিল্পী জয়নুল আবেদিনের আঁকা দুর্ভিক্ষের অমর চিত্রকর্মগুলো দেখে।
ফুলকপি ভাজি আর রুইমাছ
ঢাকায় গু্যন্টারের সফরের শেষ দিন নতুন এক ধরনের রেস্টুরেন্টের খবর দেন বেলাল চৌধুরী। সদরঘাটে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর ভাসমান হোটেল। সানন্দে সম্মতি দেন গ্রাস দম্পতি। দুপুরে ফুলকপি ভাজি, তাজা রুইমাছ, ডাল এবং সালাদ। আধঘণ্টার মধ্যে ধোঁয়া উড়িয়ে বুড়িগঙ্গার ভাসমান রেস্টুরেন্টের টেবিলে বাংলা খাবার তৈরি। আমাদের সঙ্গে ছিলেন কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। দেখলাম সুলতানকে গ্রাসের বেশ মনে ধরেছে, সমীহ করে কথা বলেন। কিন্তু শিল্পী সুলতান নির্বিকার। খাওয়া হয়। আড্ডা হয়। চায়ের অর্ডার দেওয়া হয়, গরুর দুধের চা। হঠাৎ ব্যাগ থেকে স্কেচ খাতাটা বের করে সুলতানের দিকে মনোযোগ দিলেন গ্যুন্টার গ্রাস। তাঁর ছবি আঁকলেন।
গ্যুন্টার গ্রাসের সঙ্গে একটি সন্ধ্যা
ঢাকায় ‘গ্যুন্টার গ্রাসের সঙ্গে একটি সন্ধ্যা’র আয়োজন করেছিল জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। সেখানে বক্তৃতায় তিনি বলেছেন মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে থাকা মানুষজনদের দুর্দশার কথা। দর্শকদের মধ্য থেকে লেখক আহমদ ছফা দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘হোল বাংলাদেশ ইজ এ জেনেভা ক্যাম্প।’
বিদায়ের মুহূর্তে গ্যুন্টার গ্রাসের হাতে অনেক দুর্লভ স্মৃতি উপহার দিতেই সেই পরিচিত হাসি। আমার মনে হয়েছিল, তিনি ছবি তুলতে আগ্রহী। আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নীল স্যুটকেসের তলায় যত্ন করে ছবিগুলো রাখতে দেখলাম। পরে জেনেছি, ঢাকায় তোলা ছবিগুলো তিনি জার্মানিতে নিয়ে যেতে পারেননি। চুরি হয়ে যায় আমার ক্যামেরায় তোলা তাঁর দুর্লভ মুহূর্তগুলো।
১৯৯৯ সালে গ্রাস যখন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারটি জয় করেছিলেন, তখন ঢাকা ও কলকাতার অনেকে বলছিলেন পুরস্কারের অর্ধেক আমাদেরও। কলকাতার সঙ্গে এই মানবতাবাদী লেখকের তীব্র নৈকট্য উসকে দিয়েছিল এই দাবির সমর্থনকে।
জিব কাটো লজ্জায়–বইটিতে (জার্মান ভাষায় সুঙ্গে সাইগেন) তিনি কলকাতা ও ঢাকাকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন, সেটি কারও কারও অপছন্দ ছিল। তবুও যে মানবিক বিষয়গুলো তাঁর প্রকাশিত বইয়ে বিশ্বসাহিত্যের পাঠকদের সামনে তিনি তুলে ধরেছেন সেটি অনন্য। তাই তিনি যখন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, সেটি মানসিকভাবে ভাগাভাগি করে নিতে দ্বিধা করিনি আমরা, অন্তত যারা ছিলাম গ্রাসের। সূত্র : প্রথম আলো ছুটির দিনে