বিশ্ববাসীর কাছে পেরু দেশটি পরিচিত মূলত মাচুপিচু সভ্যতার জন্য। মাটি খুড়ে এই সভ্যতাটি আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত দক্ষিণ ইউরোপের একাংশের কাছে পেরু পরিচিতি পেলেও অন্যান্যদের কাছে প্রায় অজানাই ছিল। পৃথিবীর বহু প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে মাচুপিচু নিঃসন্দেহে অনেক পুরনো। যদিও ওই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ ছাড়া অন্য কিছুই এখন আর বর্তমান নেই। তবে কিছু কিছু সমাজবিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের মতে, সভ্যতার কখনও মৃত্যু হয় না। সভ্যতা তার নিজের নিয়মানুযায়ী নিত্য নতুন বিবর্তনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যায়। দার্শনিকদের এই কথার সত্যতা যদিও আমরা হুট করে দেখতে পাবো না। কিন্তু যদি দক্ষিণ আমেরিকার ভাষারীতি লক্ষ্য করি তাহলে সভ্যতার ক্রমবিকাশের কিছু সূত্র আমরা পেয়ে যাই।
গোটা দক্ষিণ আমেরিকার একসময়কার জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত ভাষা ছিল কুয়েচুয়া। দক্ষিণ আমেরিকায় খ্রিষ্ট ধর্ম বিস্তারের আগ পর্যন্ত এই ভাষা স্বমহিমায় টিকে ছিল। কিন্তু খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারকালীন বিভিন্ন মিশনারি প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে সর্বপ্রথম এই ভাষার উপর আঘাত আসে। বর্তমান আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, চিলি, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর এবং পেরুর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই ভাষায় কথা বলতো। অথচ আজকের দিকে শুধুমাত্র পেরুর কিছু অঞ্চলে এই ভাষায় অল্পকিছু মানুষ কথা বলেন। মাচুপিচু সভ্যতায় মানুষ এই ভাষারীতিতেই কথা বলতো বলে বিজ্ঞানীরা আমাদের জানিয়েছেন। কুয়েচুয়া ভাষারীতির বিস্তারিত গবেষণা করতে গিয়ে ভাষা গবেষকরা মাচুপিচু সভ্যতার অনেক অমীমাংসিত ঘটনার ইতি টানতে সক্ষম হয়েছেন। শুধু তাই নয়, মাচুপিচু সভ্যতার ওই একই সময়ে পেরুতে আরও একটি ছোটো নগরী ছিল চোকিউকুইরাও নামে, সেই তথ্যও আবিষ্কৃত হয় ওই ভাষা থেকেই। পরবর্তীতে নৃতাত্ত্বিকরা অনেক ঘাটাঘাটির মধ্য দিয়ে আবিষ্কার করে চোকিউকুইরাও নগরী।
পেরুর কাকোরা শহর থেকে ১৬১ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত কুসকো অঞ্চল। সেখান থেকে ১৮ কিলোমিটার পায়ে হাটা পথ গেলে দেখা মিলবে কাপুলিয়ক পর্বত। এই পর্বতের পেছনে ফেলে আগাতে থাকলে সামনেই পরবে আপুরিমাক নদী। সেই নদীর উজান থেকে আট কিলোমিটার আগালে একটু একটু করে দেখা মিলবে ধ্বংসস্তুপের। সেই ধ্বংসস্তুপ দেখতে দেখতে দুই কিলোমিটার হাটলেই সাগর থেকে ৩১০০ মিটার উপরে অবস্থিত চোকিউকুইরাও দেখতে পাওয়া যাবে। পাঠক নিশ্চয়ই চোকিউকুইরাওতে যাওয়ার বর্ননা শুনে ভাবছেন, ফিরে যাওয়ার সময়ও কি একই ঝক্কি পোহাতে হবে নাকি। হ্যা, ফিরে যাবার সময়েও ঠিক একই ঝক্কি নিয়ে ফিরে যেতে হবে। কারণ চোকিউকুইরাও যাবার যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও অনেক অনুন্নত।
জুন থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে চোকিউকুইরাও যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময়। কারণ এই সময়টায় মৌসুমি জলবায়ুর কারণে বর্ষা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অনেক গবেষক অবাক হয়েছেন এই ভেবে যে, মাচুপিচু যে সময় তৈরি করা হয়েছিল ঠিক একই সময়ে এই শহরটিও তৈরি করা হয়। কিন্তু পেরুর এতো ভেতরে দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা টপকে কি করে চোকিউকুইরাও এই শহরটি এতো নিখুতভাবে তৈরি করা হলো। নৃতাত্ত্বিকদের মতে, ১৪৪৫ সালের দিকে মাচুপিচু সভ্যতার পত্তন হয়। অথচ, চোকিউকুইরাওর যে আয়তনের কথা প্রাথমিকভাবে ভাবা হয়েছিল, পরবর্তীতে তা ভুল প্রমাণিত হয় এবং জানা যায় যে, বর্তমানের আয়তনের চেয়ে কয়েকগুন বড় ছিল সাবেক চোকিউকুইরাও। নৃতাত্ত্বিকরা চোকিউকুইরাও শহরের মাত্র ৩০ শতাংশ জায়গা উদ্ধার করতে পেরেছে ঘন জঙ্গলের মাঝ থেকে।
তবে পর্যটকদের বর্ধিষ্ণু চাপে চোকিউকুইরাওর উন্নয়নে হাত দিচ্ছে পেরু সরকার। আগামী ২০১৬ সালের মধ্যে চোকিউকুইরাও পর্যন্ত প্রথম কেবল কার তৈরি করা সম্ভব হবে বলে পেরু কর্তৃপক্ষ মারফত জানানো হয়েছে। অবশ্য এই কেবল কারটি হয়ে গেলে গোটা একদিনের দুর্গম রাস্তা মাত্র ১৫ মিনিটে পাড়ি দেয়া যাবে। তবে নৃতাত্ত্বিকরা সরকারের এই সিদ্ধান্তে কিছুটা হলেও নাখোশ। কারণ নৃতাত্ত্বিকদের মতে, এই নব্য আবিষ্কৃত নগরীটির এখনও অনেক স্থান আছে অনাবিষ্কৃত। পর্যটকরা আসলে একদিকে যেমন ঝুঁকির মাত্রা বাড়বে তেমনি উন্নয়ন কাজেও কিছুটা বাধা আসবে।
মূলত ১৭১০ সালের দিকে স্পেনের পরিব্রাজক হুয়ান আইরাস ডায়াজ এই ধ্বংসস্তুপটি আবিষ্কার করেছিলেন। অথচ এই ধ্বংসস্তুপটি থেকে সাবেক নগরীকে উদ্ধারের কাজ শুরু হয় মাত্র ১৯৭০ সালে। তবে এখনও যদি আপনি অনেক কষ্ট করে হলেও চোকিউকুইরাও যেতে পারেন, তবে আপনার মনে হবে আপনিই এই নগরী আবিষ্কার করেছেন। পাশাপাশি, মাচুপিচু আবিষ্কৃত হয় ১৯১১ সালে এবং পরবর্তী বছর থেকেই এর খননকার্য শুরু হয়েছিল।