Skip to content

গ্রিকদের স্মৃতিটুকু থাক

দেড় হাজার বছর আগে ছিল এক প্রহরা চৌকি। স্থানীয়রা তাকে বলত ঢক্কা। ধীরে ধীরে গড়ে উঠল ‘বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির’ এক শহর। মোগল সুবেদার ইসলাম খাঁ ১৬১২ সালে সেই শহরকেই করলেন তার রাজধানী। সেই থেকে যাত্রা হল নগরী ঢাকার। এরপর কত ভাঙা গড়া, কত হাসি কান্নার ইতিহাস এই ঢাকা ঘিরে.......

দেড় হাজার বছর আগে ছিল এক প্রহরা চৌকি। স্থানীয়রা তাকে বলত ঢক্কা। ধীরে ধীরে গড়ে উঠল ‘বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির’ এক শহর। মোগল সুবেদার ইসলাম খাঁ ১৬১২ সালে সেই শহরকেই করলেন তার রাজধানী। সেই থেকে যাত্রা হল নগরী ঢাকার। এরপর কত ভাঙা গড়া, কত হাসি কান্নার ইতিহাস এই ঢাকা ঘিরে…….

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র পাশ দিয়ে বাংলা একাডেমির দিকে এগোলে ডান হাতে নজরে পড়বে হলুদ বর্ণের অতি ক্ষুদ্র একটি ইমারত। দেখতে অনেকটা গ্রিক উপসনালয়ের মত। গ্রিকরা যে এক সময় এই নগরীতে এসেছিল, বাস করেছিল, তারই শেষ স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে এখনো টিকে আছে এটি। ভবনটির প্রবেশদ্বারে ওপরে একটি মার্বেল ফলক। তাতে গ্রিক ভাষায় লেখা : ‘যাদের তুমি (ঈশ্বর) বেছে নিয়েছ এবং সঙ্গে নিয়েছ, তারা ভাগ্যবান’। ভবনটি আসলে একটি সমাধিসৌধ। এর ভেতরে আছে নয়টি সমাধি এবং প্রতিটি সমাধির সঙ্গে আছে স্মৃতিফলক। আজ থেকে দেড়শ-দু’শ বছর আগে ঢাকা নগরীতে যেসব গ্রিক বাস করতেন, তাদেরই মধ্যে কয়েকজনের সমাধি এগুলো।

যে কোন কারণেই হোক, সমাধি ফলকের এ লেখা দীর্ঘকাল চোখ এড়িয়ে গেছে বা দেখলেও গ্রিক ভাষায় লেখা কথাগুলোর অর্থ জানা সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হ’ত, এটা গ্রিকদের সমাধিস্থল। ১৯৯০এর দশকের গোড়ার দিকে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা হিসাবে ঢাকায় আসেন হেলেন আবাদজি নামে এক গ্রিক মহিলা। তিনি একাধারে মনস্তাত্ত্বিক ও গবেষক। তার ব্যক্তিগত আগ্রহেই অর্থ উদ্ধার হয় সবক’টি স্মৃতিফলকের।

ইতিহাস বলে, আরমেনীয়রা আসার এক শতাব্দী পর ঢাকায় আসে গ্রিকরা। ইউরোপীয়দের মধ্যে তারাই সবশেষে আসে বাংলায়। ১৭৮০ থেকে ১৮৬০ পর্যন্ত ঢাকাতে বাস করত বেশকিছু গ্রিক। কলকাতাতে অবশ্য আগে থেকেই বসবাস শুরু হয়েছিল তাদের। সেখানে অনেক ব্যবসা-বণিজ্য নিয়ন্ত্রণও করত তারা। আলেক্সিস আর্জেরিস নামে এক গ্রিক ছিলেন কলকাতার সেরা ধনীদের অন্যতম। ১৭৭৭ সালে তার মৃত্যু হলে তার পুত্ররা বিপুল সম্পদের অধিকারী হন এবং তারা ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন। সম্ভবত তারাই ঢাকায় বসতি স্থাপনকারী প্রথম গ্রিক। এরপর আরো অনেক গ্রিক এই নগরীতে এসে লবণ ও পাটের ব্যবসায় ভাগ্য ফিরিয়েছিলেন। ১৮২১ সালে তারা এখানে একটি উপসনালয় নির্মাণ করেন, যদিও সেটার অবস্থান নিয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। ধারণা করা হয়, ১৮৯৭ সালের প্রচন্ড ভূমিকম্পে সেটি ধূলিসাত্ হয়ে যায়। কর্নেল ডেভিডসনের ভ্রমণকাহিনীতে আছে, গির্জাটি ছিল দৈর্ঘ্যে তিরিশ ফুট ও প্রস্থে বিশ ফুট। তিনি দেখেছিলেন, ঘরের পূর্ব কোণে দুটি বড় মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। দেয়ালের মাঝ বরাবর টাঙানো একটি ভার্জিন মেরির ছবি। মেরি তাকিয়ে আছেন বিছানায় শোয়া এক কিশোরের দিকে। তার পাশে যোশেফ। এর বাম পাশে আরো ভার্জিন মেরির ছবি। সাত-আট ফুট উঁচু। সঙ্গে আরো কিছু চিত্র দেখেছিলেন ডেভিডসন। এসব ছবি যিশু, জিবরাইল এবং অন্য দেবদূতের। ছবিগুলো কাঠ ও তামার ফলকে তৈরি। এছাড়া রাফায়েলের ‘লাস্ট সাফারে’র অনুকরণেও একটা ছবি ছিল। তিনি লিখেছেন, গির্জাটি আহামরি গোছের কিছু ছিল না। উল্লেখ করার মত কিছু দেখাও যায়নি সেখানে। পাদ্রি যিনি ছিলেন তিনিও গ্রিক। থাকতেন গির্জা চত্ত্বরের একটা ঘরে। ডেভিসন শুনেছিলেন যে, গ্রিকরা এখানে বেশিদিন বাঁচে না। তাই এদের সংখ্যা এখানে এত কম। এদেশীয় রমণীদের সঙ্গে গ্রিকদের বিয়ের চল ছিল বলেও ওয়াল্টার সাহেব জানতে পেরেছিলেন। ওয়াল্টার সাহেব উল্লেখ করেন, পাদ্রিদের থাকার আয়োজনটি মোটেও সুখকর ছিল না। ঘিঞ্জি গলির মধ্যে এবং নোংরা, অপরিচ্ছন্ন নর্দমার পাশে তাদের ঘর। এমন পরিবেশে অকালমৃত্যু অস্বাভাবিক কিছু নয় বলে মনে হয়েছিল তার। ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াল্টার সাহেবের হিসাব অনুযায়ী ১৮৩২ সালে এই শহরে গ্রিকদের ২১টি বসতবাড়ি ছিল। জেম্স্ টেলরের ‘আ স্কেস অব টোপোগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিসিটক্স্ অব ঢাকা’তে উল্লেখ আছে, ১৮৪০ সালে এখানে বারোটি গ্রিক পরিবার বাস করত।

এ দেশে গ্রিকদের আসা-যাওয়া যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও কয়েক শতাব্দী আগে থেকে। প্রাচীন গ্রিক পুথি-পত্রে বাংলাকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘স্বর্ণময় অঞ্চল’ হিসাবে। সে আমলে পারস্য ও আরব বণিকদের পাশাপাশি রোমান ও গ্রিকরা এদেশে আসত বাণিজ্য করতে। বাংলা ছিল বিদেশি ব্যবসায়ীদের কাছে স্বর্গভূমি। তবে নানা কারণে গ্রিকরা এখানে স্থায়ী বসবাসের কথা কথনো ভাবেনি। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে হাজি আলেক্সিস (প্রকৃত নাম পানাজিওটিস আলেক্সিও, গোঁড়া খ্রিস্টান, জর্দান নদীতে ‘খ্রিস্টীয় হজ্বব্রত পালন করেছিলেন বলে তাকে বলা হত হাজি আলেক্সিস) নামে এক ব্যক্তি বাস করতেন তুরস্কের ইউরোপীয় অংশে। ১৭৪৯ সালে তিনি স্ত্রী ও তিন সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসেন বাংলায় এবং বসবাস শুরু করেন। এরপর তিনি আরো গ্রিকদের বাংলায় আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। তারই আমন্ত্রণে যারা তখন বাংলায় এসেছিলেন, তাদের মধ্যেই একজন ছিলেন আলেক্সিস আর্জেরিস, যার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এর সন্তানরাই ছিলেন ঢাকার প্রথম গ্রিক বাসিন্দা। ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসায় এঁটে উঠতে না পারায় ঢাকাতে এদের সংখ্যা কমতে থাকে। ১৯৬৫ সালের দিকে ঢাকায় দুই গ্রিক সহোদর বাস করতেন বলে জানা যায়। এরাই নারয়ণগঞ্জে ‘র্যালী ব্রাদার্স’ নামে পাটের কারখানা খুলেছিলেন।

ঢাকার মৌলবীবাজারেও আরমেনীয়দের পাশাপাশি কিছুসংখ্যক গ্রিকও বসবাস করত। এখানে একটা সমাধিক্ষেত্রও ছিল গ্রিক ও আরমেনীয়দের। ১৯৯০ সালের দিকে এখানে সেই সমাধিস্থলে একটি বহুতল ভবন গড়ে তোলা হয় অবৈধভাবে। সমাধির সমস্ত ফলকও যায় চুরি হয়ে। ফলে ঢাকায় গ্রিকদের সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও হারিয়ে যায় তখন। গবেষক হেলেন আবাদজি ঢাকায় এসে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেন এখানকার গ্রিক বাসিন্দাদের সম্পর্কে। ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দিয়ে তিনি চেষ্টা করেছিলেন, ঢাকায় কোন গ্রিক আছে কিনা জানার। আবাদজি বলেন, ঢাকাতে গ্রিক সম্প্রদায়ের যাবতীয় বিষয়াদির দায়িত্বে ছিল জেম্স্ ফিনলে এজেন্সি। তার মতে, যদি কিছু তথ্য থেকে থাকে তবে তা এই এজেন্সির কাছেই আছে। অনেক চেষ্টার পর তিনি ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে ‘র্যালী ব্রাদার্সে’র অবসরপ্রাপ্ত এক ম্যানেজার পলিডিউকিস কারোসের সন্ধান পান। পলিডিউকিস অন্তত ২৫ বছর যাবত ঢাকায় বসবাস করছিলেন এবং ঢাকাতে অনারারি গ্রিক কনসাল হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার সন্ধানলাভের পর আবাদজি গিয়ে দেখেন মাত্র দু’দিন আগে তার মৃত্যু হয়েছে। ফলে গ্রিকদের সম্পর্কে আর বেশি কিছু জানা সম্ভব হয়নি।

আবাদজি টিএসসি চত্ত্বরের গ্রিক সমাধিসৌধের ভেতরে অবস্থিত নয়টি সমাধি ফলকেরই ইংরেজি অনুবাদ করেন। প্রথমটি একজন মহিলার। এতে লেখা আছে : যার স্মৃতিতে উত্সর্গিকৃত এই ফলক, তার নাম সুলতানা আলেকজান্ডার, তিনি কিরিয়াক্স্ ফিলিপ্পোর পুত্র আলেকজান্ডারের পত্নী। যিনি ১৮০০ সালের ২৫শে জানুয়ারি মঙ্গলবার (জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী) ৩৪ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। চতুর্থ ফলকটি দিমিত্রিয়াস এলিয়াসের প্রথম পুত্র নিকোলাস দিমিত্রিয়াস এলিয়াসের। তিনি মারা গিয়েছিলেন ১৮৩৪ সালে ৫ই মার্চ ৪৫ বছর বয়সে। বিস্ময়কর ব্যাপার হল, এই সমাধিফলকে উত্কীর্ণ আছে ল্যাটিন অক্ষরে লেখা একটি উর্দু শায়ের। আবাদজির মতে, ফলকটি উত্সর্গ করেছিলেন বাসিল দিমিত্রিয়াস নামে এক ব্যক্তি যিনি ছিলেন ঢাকা কলেজের ইংরেজি শিক্ষক। তবে আবাদজির ধারণা, উর্দু ভাষায় বাসিল দিমিত্রিয়াসের ব্যুত্পত্তির অভাব ছিল বলেই সম্ভবত শায়েরটি ঠিকভাবে উত্কীর্ণ হয়নি। অথবা এমন হতে পারে যে, তিনি ইংরেজদের সঙ্গে বেশি ওঠাবসা করতেন বলে শুদ্ধভাবে গ্রিক লিখতে ভুলে গিয়েছিলেন। শায়েরটির মোটামুটি অর্থ এরকম : যখন আমি রইব না, রইবে হাসি, রইবে গান। রইবে ব্যথা, রইবে সুখ—শুধু আমি থাকব না।
সূত্র : ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *