Skip to content

ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে

কমলগঞ্জ উপজেলার সরিষকান্দি গ্রামের বাঁশবাগানে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে বকপাখিরা।

কমলগঞ্জ উপজেলার সরিষকান্দি গ্রামের বাঁশবাগানে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে বকপাখিরা।

আকমল হোসেন
সকালবেলা পাখির ডাকে ঘুম ভাঙার প্রচলিত কথাটি হয়তো এখন সব গ্রামের ক্ষেত্রে আর খাটে না। গাছপালা, ঝোপঝাড় এতটাই কমে গেছে যে পাখির নিরাপদ আবাস এখন সবখানে নেই। তবু কোথাও না কোথাও পাখি বাসা বাঁধে, বাচ্চা ফোটায়। কোনো কোনো জায়গায় তারা মানুষেরই প্রতিবেশী হয়ে আছে।

পাখির এমন একটি আশ্রয়কেন্দ্র হচ্ছে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সীবাজার ইউনিয়নের সরিষকান্দি গ্রামে উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আনোয়ার খান এবং তাঁর প্রতিবেশী আতাউর রহমান খানের বাড়ি। দুটি বাড়িই পাশাপাশি। বাড়ির ভেতর ঢুকতেই নাকে লাগে পাখির বিষ্ঠা আর গায়ের বোঁটকা গন্ধ। বাঁশবনের নিচে ঘাস ও কচুপাতা পাখির বিষ্ঠায় সাদা হয়ে আছে।

বাড়ির প্রবীণ সদস্য জুবের আহমদ খান বললেন, ‘গন্ধ হলেও আমাদের আনন্দ লাগে। দিনরাত কিচিরমিচির করে। পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে। আমাদের বাড়ি এখন তাদের দখলে। সকাল হলে বাঁশঝাড় ছেড়ে উড়ে যায়। সন্ধ্যা হলে ফিরে আসতে থাকে।’ বাড়ির আরেক সদস্য শাহীন খান বললেন, ‘কিছু পাখি সারা দিন বাসায় থাকে। একেকটি বাঁশে আট-নয়টা বাসা। এরই মাঝে দুই দফা বাচ্চা দিয়েছে। সকালে উঠানের মাটিতে চলাফেরা করে।’

সেদিন (১৪ জুলাই) বেলা অনেকটা পড়ে গেছে। তবু আষাঢ়ের রোদ বেশ ঝাঁজালো। ঝলমল করা রোদে বাড়ির পশ্চিমের বাঁশঝাড়ের পাতার নিচে তখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে ছিল কিছু দুধসাদা বক। বাঁশঝাড়ে বাসা বুনেছে পাখি। সেই সব বাসায় ছানাগুলো অবিরাম কিচিরমিচির করছিল। বিকেল যত ঘনিয়ে আসছিল, সবুজ পাতার বাঁশবনে তখন সাদা রঙের ফুল ফুটতেই থাকে। আশপাশের খোলা মাঠ থেকে উড়ে আসছিল দল বেঁধে বকের ঝাঁক। দুটি বাড়ির বাঁশবন তখন বকপাখির দখলে। সবুজের মাঝে সাদা সাদা ছোপ। তেলরঙে আঁকা কোনো ছবির মতো বাঁশবন। বাঁশঝাড়ের চূড়ায়, ডালপালায় বসা পাখির ডাকে তখন কান পাতাই মুশকিল। কোনোটি ডানা ঝাপটায় তো কোনোটি অন্যটির সঙ্গে খুনসুটি করে। কোনোটি বাঁশবনের মাথার ওপর এক দুই চক্কর দিয়ে বসে বাঁশঝাড়ে।

বাড়ির লোকজন বলেছেন, চার-পাঁচ বছর ধরে তাঁদের বাড়িতে পাখিরা আশ্রয় নিয়েছে। পাখির বিষ্ঠা ও গায়ের গন্ধে প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন তাঁদের গা সওয়া হয়ে গেছে। সারা বছরই কমবেশি পাখি থাকে। তবে বৈশাখ মাস থেকে পাখির সংখ্যা বাড়তে থাকে। পাখির এই ভিড় ভাদ্র মাস পর্যন্ত থাকে। এ সময় পাখিগুলো বাসা বোনে, বাচ্চা ফোটায়। একসময় ছানারা ডানা মেলে উড়াল দেয়। বক ছাড়াও আছে পানকৌড়ি, শালিকসহ বিভিন্ন জাতের দেশীয় পাখি। তাঁরা পাখিগুলোকে কোনো বিরক্ত করেন না। কেউ এসে শিকার করতে চাইলে বা বিরক্ত করলে বাড়ির লোকজন ও প্রতিবেশীরা মিলে বাধা দেন। তবু শিকারির উৎপাত আছে। গত রোজায় শবে কদরের রাতে শিকারির গুলির শব্দ শুনে লোকজন ছুটে এসে শিকারিকে ধাওয়া করেন।

সরিষকান্দি গ্রামের ইরেশ শব্দকর (৫০) বলেন, ‘আমরার দেখিয়া সুন্দর লাগে। কতজন মারতে চেষ্টা করে। আমরা কুদাইয়া (ধমকে) দিই।’ বাড়ির গৃহবধূ ফেরদৌসি আক্তার বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে পাখিগুলো বাঁশঝাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। বলতে গেলে পাখিদের সাথেই আমাদের বসবাস। দিনে কয়েক শ থাকলেও সন্ধ্যা হলে কয়েক হাজার পাখি আসে।’

প্রতিবেশী বিনতি রানী কর (২২) বলেন, ‘পাখিগুলোরে আমরা ঘরের মানুষের মতো দেখি। পাখি দেখি দেখি আমরার খুব ভালা সময় কাটের। কেউ মারতে চাইলে নিষেধ দিই। মারতে দিই না। পাখির ডাক শুনে ঘুম ভাঙে। খুব ভালা লাগে।’

ততক্ষণে আষাঢ়ের মেঘ জমেছে আকাশে। সন্ধ্যার ছায়া আসছে ঘন হয়ে। পাখিরাও দিনের সব লেনদেন চুকিয়ে দলে দলে নীড়ে ফিরছে। বাড়ির আকাশে তখন পাখির মেলা। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নামবে। সব পাখি বাঁশবনের পাতার নিরাপদ আশ্রয়ে ঢুকে যাবে। সেই ফেরাটুকু দেখতে দেখতে প্রকৃতিতে আষাঢ় তার চেনা রূপ নিয়ে হাজির। ঝুপ করে বৃষ্টি নামল। পাখিগুলোও বাঁশবনের সঙ্গে গেল মিশে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে শুধু কিছু কিছু সাদা রং চোখে পড়ছিল। সৌজন্যে: প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *