বোর্টন অন দ্য ওয়াটার। ইংল্যান্ডের একটি গ্রাম। গ্লস্টারশায়ার কাউন্টির কটসওয়ল্ডসে গ্রামটির অবস্থান। গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট শান্ত নদী-উইন্ডরাশ। গ্রামটি যাতে দুই ভাগ না হয়ে যায়, তাই কিছু দূর পর পরই নদীর ওপর আছে ছোট ছোট পাথরের পুল। এই নদী আর পুলগুলোর কারণে গ্রামটি কটসওয়ল্ডসের ভেনিস নামে বিখ্যাত। তবে এর মূল খ্যাতি অন্য একটি কারণে। ছোট্ট এই ছবির মতো গ্রামের ভেতরে যে আরেকটি খুদে গ্রাম আছে! লিখেছেন নাবীল অনুসূর্য
গ্রামটিতে মরিস পরিবারের মালিকানায় একটা সরাইখানা ছিল। নাম-‘দ্য ওল্ড নিউ ইন’। ১৯৩০ সালের দিকে এই পরিবারের কর্তাদের মাথায় এক অদ্ভুত খেয়াল চাপে। সে জন্য তাঁরা আটজন স্থানীয় পাথরের কারিগরকেও নিয়োগ দেন। সরাইখানার পেছনে মরিসদের যে জমি আছে, সেখানে গ্রামের রেপ্লিকা বানাতে হবে। অর্থাৎ ছোট আকারের হুবহু আরেকটা বোর্টন-ইন-দ্য-ওয়াটার বানাতে হবে।
সম্ভবত তাঁদের মাথায় এই খেয়াল চাপে বেকনস্কটের রেপ্লিকা গ্রাম দেখে। বাকিংহামশায়ারের বেকনস্কটে ইংল্যান্ডের প্রথম রেপ্লিকা গ্রাম বানানো হয়। মরিস পরিবারের কেউ সম্ভবত সেটি দেখেছিল। আর এভাবেই তৈরি হয়ে গেল ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় রেপ্লিকা গ্রাম।
রেপ্লিকা গ্রামটি বানাতে আটজন কারিগরের লেগে যায় পাঁচ বছরের মতো। উপকরণ হিসেবে তাঁরা ব্যবহার করেন চুনাপাথর আর কটসওয়ল্ড পাথর। হিসাবনিকাশ করে তাঁরা রেপ্লিকা গ্রামের আকার ঠিক করেন ১:৯। অর্থাৎ রেপ্লিকা গ্রামটির সব কিছুর আকার হবে আসলের চেয়ে ৯ গুণ ছোট।
গ্রামের ভেতর গ্রাম
আকারে ছোট হলে কী হবে, এতে আসল গ্রামটির সব কিছুই আছে। হুবহু। পুরনো ওয়াটার মিল থেকে শুরু করে ব্যাংক, গির্জা, দোকানঘর-সব। এমনকি পানির নালা কেটে উইন্ডরাশ নদীরও নকল বানানো হয়েছে। তার ওপর আছে ছোট ছোট পাথরের পুল। সেগুলো দেখতে এতটাই আসল স্থাপনাগুলোর মতো, প্রায়ই রেপ্লিকা গির্জার সামনে লোকজনকে হাঁটু মুড়ে প্রার্থনা করতে দেখা যায়। অবশ্য পরে সত্যিকারের দোকানগুলোর নাম পাল্টে যায় বলে, রেপ্লিকার দোকানগুলোরও নাম পাল্টাতে হয়। এ ছাড়া নকল গ্রামের আর সব কিছুই একদম আগের মতোই রাখা হয়েছে। সেখানে গেলে তাই ১৯৩০ সালের একটা আমেজ পাওয়া যায়।
এমনকি রেপ্লিকা গ্রামের গাছগুলোও কেটেছেঁটে ছোট করে রাখা হয়েছে। অনেকটা বড়সড় বনসাইয়ের মতো। শুধু তা-ই না, গ্রীষ্মকালে গ্রামের বাগানগুলোতে ছোট ছোট চেয়ারও পেতে রাখা হয়। বানানো হয় খুদে আকৃতির গ্রিনহাউসও।
তবে রেপ্লিকা গ্রামটির সবচেয়ে মজার জিনিসটি আছে দ্য ওল্ড নিউ ইনের রেপ্লিকাতে। হ্যাঁ, নকল গ্রামের সরাইখানার পেছনেও আছে আরেকটি রেপ্লিকা গ্রাম। মানে, রেপ্লিকা গ্রামের রেপ্লিকা। তার ভেতরেও আছে সে রেপ্লিকা গ্রামের রেপ্লিকা। সে গ্রামের মধ্যেও আরেকটা রেপ্লিকা!
নকল গ্রামটি বানাতে পাঁচ বছর লাগলেও, মরিস পরিবার গ্রামটি উদ্বোধন করে খানিকটা সময় নিয়ে। গ্রামটির উদ্বোধন করা হয় ১৯৩৭ সালের ১২ মে। সেদিন ছিল রাজা ষষ্ঠ জর্জ ও রানি এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেক। দীর্ঘদিন সরাইখানার সঙ্গে এই রেপ্লিকা গ্রামটির মালিক ছিল সেই মরিস পরিবার। ১৯৯৯ সালে সরাইখানাসমেত রেপ্লিকা গ্রামের মালিকানা বদল হয়। মরিস পরিবারের কাছ থেকে ওগুলো কিনে নেন জুলিয়ান ও ভিকি আথারটন।
খুদে গ্রামের প্রতি নতুন মালিকদেরও ভালোবাসার কমতি নেই। স্রেফ ওই রেপ্লিকা গ্রাম দেখাশোনার জন্যই তাঁরা একজন কারিগর ও একজন মালি রেখেছেন। শুধু তা-ই না, তাঁরা সরাইখানায় সম্প্রতি রেপ্লিকার দুটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছেন। একটিতে আছে জন কনস্টেবলের বানানো সাতটি রেপ্লিকা। সমারসেটের ল্যাংপোর্টের এই বাসিন্দা রীতিমতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কারিগর। পরে যে একজিবিশনটি চালু করা হয়েছে, সেখানে ইংল্যান্ডের সেরা কারিগরদের বানানো শতাধিক রেপ্লিকা আছে। সেখানে ঢুকতে অবশ্য এক ইউরো খরচ করতে হবে। এ ছাড়া অন্য রেপ্লিকাগুলো দেখতে কোনো পয়সা গুনতে হয় না।
এখন পর্যন্ত ইংল্যান্ডে এমন রেপ্লিকা গ্রাম আছে প্রায় ৩০টির মতো। এগুলোর বেশির ভাগই অবশ্য কল্পিত গ্রাম। আসল গ্রামের অনুকরণে বানানো রেপ্লিকা অল্প কয়েকটি। সেগুলোর মধ্যেও অবশ্য একদিক দিয়ে বোর্টন অনন্য। একমাত্র এই খুদে গ্রামের সব কিছুই বানানো হয়েছে আসল গ্রামের স্থাপনাগুলোর মতো একই উপকরণ দিয়ে। সূত্র : কালের কণ্ঠ